দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে মাঠের কর্মসূচির পাশাপাশি জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে বিএনপি। নিয়মিত বিরতিতে কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করছেন মহাসচিবসহ দলের বিদেশ বিষয়ক কমিটির সদস্যরা। যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতিকে সামনে রেখেও কিছু কর্মতৎপরতা শুরু করেছে দলটি। এর মধ্যে আছে, গত দুই সংসদ নির্বাচনে অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের তালিকা তৈরি করা। 

বিএনপি নেতারা বলছেন, গত এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতায় শুধু জনসমর্থন নিয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা কঠিন হয়ে পড়েছে। ক্ষমতায় যেতে হলে জনসমর্থনের পাশাপাশি কূটনৈতিক সফলতাও লাগবে। দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সেই কাঙ্ক্ষিত সফলতা পায়নি। বিশেষ করে, নানাবিধ কারণে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে অনেক পিছিয়ে ছিল দলটি। 

আগামী নির্বাচন সামনে রেখে এখন পর্যন্ত প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ভূমিকা নিয়ে তারা আশাবাদী। কেবল একটি দলকে সাপোর্ট করার নীতি থেকে দেশটির দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করছেন বিএনপি নেতারা। আগামী সেপ্টেম্বরে এটি আরও পরিষ্কার হবে বলে আশা করছেন তারা।   

আরও পড়ুন >> রাষ্ট্রদূতরা সীমা লঙ্ঘন করলে ব্যবস্থা : পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী

বিএনপির বিদেশ বিষয়ক কমিটির সূত্র বলছে, কূটনীতিকদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করার পাশাপাশি বেশ কিছু কার্যক্রম হাতে নিয়েছেন তারা। এর মধ্যে দশম ও একাদশ সংসদ নির্বাচনে ভোটের দিন সারা দেশে যেসব রিটার্নিং কর্মকর্তা ছিলেন তাদের একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। ভোটে অনিয়মের যেসব তথ্য আগে সংগ্রহ করা ছিল সেগুলোর সঙ্গে নতুন করে কিছু তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সেগুলো একত্র করে একটি ডকুমেন্টারি বা তথ্যচিত্র তৈরি করার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী কিছুদিনের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তা প্রকাশ করা হবে। এই তথ্যচিত্র কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করা হবে।

এছাড়া ২০০৯ সাল থেকে সারা দেশে বিএনপির নেতাকর্মীদের হত্যা, গুম, নির্যাতনের সঙ্গে যারা জড়িত ছিলেন তাদেরও একটি তালিকা তৈরি করা হচ্ছে দলের পক্ষ থেকে। তার ভিত্তিতেও একটি তথ্যচিত্র তৈরি করবে বিদেশ বিষয়ক কমিটি। সেটিও কূটনীতিকদের কাছে দেওয়া হবে। এগুলোর উদ্দেশ্য একটাই, অতীতে সুষ্ঠু ভোটে কারা বাধা দিয়েছিলেন এবং ভবিষ্যতে তাদের অধীনে কেমন নির্বাচন হতে পারে সেটা কূটনীতিকদের সামনে তুলে ধরা। বিশেষ করে মার্কিন দূতাবাসকে বোঝানো।

বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিদেশ বিষয়ক কমিটির সদস্য শামা ওবায়েদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমার পরিষ্কার কথা হচ্ছে, বাংলাদেশে যদি একটি সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকে, তাহলে কোনো কূটনীতিকের কাজ নয় এখানে কীভাবে নির্বাচন হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া বা পরামর্শ দেওয়া। এটার সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলের।

তিনি বলেন, তবে, বাংলাদেশের গণতন্ত্র এখন আর বাংলাদেশের বিষয় নয়। এটা বৈশ্বিক ব্যবস্থার অংশ। দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি এবং ভূ-রাজনীতির যে সমীকরণ হচ্ছে, সেখানে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান আছে কি নেই; থাকবে কি থাকবে না, নির্বাচন সুষ্ঠু হবে কি হবে না; সেটা দেশের সীমানার মধ্যে আর সীমাবদ্ধ নেই। কারণ এখানে যারা বিনিয়োগ করে তারা চায় যে এখানে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকুক, গণতান্ত্রিক সরকার থাকুক। যেটা বর্তমানে নেই। এজন্য কূটনীতিকরা কথা বলছেন। কিন্তু দিন শেষে দেশের জনগণ এবং রাজনৈতিক দলগুলোকেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে, কী ব্যবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচন করতে হবে।

