রওশন-বিদিশার লক্ষ্য সরকারের আনুকূল্য, দোলাচলে জিএম কাদের
বিরোধ যেন কিছুতেই জাতীয় পার্টির পিছু ছাড়ছে না। ত্রিধারায় বিভক্ত দলটিতে কখনও দেবর-ভাবি, কখনও চাচা-ভাতিজা আবার কখনও পদ-পদবি ও অর্থকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব লেগেই থাকে। আর এসব দ্বন্দ্বের মূল চরিত্রে থাকেন দলটির বর্তমান চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের (জিএম কাদের) ও সংসদের বিরোধী দলীয় নেতা এবং দলের প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদ।
এ দুইজনের মধ্যকার দ্বন্দ্বের ভেতর মাঝে-মধ্যে হাজির হন দলের প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ ও তার মা বিদিশা সিদ্দিক। অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ এবং অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, এসব নিয়েই দোদুল্যমান অবস্থায় রয়েছে ১৯৮৬ সালে প্রতিষ্ঠা পাওয়া দলটি।
বিজ্ঞাপন
রওশন, বিদিশা ও জিএম কাদের কী চায়
আগামী সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে রওশন এরশাদ ও বিদিশা সিদ্দিকের মধ্যে একটা মিল রয়েছে। এই দুইজনই নির্বাচনকে সামনে রেখে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের আনুকূল্য পেতে চায়। আর জিএম কাদের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিজের অবস্থান ঠিক করার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন।
জিএম কাদেরপন্থিরা বলছেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে এখন পর্যন্ত ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন তারা। কিন্তু চূড়ান্ত কর্মপরিকল্পনা ঠিক হবে আরও পরে। ঈদের পরে দলের প্রেসিডিয়াম সদস্যদের বৈঠক ডাকার কথা রয়েছে। সেখানে মূলত জাতীয় পার্টি এককভাবে নাকি জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেবে— তা ঠিক করা হবে। জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নিলেও এখানে দুটি বিষয় রয়েছে। একটি হচ্ছে, আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটগতভাবে নির্বাচনে অংশ নেওয়া, অন্যটি হচ্ছে- জাতীয় পার্টিসহ অন্যান্য কয়েকটি দলকে সঙ্গে নিয়ে জোটবদ্ধ হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। অর্থাৎ রাজনৈতিক পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করে জিএম কাদের কর্মপরিকল্পনা ঠিক করবেন।
৩০০ আসনে প্রার্থী দিতে প্রস্তুতি নিচ্ছে জাতীয় পার্টি
আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে জাতীয় পার্টি এগুচ্ছে বলে জানিয়েছেন দলটির প্রেসিডিয়াম সদস্য ফখরুল ইমাম।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, জোটগত নির্বাচনের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এখনও। তবে জোটগত নির্বাচন করলে আমরা সবসময় উন্নয়নের পক্ষের শক্তির সঙ্গেই আছি। ঈদের পর দলের প্রেসিডিয়ামের সভা হওয়ার কথা রয়েছে। সেখানে দলের করণীয় ঠিক করা হবে।
আরও পড়ুন : বিএনপির নতুন-ইয়াং নেতৃত্ব দরকার, তারেকের মেয়েকে দরকার
জিএম কাদের জানিয়েছেন, তারা এককভাবে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনে প্রার্থী দেবেন।
