সরকারবিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে বিএনপির দেওয়া ১০ দফা খসড়া প্রস্তাবের মধ্যে একটি বাদে বাকিগুলো নিয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে গণতন্ত্র মঞ্চের শরিকরা।

জোটের শরিকরা বলছেন, সর্বশেষ গত ১৫ নভেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে বিএনপির বৈঠকে হয়। সেই বৈঠকে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে বিএনপির পক্ষ থেকে ১০ দফা খসড়া প্রস্তাব দেওয়া হয়। সেগুলোর মধ্যে একটি বাদে অন্য নয়টি নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই।

জানা গেছে, ১০ দফার সঙ্গে মঞ্চের পক্ষ থেকে আরও পাঁচ/ছয়টি দফা যুক্ত করে বিএনপির কাছে পাঠানো হবে। সেই দফাগুলো নিয়ে আগামী ৭ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির সঙ্গে আবারও বৈঠক হবে। সেখানে যুগপৎ আন্দোলনের ভিত্তি চূড়ান্ত করে ডিসেম্বরের যেকোনো দিন আনুষ্ঠানিভাবে ঘোষণা দেওয়া হবে।

গণতন্ত্র মঞ্চ সূত্রে জানা গেছে, বিএনপির দেওয়া ১০ দফা প্রস্তাব নিয়ে সোমবার (৫ ডিসেম্বর) তৃতীয়বারের মতো বৈঠকে বসেন মঞ্চের শীর্ষ নেতারা। সেখানে বিএনপির ১০ দফা প্রস্তাবের মধ্যে নয়টি নিয়ে তেমন কোনো আপত্তি তোলেনি শরিকরা। তবে, বিএনপির দ্বিতীয় দফা ‘১৯৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন’ নিয়ে গণতন্ত্র মঞ্চের আপত্তি রয়েছে। কারণ, ৯৬ সালে গঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা নিয়ে অনেক সমালোচনা আছে।

সভায় বক্তব্য রাখেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহীদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, গণঅধিকার পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক মুহম্মদ রাশেদ খান প্রমুখ।

গণতন্ত্র মঞ্চের প্রস্তাব হচ্ছে- তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তীকালীন বা তদারকি সরকার, যেই নামে হোক না কেন এটার রূপরেখা এখনই ঠিক না করে ওপেন রাখা। কারণ, যুগপৎ আন্দোলনে যদি সরকার পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়, তাহলে আন্দোলনে যুক্ত শরিকদের সঙ্গে আলোচনা করে এ সরকারের রূপরেখা চূড়ান্ত করাই হবে উপযুক্ত পদ্ধতি। ফলে পরবর্তী সময়ে কোনো বির্তকের সৃষ্টি হবে না। এছাড়া মঞ্চের ‘রাষ্ট্র সংস্কার রূপরেখা’ নামের একটি প্রস্তাব ১০ দফার সঙ্গে যুক্ত থাকবে। সেখানে সংবিধানের বেশকিছু ধারা সংশোধনের বিষয়ে বিস্তারিত থাকবে।

আগামীকাল মঙ্গলবার আনুষ্ঠানিকভাবে বিএনপির কাছে এটি দেওয়া হবে। ৭ ডিসেম্বর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমরা তো একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। এখন ৭ তারিখ (ডিসেম্বর) তাদের (বিএনপির) সঙ্গে আলোচনা করব। তারপর ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারলে সেখানে এমন হতে পারে যে একটি প্রোগ্রামের মাধ্যমে মুভমেন্ট শুরু করব। সেখানে যেমন রাজনৈতিক কর্মসূচি থাকবে, তেমনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার সংস্কারের বিষয়টিও থাকবে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণতন্ত্র মঞ্চের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, ৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের কার্যবিধির একটা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। শুধু নির্বাচনের ব্যবস্থা করাই তাদের কাজ ছিল। তারা চাইলেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া, আইন-বিচার ব্যবস্থার কোনো সংস্কার করতে পারত না। ফলে বর্তমানে দেশের যে অর্থনৈতিক দুরাবস্থা তাতে সরকারের পদত্যাগের পরে নির্বাচনকালীন যে সরকার গঠন করা হবে, তারা চাইলেও সেই সময় শুধু নির্বাচনের ব্যবস্থা করলে হবে না। কারণ, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করতে হলে পেশিশক্তি ও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়াসহ যা যা করা দরকার তাই করতে হবে। তা না হলে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের কথা বলা হলো কিন্তু পেশিশক্তি ও টাকা দিয়ে ভোট কিনে নেওয়া হলো— এটা তো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হলো না। তাই আমাদের প্রস্তাব থাকবে, তাদের যা যা করার দরকার তাই করবে। তবে, সেক্ষেত্রে নির্বাচনকালীন সরকারের মেয়াদের একটা নির্দিষ্ট সময় থাকবে।

