এক মঞ্চ থেকে যুগপৎ আন্দোলনের ইশতেহারের ‘যৌথ রূপরেখা’ দেওয়ার কথা ছিল বিএনপি এবং গণতন্ত্র মঞ্চসহ বিরোধী দলগুলোর। কিন্তু যৌথ রূপরেখার বেশকিছু দফা নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দিলে তা ঘোষণা নিয়ে সংকট সৃষ্টি হয়। যার ফলে বারবার পিছিয়ে যায় সে ঘোষণা। 

শেষ পর্যন্ত মতবিরোধ রেখেই ঈদের পরে জুলাই মাসের ১০-১২ তারিখের দিকে পৃথক মঞ্চ থেকে নিজ-নিজ প্রস্তাবনা অনুযায়ী আন্দোলনের একদফা ও ‘যৌথ রূপরেখা’ আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ।

বিএনপি সূত্রে জানা গেছে, ঈদের পরে একদফা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের যে প্রস্তাবনা বা রূপরেখা সেটি আনুষ্ঠানিকভাবে জাতির সামনে ঘোষণা করা হবে। তারিখ চূড়ান্ত না হলেও জুলাই মাসের ৮ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে এসব ঘোষণা আসবে। এক্ষেত্রে বিএনপি আলাদা অনুষ্ঠান করে আন্দোলনের একদফা এবং রাষ্ট্র সংস্কারের ৩১ দফা ঘোষণা করবে। 

অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চ আলাদা অনুষ্ঠান করে তাদের আন্দোলনের একদফা এবং ‘সরকার ও শাসন ব্যবস্থা বদলের’ ৩১ দফা ঘোষণা করবে। আর বিএনপির সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনে থাকা অন্য সঙ্গীরা চাইলে আলাদা অনুষ্ঠানে তাদের প্রস্তাবনাগুলো ঘোষণা দিতে পারবে। আবার চাইলে বিএনপির মঞ্চে এসে দাবির সঙ্গে একমত প্রকাশ করতে পারবে। 

বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির যুগপৎ ধারায় বৃহত্তর গণ-আন্দোলনের একদফার যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে- বাংলাদেশের জনগণের ভোটাধিকার হরণকারী বর্তমান ফ্যাসিবাদী, কর্তৃত্ববাদী সরকারের পদত্যাগ ও বিদ্যমান অবৈধ সংসদের বিলুপ্তি; নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকার গঠন করে তার অধীনে অবাধ, নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক, অংশগ্রহণমূলক ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের ব্যবস্থা; বেগম খালেদা জিয়াসহ সব রাজবন্দির মুক্তি; রাষ্ট্র কাঠামো মেরামত ও তার গণতান্ত্রিক রূপান্তরের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে জনগণের ভোটাধিকার ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার একদফা দাবিতে রাজপথে সক্রিয় বিরোধী রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো যুগপৎ ধারায় ঐক্যবদ্ধ বৃহত্তর গণআন্দোলন গড়ে তোলা ও তা সফল করা।

অন্যদিকে বিএনপির একদফার সঙ্গে মিল রেখে কিছু শব্দের পরিবর্তন এনেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। এটা নিয়ে খুব বেশি দ্বিমত নেই বিএনপি ও গণতন্ত্র মঞ্চের।

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য বরকতউল্লাহ বুলু ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা আমরা অনেক আলোচনা করে একটা জায়গায় আসতে পেরেছি। আশা করি যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা ঘোষণা ঈদের পরে হবে।

বিএনপি-গণতন্ত্র মঞ্চ কি আলাদা অনুষ্ঠান করে যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা ঘোষণা দেবে? জানতে চাইলে বুলু বলেন, এটা সময়মতো দেখতে পারবেন এক মঞ্চ থেকে ঘোষণা হবে নাকি আলাদা-আলাদা হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের নেতারা বলছেন, বিএনপির রাষ্ট্র কাঠামো মেরামতের রূপরেখার ৩১ দফার সঙ্গে গণতন্ত্র মঞ্চের ৩১ দফায় শব্দগত কিছু পরিবর্তন থাকলেও অনেক দফায় মিল আছে। আমাদের মূল আপত্তি ৭ দফায়। বিএনপির ৭ দফায় বলা হয়েছে- আস্থাভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনী বিল এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত এমন সব বিষয় ছাড়া অন্যসব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের স্বাধীনভাবে মতামত নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে বিবেচনা করা হবে।

অন্যদিকে গণতন্ত্র মঞ্চের ৩১ দফায় ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে বলা হয়েছে- সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার করে সরকার গঠনে আস্থাভোট ও বাজেট পাস ব্যতীত সব বিলে স্বাধীন মতামত প্রদান ও জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার নিশ্চিত করা হবে। তারপরও বৃহত্তর স্বার্থে এসব অমিল রেখেই যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা ঘোষণা করতে যাচ্ছি। আশা করি যেসব অমিল রয়েছে সেগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আলোচনা হবে।

বিএনপির একটি সূত্র জানায়, ঈদের পরে ৫ জুলাই গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আবার বৈঠক করা হবে। সেখানে পরবর্তী যুগপৎ আন্দোলন নিয়ে তাদের ভাবনা এবং কর্মসূচি কী ধরনের হওয়া দরকার তার একটা প্রস্তাবনা দিতে বলা হয়েছে। বিএনপি তাদের ভাবনা ও কর্মসূচি নিয়ে ধারণা দেবে। সেখানে আলোচনা করেই যুগপৎ আন্দোলনের পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ এক নেতা বলছেন, মঞ্চের পক্ষ থেকে কর্মসূচির বিষয়ে রোডমার্চ, ঘেরাও কর্মসূচি, অবস্থান কর্মসূচি ও বড় সমাবেশ করার প্রস্তাবনা দেওয়া হয়েছে বিএনপিকে।

এ বিষয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিক দল বিপ্লবী ওয়ার্কাস পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, আমাদের উভয়ের মধ্যে কমন যেসব বিষয় আছে, সেগুলো আমরা একদফার মধ্যে নিয়ে এসেছি। এর বাইরে অনেকখানি মিল আছে যেসব বিষয়গুলোতে সেগুলো যার-যার মতো ঘোষণা করব। আর যেসব বিষয়গুলো নিয়ে মত পার্থক্য আছে সেগুলো নিয়ে ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হবে আশা করি।

মঞ্চের আরেক শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের যৌথ রূপরেখা নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা চলছে। আশা করি দ্রুত এটি ঘোষণা করা হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মঞ্চের এক নেতা বলেন, আসলে বিএনপি বড় দল। তাদের দলের মধ্যে অনেক বিভক্তি আছে। যারা ডানপন্থি তারা চায় না যৌথ রূপরেখার ঘোষণা করা হোক। আরেক পক্ষ এটির ব্যাপারে আন্তরিক। তাই আমরা যৌথ রূপরেখায় যেসব অমিল আছে সেগুলো নিয়ে বিএনপিকে চাপাচাপি করিনি। অমিলগুলো রেখেই এই ঘোষণাটি হবে। আজও (সোমবার) বিএনপির সঙ্গে এসব বিষয় নিয়ে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে।

এএইচআর/