আরও পড়ুন >> জাপার নির্বাচন পরিকল্পনা জানতে চেয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত      

বিএনপির সহ-আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট ফাহিমা মুন্নী ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা বিরোধী দল হতে পারি। কিন্তু আমাদের কাছে এক নম্বর গুরুত্ব হচ্ছে দেশ, তারপর দল। সেটাকে সামনে রেখে আমরা কূটনীতিকদের সঙ্গে অফিসিয়াল, আন-অফিসিয়াল বৈঠক করি। 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির বিদেশ বিষয়ক কমিটির এক সদস্য বলেন, কূটনৈতিক কার্যক্রম চোখে দেখা যায় না। এটা খুব ধীরগতিতে চলে। এর ফল আসে খুব দেরিতে। তবে এবার আমরা আশাবাদী কিছু একটা হবে। বিএনপি কূটনৈতিকভাবে সফল হবে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক সদস্য বলেন, কয়েকদিন আগে ভারতের জিন্দাল স্কুল অব ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্সের অধ্যাপক এবং দক্ষিণ এশিয়া বিশ্লেষক প্রফেসর শ্রীরাধা দত্ত বলেছেন, ‘ভারত সরকার কখনোই মার্কিন সরকারের কাছে গিয়ে বাংলাদেশ বা আওয়ামী লীগের হয়ে দেন-দরবার করবে না।’ ওনার কথাতে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গির যে পরিবর্তন হয়েছে সেটা বোঝা যাচ্ছে। আমরা আশা করি, নির্বাচন পর্যন্ত ভারত কোনো দলের সঙ্গে নয়, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের নীতি বজায় রাখবে।

গত ৪ জুন জাপানের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করে বিএনপির তিন সদস্যের প্রতিনিধি দল। এরপর ৬ জুন মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। এছাড়া ৫ জুন স্পেনের নতুন রাষ্ট্রদূত এবং ৮ জুন অস্ট্রেলিয়ান হাইকমিশনারের সঙ্গে বৈঠকে করেন বিএনপির বিদেশ বিষয়ক কমিটির সদস্যরা। 

কমিটির সদস্যরা বলছেন, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিএনপি মহাসচিবের বৈঠক ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ ওই বৈঠকে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপির অবস্থান পরিষ্কার করা হয়েছে। সেখানে আওয়ামী লীগের অধীনে বিএনপির নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রকে। 

একইসঙ্গে ১/১১ সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় করা মামলাগুলোর মধ্যে আওয়ামী লীগ নিজেদেরগুলো প্রত্যাহার করলেও একই সময়ের মামলায় বিএনপি চেয়ারপারসনকে সাজা দিয়ে গৃহবন্দি করে রেখেছে এবং বিএনপির সিনিয়র নেতাদের মামলাগুলোর রায় দিয়ে তাদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখার সরকারি পরিকল্পনার কথাও তুলে ধরা হয়েছে বৈঠকে।     

কূটনৈকিতদের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকের বিষয়ে জানতে চাইলে দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল আলমগীর ঢাকা পোস্টকে বলেন, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের পক্ষে থাকার অবস্থান ব্যক্ত করেছেন তারা। আর যেহেতু সামনে বাংলাদেশের সংসদ নির্বাচন, সেই নির্বাচনে বিএনপির অবস্থান কী হবে, এসব বিষয়ে তারা জানতে চায়। আমরা আমাদের অবস্থান, দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, আইনের শাসন, মানবাধিকার ও নির্বাচনী ব্যবস্থার বিষয়গুলো তুলে ধরি। 

এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনে কূটনীতিকরা কতটুকু ভূমিকা রাখতে পারবে, কিংবা রাখবে, সেটা আমরা বলতে পারব না।   

এই প্রসঙ্গে শামা ওবায়েদ বলেন, কূটনীতিকরা বিএনপির অবস্থান জানতে চায়। আমরা ক্রমাগতভাবে সেটা জানিয়ে যাচ্ছি। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের গণতান্ত্রিক দেশগুলো চায় বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার থাকুক, তারা বিরোধী দলগুলোর মতামত জানতে চায়। আমরা তাদেরকে সেটা জানাচ্ছি।
 
এএইচআর/জেডএস