সংলাপ হবেই, তবে এখনই নয়!
# আমির হোসেন আমুর বক্তব্যে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ
# দিনের ব্যবধানে বক্তব্য থেকে আমুর ইউটার্ন
# প্রবীণ রাজনীতিবিদ বুঝে শুনেই বলেছেন: ১৪ দল
# প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের পর ক্ষমতাসীন দল থেকে সংলাপের আহ্বান আসতে পারে
টানা তিন দফা ক্ষমতায় আসীন রয়েছে আওয়ামী লীগ। ২০০৯ সাল থেকে ক্ষমতা ভোগ করছে দলটি। এখন দলটি তৃতীয় দফা ক্ষমতার শেষ সময় পার করছে। চলতি বছরের শেষ নাগাদ বা আগামী বছরের শুরুতে হতে পারে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আর এ নির্বাচনকে ঘিরে টান টান উত্তেজনা বিরাজ করছে রাজনৈতিক অঙ্গনে। বড় দুই দলের মধ্যে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ চায় নির্বাচিত সরকারের অধীনে নির্বাচন, আর বিএনপির দাবি তত্ত্বাবধায়ক বা নিরপেক্ষ সরকার ব্যবস্থার।
বিজ্ঞাপন
নির্বাচনে কারা আসবে, কারা আসবে না, কী কী দাবি মেনে নিলে বিরোধী দলগুলো নির্বাচনে অংশ নেবে, আবার ক্ষমতাসীনরা কী পরিকল্পনা আকছে, এ নিয়েও চলছে চুলচেড়া বিশ্লেষণ। চলমান পরিস্থিতি নিয়ে রাজনৈতিক মহলেও তৈরি হয়েছে অস্থিরতা
রাজনৈতিক এ সংকট কাটাতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগসহ দীর্ঘ সময় ক্ষমতার বাইরে থাকা দলগুলোর মধ্যে সংলাপের বিষয়টি সামনে আসছে। সেই সংলাপের আলোচনায় ঘি ঢেলেছেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য আমির হোসেন আমু। নির্বাচন নিয়ে আওয়ামী লীগের এই উপদেষ্টার এক বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলের সংলাপ প্রক্রিয়া নিয়ে ভিন্ন প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। নিজ দলের নেতারাও ভিন্ন মতানৈক্য প্রকাশ করেছেন। আবার কেউ কেউ সংলাপের পক্ষ নিয়েও কথা বলছেন। কিন্তু সংলাপ নিয়ে ক্ষমতাসীন দলের দ্বিমুখী বক্তব্যে রাজনীতিতে বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছে।
আরও পড়ুন- জামায়াতের সঙ্গে সংলাপ নয়, সিপিবি-বাসদের অপেক্ষায় বিএনপি
২০১৮ সালের নির্বাচনের মতো দ্বাদশ নির্বাচনেও সংলাপ হতে পারে। তবে সেই সংলাপের সময় এখনই বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলটির সিনিয়র নেতারা।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ডা. মোস্তফা জালাল মহিউদ্দিন ঢাকা পোস্টকে বলেন, “বিএনপি তো সংলাপ করতে চায় নাই, তারা সংলাপ করতে চাইলে করতে পারে। এতে অসুবিধা কী? যদি তারা কথা বলে, যদি তারা নাই আসে তাহলে আমরা কেন করতে যাব, তাই না?”
“জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করলে বিএনপির সঙ্গে বৈঠকে রাজি আওয়ামী লীগ” আমির হোসেন আমুর এমন বক্তব্যের প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এই সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বলেন, “উনি তো তার ব্যক্তিগত একটি স্টেটমেন্ট দিয়েছেন। উনি তো আবার তার পরবর্তী স্টেটমেন্টও দিয়েছেন। এটা আমাদের কোনো দলীয় সিদ্ধান্ত ছিল না।”
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগ-বিএনপি রাজনৈতিক মাঠে দীর্ঘদিন ধরেই পাল্টাপাল্টি কর্মসূচি, বক্তব্য ও সমালোচনা করে আসছে। নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদলগুলোর রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড উত্তাপ ছড়াচ্ছে।
আরও পড়ুন- বিএনপির সঙ্গে সংলাপ হবে না : তথ্যমন্ত্রী
বছরের শুরু থেকেই মাঠের কর্মসূচিতে দেশের বড় দুই রাজনৈতিক দল সক্রিয় রয়েছে। কেউ কর্মসূচি করছেন নয়াপল্টনে, আবার কেউ উত্তরায়। পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতেও দূরত্ব বজায় রেখেছে বড় দলগুলো। তবে মাঠের রাজনীতি থেকেই বর্তমানে দুই দল কূটনৈতিক মহলে ভিড়ছেন। বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন। এরই মধ্যে অবাধ, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জাতীয় নির্বাচনের লক্ষ্যে নতুন ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এ নিয়ে দেশের রাজনৈতিক মহলে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়। ক্ষমতাসীনরা বলছেন, বিএনপি নির্বাচনে বাধা দিলে তাদের নেতাকর্মীরা ভিসা নীতির আওতায় পড়বে, আবার বিএনপি বলছে বেকায়দায় আওয়ামী লীগ।
যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতির রেশ কাটতে না কাটতে উত্তপ্ত রাজনীতি ঠান্ডা করতে গিয়ে ঘি ঢেলে দিয়েছেন ১৪ দলের সমন্বয়কারী আমির হোসেন আমু। তিনি বলেছিলেন, “প্রয়োজনে জাতিসংঘের প্রতিনিধি আসুক আমরা বিএনপির সঙ্গে মুখোমুখি বসে আলোচনা করে দেখতে চাই, কীভাবে সবাই মিলে একটি অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়। সেটা আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা হতে পারে অন্য কোনো পথে নয়। ২০১৩ সালে জাতিসংঘের প্রতিনিধি তারানকো বাংলাদেশে এসেছিলেন। দুদলের সঙ্গে বৈঠক করেছেন। এবারও জাতিসংঘ প্রতিনিধি এলে আমরা তাদের সামনে আলোচনা করতে রাজি আছি।”
এই বক্তব্যকে নাকচ করেছেন দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং দলের যুগ্ম সম্পাদক তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ।
ওবায়দুল কাদের বলেন, “নির্বাচনকালীন সরকার নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনার বিষয়ে এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আর জাতিসংঘ মধ্যস্থতা করবে, এমন কোনো সংকটও দেশে নেই। আমাদের নিজেদের সমস্যা আমরা নিজেরা আলোচনা করব, প্রয়োজন হলে নিজেরাই সমাধান করব।”
আরও পড়ুন- সংলাপের বিকল্প নেই : স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
আমির হোসেন আমুর বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত বলে মন্তব্য করেছেন তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী হাছান মাহমুদ। তিনি বলেন, সংলাপ নিয়ে বক্তব্যটি তার ব্যক্তিগত। এ বক্তব্য নিয়ে আওয়ামী লীগের দলীয় ফোরামে কোনো আলোচনা হয়নি, এমনকি ১৪ দলেও আলোচনা হয়নি। তার সঙ্গে (আমু) যোগাযোগ করা হয়েছে। কথাটি গণমাধ্যমে যেভাবে এসেছে তিনি সেভাবে বলেননি।
অপরদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান বলেন, ‘সংলাপের কোনো বিকল্প নেই। আমরা মনে করি- সবকিছুই সংলাপের মাধ্যমে, আলোচনার মাধ্যমে শেষ করতে হবে। কারণ, আওয়ামী লীগ একটি পপুলার পার্টি। আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ক্ষমতায় রয়েছে। আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে জনগণের ক্ষমতায় চলতে হবে। আর জনগণের ক্ষমতা অব্যাহত রাখতে হলে সবার সঙ্গে আলোচনা করতে হবে। তাই আলোচনার বিকল্প কিছু নেই।’
এদিকে দিনের ব্যবধানে নিজের বক্তব্য থেকে ইউটার্ন নিয়েছেন উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য আমু। তিনি গত বুধবার (৭ জুন) ৬দফা দিবস উপলক্ষ্যে আওয়ামী লীগ আয়োজিত আলোচনা সভায় বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। আলোচনার জন্য কাউকে বলা হয়নি এবং কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয়নি। তাছাড়া কাউকে আহ্বান করা হয়নি। কাউকে আহ্বান করার সুযোগও নেই। এটা আওয়ামী লীগের বাড়ির দাওয়াত নয় যে দাওয়াত করে এনে খাওয়াব।’
আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতারা বলছেন, আগামী ডিসেম্বরে নির্বাচন হলেও আওয়ামী লীগ এখন থেকেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আর কারা কারা নির্বাচনে আসবে তা তো এখনো স্পষ্ট নয়। সময় ঘনিয়ে আসলে সব পরিষ্কার হয়ে যাবে। নির্বাচনের সময় বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্ন তদবির, চাপ, সুপারিশ থাকে। সেগুলোর কিছুটা থাকে ক্ষমতাসীনদের পক্ষে, আবার কিছুটা থাকে বিপক্ষে। সবকিছু মাথায় নিয়েই নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে হয়। তবে নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও অবাধ করতে হলে সকল দলকেই অংশগ্রহণ করতে হয়। কিন্তু, বিএনপি তো নির্বাচনের বিষয়ে এখনো কিছু বলছে না।
তবে সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য বিএনপিসহ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলাপ বা সংলাপ হতে পারে বলে মনে করছেন দলটির নেতারা।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টামণ্ডলীর এক সদস্য ঢাকা পোস্টকে বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে সংলাপ হতে পারে। বিগত নির্বাচনেও তা হয়েছে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সংলাপে অংশ নিয়েছিল ড. কামাল হোসেন ও বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের নেতৃত্বে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতারা। এবার যদি আবার সংলাপে অংশ নেন তাতে ক্ষতি নেই।
আমুর বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমু ভাই সিনিয়র নেতা, তিনি বলেছেন যেহেতু, কোনো না কোনো ইঙ্গিত তো আছে। তবে সময়টা এখনই না, তা আরও পরে। আমু ভাই বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। এখন আলাপ-আলোচনা ও সমালোচনা হবে। তবে নির্বাচনে সংলাপ হবে না এটা বলা যাবে না। হঠাৎ করে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় সংলাপে আওয়ামী লীগ রাজী বলায় দল কিছুটা বেকায়দায় পরলেও সংলাপের দরজাটা কিন্তু খোলা রয়েছে। এছাড়া আগামী সেপ্টেম্বরে আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) ভারত যাবেন। তিনি দেশে ফিরে আসলে তখন নির্বাচনের সংলাপ নিয়ে কথা হতে পারে। কারণ, নির্বাচনের রাস্তা খোলা আছে, যে কেউ চাইলে এই রাস্তায় অংশ নিতে পারে।
আরও পড়ুন- সংলাপ নিয়ে আপাতত আমরা ভাবছি না : ওবায়দুল কাদের
দ্বাদশ নির্বাচনের পূর্বে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের প্রয়োজন আছে কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন ঢাকা পোস্টকে বলেন, আলোচনা হতে হবে কি না সেটি সময় বলে দেবে। তবে, অনর্থক আনুষ্ঠানিক আলোচনার কোন প্রয়োজন নেই। গ্রাউন্ড প্রস্তুত করে সবাই মিলে নির্বাচন অনুষ্ঠিত করতে হবে।
সংলাপ নিয়ে দলের নেতাদের মতানৈক্য দলকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলছে কী না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগে কোন ধরনের মতানৈক্য নেই। সমগ্র আওয়ামী লীগ দলের নেতা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ। আওয়ামী লীগে ব্যক্তিগত মত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা রয়েছে। একটি দলে বহুমত থাকাটা স্বাভাবিক এবং গণতান্ত্রিক। আওয়ামী লীগ মুক্তবুদ্ধি চর্চাকে ধারণ করে বলেই দলটি কখনো বৃদ্ধ হয়নি, দলটি চিরসবুজ ইমেজ ধরে রেখেছে। আওয়ামী লীগ সবার মতামতের ভিত্তিতে যখন কোন ইস্যুতে সিদ্ধান্ত নেয় সেটি হয় দলের সিদ্ধান্ত এবং সবাই সেটি মেনে চলেন।
প্রভাবশালী যেসব দেশ বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন দেখতে চায়, তারা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি নেতাদের বারবার সংলাপের রাস্তা বাতলে দিয়েছেন। সেই রাস্তায় না চলে দফায় দফায় অনীহা দেখিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। সংলাপে অনীহার কারণও উল্লেখ করেছে টানা তিন মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা দলটি।
সর্বশেষ প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাও বিএনপির সঙ্গে সংলাপের বিষয়টি নাকচ করে দিয়েছিলেন। ফলে পথ হারিয়েছিল সংলাপ আলোচনা। পরে গত মঙ্গলবার হঠাৎ ১৪ দলীয় জোটের জনসভা থেকে বর্ষীয়ান রাজনীতিক আমির হোসেন আমুর সংলাপ বিষয়ের বক্তব্য নিয়ে ফের রাজনৈতিক মহলে আলোচনা শুরু হয়েছে।
এমএসআই/এমজে