ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বে কারা আসছেন?
আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের ৩০তম জাতীয় সম্মেলন আগামী ৬ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। সম্মেলন ঘিরে নেতাকর্মীদের মাঝে প্রাণচাঞ্চল্য বিরাজ করছে। উচ্ছ্বাস, উদ্দীপনাও দেখা যাচ্ছে অনেক বেশি।
সংগঠনের দুই শীর্ষ পদে কারা আসছেন তা নিয়ে প্রতিবারের মতো এবারও চলছে নানা আলোচনা। সম্মেলন যত কাছে আসছে তত লবিং-তদবির বাড়ছে পদপ্রত্যাশী নেতাকর্মীদের। পদপ্রত্যাশীরা রাজনীতির আঁতুড়ঘর-খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে নিয়মিত উপস্থিত হচ্ছেন এবং আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় ও ধানমন্ডি কার্যালয়ে যাওয়া-আসা করছেন। পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে কথা বলে নিজেদের তুলে ধরার চেষ্টা করছেন।
বিজ্ঞাপন
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে তাদের সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। পরে তাদের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেওয়া হয়।
আরও পড়ুন : ১০ বছরেও অনার্সের গণ্ডি পার হতে পারেননি ছাত্রলীগ নেত্রী তিলোত্তমা
আওয়ামী লীগের দায়িত্বশীল একটি সূত্র ঢাকা পোস্টকে জানিয়েছে, যারা ত্যাগী এবং বিভিন্ন সময় শিক্ষার্থী ও দেশের মানুষের জন্য কাজ করেছেন তাদেরকেই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হবে ছাত্রলীগের কমিটিতে। এছাড়া শিক্ষার্থীদের মধ্যে জনপ্রিয়তা, আন্দোলন-সংগ্রামে সক্রিয়তা, সাংগঠনিক দক্ষতা ও অবদান, কোটা সংস্কার আন্দোলনে ভূমিকা এবং পরিবারের রাজনৈতিক মতাদর্শও গুরুত্ব পাবে। ছাত্রদল বা শিবিরের সম্পৃক্ততা কিংবা বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ থাকলে তারা কমিটিতে আসবে না।
গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ছাত্রলীগের বয়সসীমা অনূর্ধ্ব ২৭ বছর। অর্থাৎ ২৭ বছরের বেশি বয়সীরা ছাত্রলীগের কমিটিতে থাকতে পারবেন না। বিগত তিন কমিটির সম্মেলনে প্রার্থীদের বয়স অনূর্ধ্ব ২৯ বছর করা হয়। এবার কত বছর সীমা থাকবে তা প্রধানমন্ত্রীর উপর নির্ভর করছে। ৬ ডিসেম্বর প্রধান অতিথি হিসেবে সম্মেলনের উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী। সেখানেই তিনি প্রার্থীদের বয়সের বিষয়টি নিশ্চিত করবেন বলে ছাত্রলীগ সূত্রে জানা গেছে।
কমিটিতে আঞ্চলিক প্রাধান্য কি এবারও থাকবে?
বিগত কয়েকটি কমিটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাদারীপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। এবারও ওইসব অঞ্চল থেকে বেশি পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে, শীর্ষ নেতৃত্ব তথা সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচনে যোগ্যতা বিবেচনায় অন্য অঞ্চলের প্রার্থীদেরও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এবারের সম্মেলনে শীর্ষ দুই পদে নেতৃত্ব পাওয়ার দৌড়ে চট্টগ্রাম অঞ্চল থেকে এগিয়ে রয়েছেন করোনা মহামারির সময় থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবার উদ্যোক্তা ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক সাদ বিন কাদের চৌধুরী, করোনার সময় কঠোর লকডাউনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে অসহায়দের মাঝে খাবার বিতরণ করে জাতিসংঘের ‘রিয়েল লাইফ হিরো’ ভূষিত উপ-সমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত, যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক তাহসান আহমেদ রাসেল, সহ-সভাপতি মাহমুদুল হাসান তুষার, সহ-সম্পাদক দিদারুল আলম ও আনফাল সরকার পমন।
আরও পড়ুন : প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ জয়-লেখক!