নাম না প্রকাশ করার শর্তে জিএম কাদেরপন্থি এক প্রেসিডিয়াম সদস্য বলেন, ঈদের পরে রাজনৈতিক পরিস্থিতি অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জাপান-আমেরিকা সফরের পর, আগামী নির্বাচন কতটা সরকারের আনুকূল্যে থাকবে সে সম্পর্কে পরিষ্কার বার্তা পাওয়া যাবে। তখন পরিস্থিতি বলবে- সরকারের সঙ্গে থাকব নাকি ভিন্ন চিন্তা করব। আর সবকিছু বিবেচনায় নিয়ে জিএম কাদের তার রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক করবেন। তবে মুখে বিরোধিতা করলেও এখন পর্যন্ত জিএম কাদেরও সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন।
দ্বন্দ্বের মধ্যেও নিজেদের যোগাযোগ রক্ষা করছেন রওশন ও জিএম কাদেরপন্থিরা
রওশন এরশাদের সঙ্গে চলমান দ্বন্দ্বের সমাধান কোন পথে হবে সেটিও ঈদের পরে ঠিক করা হবে বলে জানিয়েছেন জিএম কাদেরপন্থিরা।
তারা বলছেন, রওশন এরশাদের সঙ্গে জিএম কাদেরের নিয়মিত কথা হয়। তার পক্ষ থেকে অনেক সুপারিশ আসে- যেগুলো জিএম কাদের মেনে চলছেন। এরপর রওশনপন্থি হয়ে যারা দ্বন্দ্ব তৈরি করে রাখছেন, তাদের বিষয়টিও দলের প্রেসিডিয়াম সভা ডেকে সুরাহা করা হবে। এক্ষেত্রে রওশন এরশাদ যদি প্রেসিডিয়ামের সভায় নেওয়া সিদ্ধান্তের সঙ্গে একমত না হন তাহলেও তার বিষয়ে কী করণীয় সে বিষয়েও সিদ্ধান্ত হবে। তবে, রওশনপন্থি হিসেবে পরিচিত যাদেরকে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের কাউকে ফিরিয়ে না নেওয়ার সিদ্ধান্তে অটল আছেন জিএম কাদের।
আরও পড়ুন : ঈদের ছুটি কাজে লাগাতে চায় বিএনপি
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, দলীয় সরকারের অধীনে জাপা নির্বাচনে অংশ নেবে এমন কথা রওশন এরশাদ বলেছেন কি না, আমি জানি না। তবে তার সঙ্গে যারা আছেন, তারা কেউ জাতীয় পার্টির না। তারা পার্টি ছেড়ে দিয়েছেন অনেক আগেই। যারা জাতীয় পার্টির নাম ভাঙিয়ে এসব কথা বলছেন, তাদের বিষয়ে আমরা যাচাই-বাছাই করছি, আইনগত ব্যবস্থা নেব।
রওশন এরশাদপন্থি নেতারা বলছেন, আওয়ামী লীগ পর-পর দুইবার রওশন এরশাদকে বিরোধী দলীয় নেতা বানিয়েছে। ফলে সেই কৃতজ্ঞতা থেকে এবং বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে আগামীতেও সরকার গঠন করার সম্ভাবনা আওয়ামী লীগেরই বেশি। তাই রওশন এরশাদ ও তার অনুসারীরা আগামী নির্বাচনেও সরকারের সঙ্গে থাকবেন।
আরও পড়ুন : বিএনপি-জামায়াতের দূরত্ব নির্বাচনী কৌশল নয় তো?
আর এখন যারা রওশন এরশাদের সঙ্গে আছেন, তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে আগামী নির্বাচনে দলের মনোনয়ন নিশ্চিত করা। এজন্য জিএম কাদেরকে চাপে রেখে দলে ফেরা এবং সমঝোতা করাই মূল লক্ষ্য। এছাড়া জিএম কাদেরের সঙ্গে যারা আছেন, তারাও অনেকে প্রকাশ্যে এবং গোপনে রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। যাতে আগামী নির্বাচনে মনোনয়ন নিয়ে কোনো ঝামেলায় পড়তে না হয়।
এ প্রসঙ্গে মন্তব্য জানতে একাধিকবার যোগাযোগ করা হলেও রওশন এরশাদের বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
তবে জাতীয় পার্টির সাবেক প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রওশন এরশাদের মুখপাত্র কাজী মো. মামুনুর রশীদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘ম্যাডাম আগের চাইতে অনেক সুস্থ। তিনি রাজনীতির জন্য আগের চাইতে এখন অনেক বেশি ফিট। দলকেও সংগঠিত করা হচ্ছে, নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে।’
জাতীয় পার্টির যেসব নেতারা এখন জিএম কাদেরের সঙ্গে আছেন, তারাও রওশন এরশাদের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে চলছেন বলে উল্লেখ করে মামুন বলেন, ‘জাতীয় পার্টির যারা সংসদে আছেন, তারা সবাই চান বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে। সেই লক্ষ্যে ম্যাডাম কাজ করছেন।’
