রওশনের ওপর জিএম কাদেরের ‘চেয়ারম্যান-ভাগ্য’
হাইকোর্টের আদেশ পক্ষে আসায় দীর্ঘ তিন মাসের বেশি সময় পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে আবারও কার্যক্রম শুরু করেছেন গোলাম মোহাম্মদ কাদের। তবে, দলের চেয়ারম্যান হিসেবে তার রাজনীতি চালিয়ে যাওয়ার পথ সুগম থাকবে কি না, তা অনেকটা নির্ভর করছে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক রওশন এরশাদের সিদ্ধান্তের ওপর। রওশন এরশাদ কী সিদ্ধান্ত নেবেন, সেটা আবার নির্ভর করছে ‘তৃতীয় পক্ষের’ মনোভাবের ওপর।
রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) গঠনতন্ত্র অনুযায়ী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে গোলাম মোহাম্মদ কাদের দায়িত্ব পালন করতে পারবেন না, নিম্ন আদালতের এ রায় স্থগিত করেন হাইকোর্ট। ফলে জাপা চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনে আপাতত কোনো বাধা নেই।
বিজ্ঞাপন
রওশন এরশাদপন্থি নেতারা বলছেন, হাইকোর্টের আদেশ স্থগিতের জন্য আপিল বিভাগে যাওয়া হবে কি না, তা নির্ভর করছে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি যদি নির্দেশ দেন তাহলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। তবে, রওশন এরশাদকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে অন্য একটি পক্ষের, সেটা তৃতীয় পক্ষ নামে পরিচিত; তাদের মনোভাব কী সেটাও জানতে হবে। তাই জিএম কাদেরের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের বিরুদ্ধে আপিলে যাওয়া, না যাওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে আরও কয়েক দিন সময় লাগতে পারে।
ইকোর্টের আদেশ স্থগিতের জন্য আপিল বিভাগে যাওয়া হবে কি না, তা নির্ভর করছে জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদের বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদের সিদ্ধান্তের ওপর। তিনি যদি নির্দেশ দেন তাহলে এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। তবে, রওশন এরশাদকে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হলে অন্য একটি পক্ষের মনোভাব কী সেটা জানতে হবে
গত বছরের ৩১ আগস্ট ব্যাংককে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিএম কাদেরকে না জানিয়ে জাতীয় পার্টির সম্মেলনের ডাক দেন রওশন এরশাদ। এরপর দলের গঠনতন্ত্রবিরোধী কাজের জন্য জাতীয় সংসদে বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে রওশনকে সরানোর জন্য ওই বছরের ১ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকারের কাছে চিঠি দেয় দলটির সংসদ সদস্যরা। সেই সময় (১৭ সেপ্টেম্বর) রওশন এরশাদের পক্ষ নেওয়া অ্যাডভোকেট জিয়াউল হক মৃধাকেও জাতীয় পার্টি থেকে বহিষ্কার করেন জিএম কাদের। এরপর গত বছরের ৪ অক্টোবর পার্টির চেয়ারম্যান হিসেবে জিএম কাদেরের দায়িত্ব পালনে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে মামলা করেন জিয়াউল হক মৃধা।
জিয়াউল হক মৃধা রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাতে ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘যদিও মামলার বাদী আমি, কিন্তু হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, সে বিষয়ে আলোচনা করব আমরা। ম্যাডাম রওশন এরশাদের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে আপিল করব কি না।’
তিনি আরও বলেন, রওশন এরশাদ জাতীয় পার্টির সম্মেলন উপলক্ষে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করেছিলেন। সেই কমিটি এখনও আছে। কমিটির সদস্যরা আগামী কয়েক দিনের মধ্যে বৈঠকে বসে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। এরপর ম্যাডাম যে সিদ্ধান্ত দেবেন, সেটাই চূড়ান্ত হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে মৃধা বলেন, আমরা এমনিতে আপিলের জন্য প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। এখন করব কি, করব না— সেটা ঠিক করতে আরও ৪-৫ দিন সময় লাগবে।
রওশন এরশাদের সম্মেলন প্রস্তুতি কমিটিতে ছিলেন জাতীয় পার্টি থেকে অব্যাহতি পাওয়া সংসদের বিরোধীদলীয় চিপ হুইপ মসিউর রহমান রাঙ্গা। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, আজ রায়ের পর জিয়াউল হক মৃধা সাহেব আমাকে ফোন করেছিলেন, আপিল করবেন কি না, জানতে। আমি উনাকে বলেছি, সেটা আপনার ওপর নির্ভর করছে। আমি এ বিষয়ে কিছু বলব না। আপনার যা ইচ্ছা করতে পারেন।
রাঙ্গা বলেন, জাতীয় পার্টিতে বিভেদ তৈরি হয়েছিল রওশন এরশাদকে সংসদের বিরোধীদলীয় নেতার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে। সেই চিঠি আমি দিয়েছিলাম। এখন তো জিএম কাদের ও রওশন এরশাদের মধ্যে সমঝোতা হয়ে গেছে। তাহলে আমি কেন পার্টির বাইরে থাকব?