বরিশাল অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন বর্তমান কমিটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ, সৈয়দ আরিফ হোসেন, তিলোত্তমা শিকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), উপ-বিজ্ঞান সম্পাদক সবুর খান কলিন্স, কর্মসংস্থান বিষয়ক উপ-সম্পাদক খাদিমুল বাশার জয়, গণশিক্ষা বিষয়ক উপ সম্পাদক সোলাইমান ইসলাম মুন্না এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সম্পাদক ইমরান জমাদ্দার।
ফরিদপুর অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন সহ-সভাপতি রাকিব হোসেন, আইন বিষয়ক সম্পাদক ফুয়াদ হোসেন শাহাদাত, কর্মসংস্থান সম্পাদক রনি মুহাম্মদ, উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক মেশকাত হোসেন।
উত্তরবঙ্গ থেকে আলোচনায় রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন, প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হায়দার মোহাম্মদ জিতু।
ঢাকা অঞ্চলের প্রার্থীদের মধ্যে গণযোগাযোগ ও উন্নয়ন বিষয়ক সম্পাদক শামীম শেখ তুর্জ, উপ তথ্য ও প্রযুক্তি বিষয়ক সম্পাদক এহসান উল্লাহ পিয়াল এবং সিলেট অঞ্চল থেকে আল আমিন রহমান আলোচনায় রয়েছেন।
খুলনা বিভাগ থেকে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক বরিকুল ইসলাম বাঁধন, মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক নাহিদ হাসান শাহিন এবং উপবিজ্ঞান বিষয়ক সম্পাদক খন্দকার আহসান হাবিব আলোচনায় আছেন।
আরও পড়ুন : দুধ দিয়ে গোসল করে রাজনীতির ইতি টানলেন ছাত্রলীগ নেতা
ময়মনসিংহ থেকে আলোচনায় আছেন সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক সম্পাদক মেহেদী হাসান তাপস, উপ-প্রচার সম্পাদক সুরাপ মিয়া সোহাগ, তথ্য প্রযুক্তি বিষয়ক উপসম্পাদক রাশিদ শাহরিয়ার উদয় এবং স্কুল ছাত্র বিষয়ক উপ-সম্পাদক শাকের আহমেদ আল আমিন।
শীর্ষ নেতৃত্বের বিষয়ে বর্তমান কমিটির নেতারা কে কী ভাবছেন?
জানতে চাইলে ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ ঢাকা পোস্টকে বলেন, আশা করি প্রধানমন্ত্রীর হাত ধরে আগামীতে এমন দূরদর্শী নেতৃত্ব বের হয়ে আসবে যারা ছাত্রলীগকে তৃণমূল থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত ঢেলে সাজাবে। বর্তমান নেতৃত্বের গঠনতন্ত্র বহির্ভূত ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ড থেকে শিক্ষা নিয়ে ছাত্রলীগকে শক্তিশালী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলবে। আগামীতে যেহেতু জাতীয় নির্বাচন এবং আমরা যেহেতু আওয়ামী লীগের ভ্রাতৃপ্রতিম সংগঠন সে জায়গা থেকে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে আনতে সর্বোচ্চ ভূমিকা রাখবে এমন নেতৃত্ব পাবে ছাত্রলীগ।
আরেক সহ-সভাপতি তিলোত্তমা শিকদার বলেন, মেয়েরা যদি যোগ্য থাকে, আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী অবশ্যই সেটি বিবেচনা করবেন। সে যোগ্যতার ভিত্তিতে নেতৃত্বে সমতা আসা উচিত। যে যোগ্য সে ছেলে হোক আর মেয়ে হোক লিঙ্গ বৈষম্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে তার মূল্যায়ন হওয়া উচিত। বর্তমান ছাত্রলীগ সে পরিবেশ নিশ্চিত করেছে। একজন নারী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক হতে পারবে। আমি নারী হয়েও সকাল সাতটায় ফুল দিতে যাচ্ছি আবার কক্সবাজার, বান্দরবান সম্মেলনে যাচ্ছি। আমার যেহেতু কাজের ক্ষেত্রে কোনো প্রতিবন্ধকতা নেই, পদবির ক্ষেত্রেও প্রতিবন্ধকতা থাকা ঠিক নয়।