রওশন এরশাদের সঙ্গে যারা আছেন, তারা কেউ জাতীয় পার্টির নন, তাদের দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে- দলের বর্তমান চেয়ারম্যান জিএম কাদেরের এমন বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মামুন বলেন, আমরা দল ত্যাগ করিনি। বরং স্বেচ্ছাচারিতার কারণে জাতীয় পার্টি থেকে ৪ বার বহিষ্কার করা হয়েছে জিএম কাদেরকে। আমরা ম্যাডামের নির্দেশে সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটি স্থগিত করেছিলাম। এখন আবার তার নির্দেশে সম্মেলন প্রস্তুতির কাজ শুরু করেছি। ঈদের পরে একটা বর্ধিত সভা করা হবে। সেখানে ঠিক হবে আগামী সম্মেলন কবে হবে।
জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের নামে ১০০ আসনে প্রার্থী দিতে যায় বিদিশা
২০২১ সালে রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে পদ-পদবি নিয়ে দ্বন্দ্ব চরম আকার ধারণ করে। তখন জাতীয় পার্টির রাজনীতিতে নতুন করে আবির্ভাব ঘটে এরশাদের সাবেক স্ত্রী বিদিশা সিদ্দিকের। তখন তার সঙ্গে ছিলেন কাজী মামুনুর রশীদসহ দলছুট অনেক নেতাকর্মী। এরপর ওই বছরের ১৪ জুলাই এরশাদের মৃত্যুবার্ষিকীর দিনে এরশাদের ছেলে এরিক এরশাদ জাতীয় পার্টির ‘নতুন কমিটি’ ঘোষণা করেন।
সেই অনুষ্ঠানে এরশাদের আরেক ছেলে সাদ এরশাদ যোগ দেন। ওই কমিটিতে রওশন এরশাদকে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানও করা হয়। সে সময় রওশন এরশাদের সঙ্গে বিদিশার সখ্য গড়ে ওঠে। রাজধানীর একটি হাসপাতালে ভর্তি রওশন এরশাদকে দেখতেও যান বিদিশা। কিন্তু ওই বছরের ৪ নভেম্বর বিদিশা এরশাদ জাতীয় পার্টি পুনর্গঠন করে নিজেকে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ঘোষণা করলে রওশন এরশাদ ও তার ছেলে সাদ এরশাদ এবং কাজী মামুনের সঙ্গে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। যার ফলে তারা জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন প্রক্রিয়া থেকে বেরিয়ে আসেন।
বর্তমানে বিদিশা সিদ্দিক ২০১৭ সালের এরশাদ ঘোষিত ৫৮ দলীয় সম্মিলিত জাতীয় জোটের চেয়ারম্যান। এই জোটকে নিয়ে সরকারের সঙ্গে থেকে আগামী নির্বাচনে অংশ নিতে প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে
জাতীয় পার্টির পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান বিদিশা সিদ্দিক ঢাকা পোস্টকে বলেন, সারাদেশে ৪৭টি জেলায় কমিটি আছে জাতীয় পার্টি পুনর্গঠনের। ঈদের পরে সাংগঠনিক সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য জেলা সফরে নামব।
এরশাদ ঘোষিত ৫৮ দল সম্বলিত জাতীয় জোটের চেয়ারম্যান হিসেবে বিদিশা নিজেই আছেন বলে জানান। তিনি বলেন, নির্বাচনকে সামনে রেখে আমাদের চিন্তা-ভাবনা রয়েছে। আমরা সরকারকে সহযোগিতা করতে চাই যেন তারা ভালোভাবে ক্ষমতায় থাকতে পারে। আমাদের নিয়ে সরকার বিরোধী উল্টোপাল্টা প্রচারণা চালিয়ে লাভ নেই।
আগামী সংসদ নির্বাচনে ১০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার টার্গেট রয়েছে উল্লেখ করে বিদিশা বলেন, সরকারের সঙ্গে আলোচনা করে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেব।
সরকারের পক্ষ থেকে কেউ আপনাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে বিদিশা বলেন, এটার উত্তর এখন দিতে পারছি না। সময় হলে দেখতে পাবেন।
এএইচআর/এমজে