তিনি আরও বলেন, বিএনপির প্রস্তাবিত ‘৯৬ সালে সংবিধানে সংযোজিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা’ নিয়ে আমাদের কিছুটা আপত্তি আছে ঠিক। তবে, সেটা নিয়ে আমাদের এমন কোনো দাবি বা আপত্তি থাকবে না, যার কারণে যুগপৎ আন্দোলনের যে প্রক্রিয়া চলছে সেটা নষ্ট না হয়। আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা হচ্ছে ছাড় দিয়ে হলেও এই যুগপৎ আন্দোলনের প্রক্রিয়া চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। সেখানে সবাইকে নিয়ে মাঠের আন্দোলনে নেমে পড়া।

গণতন্ত্র মঞ্চের একটি শরিক দলের শীর্ষ নেতা ঢাকা পোস্টকে বলেন, যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দ্রুততম সময়ে দেওয়ার তাগাদা রয়েছে বিএনপির পক্ষ থেকে। তারা চাইছে, ১০ ডিসেম্বরের আগেই যুগপৎ আন্দোলনের রূপরেখা বা ভিত্তির ঘোষণা দিতে। যাতে ১০ ডিসেম্বরের পরের কর্মসূচিগুলোতে সবাই মাঠে নামতে পারে।

গণতন্ত্র মঞ্চের একটি সূত্রে জানা গেছে, ৭ ডিসেম্বর বিএনপির সঙ্গে বৈঠকের পর ৮ ডিসেম্বর গণতন্ত্র মঞ্চের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলন করা হবে। সেদিন হয়তো মঞ্চের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা আসবে। বিএনপিও তাদের পক্ষ থেকে সংবাদ সম্মেলনে যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা দিতে পারে। সবকিছু ৭ তারিখের (ডিসেম্বর) বৈঠকে ঠিক করা হবে। আসলে কোন প্রক্রিয়ায় যুগপৎ আন্দোলনের ঘোষণা আসবে। এছাড়া ওই দিনের বৈঠকে বিএনপির ১০ ডিসেম্বরের সমাবেশের পরিকল্পনা বা কর্মকৌশল কী হবে, সেটাও জানতে চাইব আমরা।

এ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ঢাকা পোস্টকে বলেন, আমি মাত্র শুনেছি ৭ তারিখ (ডিসেম্বর) গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে আমাদের বৈঠক। ফলে, ওই দিনের বৈঠকে কী হবে তা নিয়ে এ মুহূর্তে মন্তব্য করা ঠিক হবে না।

প্রসঙ্গত, বিএনপির যুগপৎ গণআন্দোলনের ১০ দফার খসড়ায় সংসদ বিলুপ্ত করে বর্তমান সরকারের পদত্যাগ, ১৯৯৬ সালের সংবিধানে সংযোজিত ধারা ৫৮-খ, গ ও ঘ-এর আলোকে দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন বা অন্তর্বর্তীকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠন, বর্তমান কমিশন বিলুপ্ত করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ নির্বাচন কমিশন গঠন, খালেদা জিয়াসহ সব বিরোধী দলের নেতাকর্মী, সাংবাদিক ও আলেমদের সাজা বাতিল এবং মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের পাশাপাশি নতুন মামলায় গ্রেপ্তার বন্ধ ও সভা-সমাবেশে বাধা সৃষ্টি না করা, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন- ২০১৮ ও বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪-সহ মৌলিক মানবাধিকার হরণকারী সব কালাকানুন বাতিলসহ ১০টি প্রস্তাব রয়েছে।

এএইচআর/এসএম