ঢাবি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ছাত্রলীগ বাংলাদেশের ইতিহাসের নীতিনির্ধারক। সময়ের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সবচেয়ে পারদর্শী সংগঠন ছাত্রলীগ। সে জায়গা থেকে আমাদের দেশের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে, ছাত্র সমাজের প্রতি দায়বদ্ধতা রয়েছে। আমরা চাই, যারা দক্ষতার সঙ্গে রাজনীতি করতে পারবে, মেধাভিত্তিক রাজনীতির চর্চা করতে পারবে এবং খুনি সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে ছাত্র সমাজকে ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন সংগ্রাম করতে পারবে, বিশেষ করে আগামীতে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ক্যাম্পেইন রয়েছে, সেখানে যারা তরুণ প্রজন্মকে সাথে নিয়ে দেশরত্ন শেখ হাসিনার বিজয় নিশ্চিত করতে পারবে আমি মনে করি তাদের মধ্য থেকে নেতৃত্ব আসবে।
বরিশাল অঞ্চল থেকে আলোচনায় আছেন বর্তমান কমিটির কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি ইয়াজ আল রিয়াদ, সৈয়দ আরিফ হোসেন, তিলোত্তমা শিকদার, সাংগঠনিক সম্পাদক শেখ ওয়ালী আসিফ (ইনান), উপ-বিজ্ঞান সম্পাদক সবুর খান কলিন্স, কর্মসংস্থান বিষয়ক উপ-সম্পাদক খাদিমুল বাশার জয়, গণশিক্ষা বিষয়ক উপ সম্পাদক সোলাইমান ইসলাম মুন্না এবং ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সম্পাদক ইমরান জমাদ্দার।
ছাত্রলীগের দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক ঢাকা পোস্টকে বলেন, ভদ্র মার্জিত, ভালো সংগঠক, ছাত্র সমাজের কাছে গ্রহণযোগ্য এবং নেতৃত্বের গুণাবলী আছে এমন নেতাদের মধ্য থেকেই সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হবে। এটা ছাত্রলীগের কাউন্সিলররাই নির্ধারণ করবে। বিতর্কিতদের নেতৃত্বে আসার সুযোগ নেই। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। বয়সের বিষয়টিও (২৭/২৯) প্রধানমন্ত্রী সিদ্ধান্ত নেবেন।
বিগত কয়েকটি কমিটির ক্ষেত্রে দেখা যায়, মাদারীপুর, বরিশাল ও খুলনা অঞ্চল প্রাধান্য পেয়েছে। এবারও ওইসব অঞ্চল থেকে বেশি পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। তবে, শীর্ষ নেতৃত্ব তথা সভাপতি-সম্পাদক নির্বাচনে যোগ্যতা বিবেচনায় অন্য অঞ্চলের প্রার্থীদেরও বিবেচনায় নেওয়া হবে।
ছাত্রলীগের ২৯তম জাতীয় সম্মেলনের পর ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক পদে রেজওয়ানুল হক চৌধুরী শোভন ও গোলাম রাব্বানীকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। কিন্তু পূর্ণ মেয়াদ শেষ করার আগেই আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তাদের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। এরপর সংগঠনটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান যথাক্রমে আল নাহিয়ান খান জয় ও লেখক ভট্টাচার্য। তিন মাস ভারপ্রাপ্ত থাকার পর ছাত্রলীগের ৭২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অনুষ্ঠানে তাদের পূর্ণাঙ্গ দায়িত্ব দেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ছাত্রলীগের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের মেয়াদ দুই বছর। মেয়াদকালের মধ্যে সম্মেলন আয়োজন করার নিয়ম থাকলেও তা করতে পারেননি জয়-লেখক। গত ২১ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিনে এক সংবাদ সম্মেলনে ৮ ও ৯ ডিসেম্বর সম্মেলনের ঘোষণা দেন ছাত্রলীগ সভাপতি। তবে সেই তারিখে হচ্ছে না সম্মেলন। ৬ ডিসেম্বর সম্মেলনের চূড়ান্ত তারিখ ঘোষণা করেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।
এইচআর/জেএস