তিনি আরও বলেন, রওশন এরশাদ ও জিএম কাদেরের মধ্যে সমঝোতার শর্ত ছিল, যাদের দল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল তাদের ফিরিয়ে আনা। এত দিন তাদের দলে ফিরিয়ে আনার সাইনিং অথরিটি (চেয়ারম্যানের ক্ষমতা) জিএম কাদেরের ছিল না। আজ আদালতের রায়ের মাধ্যমে তিনি সেই ক্ষমতা পেয়েছেন। এখন সবাইকে তিনি দলে ফিরিয়ে আনবেন।
‘আমি মনে করি জিএম কাদেরও সেটা চান। তিনি পার্টিকে ঐক্যবদ্ধ দেখতে চান। ফলে আপিল নয়, সমঝোতার দিকেই যাবেন তারা।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে রওশন এরশাদপন্থি এক নেতা বলেন, সামনে সংসদ নির্বাচন। ফলে, রায়ের বিরুদ্ধে আপিল না করলেও এ মামলা এখনই নিষ্পত্তি হবে না। কারণ, যখন জিএম কাদের ‘তৃতীয় পক্ষের’ বিরুদ্ধে চলে যাবেন, তখন রওশন এরশাদের ইশারায় এ মামলা আবারও জেগে উঠবে। এমন একটি হত্যা মামলা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছিল।
তবে, বহিষ্কৃতদের দলে ফিরিয়ে নেওয়ার সমঝোতার বিষয়টি উড়িয়ে দিয়েছেন জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য ও বহিষ্কৃত জিয়াউল হক মৃধার মেয়ের জামাতা রেজাউল ইসলাম ভূঁইয়া। তিনি ঢাকা পোস্টকে বলেন, সমঝোতার কোনো কারণ নেই। সমঝোতা হলে যখন মামলা হয়েছে তখনই হয়ে যেত। একটি মার্ডার মামলাও এত দূর যায় না, এটা যত দূর গেছে। আমরা আইনিভাবে লড়াই চালিয়ে যাব।
তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক দল চলে দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। আদালতের হস্তক্ষেপে রাজনীতি চলতে পারে না। এটা চলতে থাকলে..., আজ জাতীয় পার্টির বিরুদ্ধে হয়েছে, কাল বিএনপির বিরুদ্ধে হবে, পরশু আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও কেউ মামলা করবে। এভাবে তো রাজনীতি চলে না। বিএনপি উকিল আব্দুস সাত্তারকে বহিষ্কার করেছে। তারা কি কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং করে এটা করেছে? করেনি। চেয়ারম্যানের ক্ষমতাবলে করেছে।
‘ঠিক সেভাবে আওয়ামী লীগও গাজীপুরের মেয়র জাহাঙ্গীর, পঙ্কজ দেবনাথকেও অব্যাহতি দিয়েছে। তাহলে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান কাউকে অব্যাহতি দিলে দোষ কোথায়?’
হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে যাওয়ার কোনো যৌক্তিকতা নেই— মনে করেন রেজাউল ইসলাম। বলেন, ‘আমরা আশা করি অন্তত সর্বোচ্চ আদালতের সম্মানের কথা চিন্তা করে হলেও আপিল বিভাগ তা গ্রহণ করবেন না।’
এদিকে, হাইকোর্টের রায়ের পর রোববার (৫ ফেব্রুয়ারি) রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নেন জিএম কাদের। এত দিন বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিলেও আদালতের নিষেধাজ্ঞার কারণে রাজনৈতিক কোনো বক্তব্য দেননি।
হাইকোর্টের রায়ের পর তাৎক্ষণিক এক প্রতিক্রিয়ায় জিএম কাদের ঢাকা পোস্টকে বলেন, ‘আদেশ এখনও হাতে পাইনি। অপেক্ষায় আছি। পরবর্তী সময়ে এ রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়া যাবে কি না, সেটাও জানি না। এত দিন কীভাবে এ মামলা চলল, সেটাও জানি না। কারণ, এটা তো কোনো লজিক্যাল জিনিস ছিল না। তারপরও যেহেতু আদালতের বিষয়, তাই আমি কোনো মন্তব্য করতে চাই না।’
এএইচআর/এসএম/এমএআর/