আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানক ও সাংগঠনিক সম্পাদক মো. মির্জা আজমের সঙ্গে ফজলুল হক আতিক (মাঝে)।

মো. ফজলুল হক আতিক। একসময়ে ছিলেন নরসিংদীর পলাশপুর উপজেলা ছাত্রলীগের প্রকাশনা সম্পাদক। পদোন্নতি পেয়ে হন সাংগঠনিক সম্পাদক, তারপর উপজেলা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক। 

এখানেই থেমে থাকেননি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা শেষে করে অবিভক্ত ঢাকা যুবলীগের আহ্বায়ক কমিটির সদস্য, তারপর দক্ষিণ যুবলীগের দপ্তর সম্পাদকের পদে দীর্ঘ ৮ বছরের পরিশ্রমের পর কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক হন। সেখান থেকে আরেক ধাপ এগিয়ে সর্বশেষ সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তবে এখন তার আর রাজনৈতিক কোনো পদ নেই। এক সময়ের সক্রিয় এই নেতা এখন রাজনীতিতে একেবারেই নিষ্ক্রীয়। 

রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে ৫৬ বছর বয়সে এসে আবার শুরু করেছেন লেখাপড়া। বর্তমানে তিনি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতায় মাস্টার্স করছেন। চলতি মাসেই তিনি দ্বিতীয় সেমিস্টারের ফাইনাল পরীক্ষা দেবেন। 

অতীতের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বর্তমান পরিস্থিতি আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা নিয়ে ঢাকা পোস্টের মুখোমুখি হয়েছেন তিনি। আলাপচারিতায় উঠে এসেছে তার রাজনৈতিক জীবনের উত্থান-পতনের নানা চিত্র।   

আওয়ামী যুবলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ফজলুল হক আতিক বলেন, ১৯৮১ সাল থেকে আমি ছাত্রলীগ করি। আমার বাড়ি নরসিংদী পলাশ উপজেলায়। ’৮১ সালে পলাশ থানা ছাত্রলীগ শাখার প্রকাশনা সম্পাদক, ’৮৩ সালে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক এবং ’৮৬ সালে ভোটের মাধ্যমে আমি ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ছিলাম। ১৯৯১ সালের পরে আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলাম। আমি ছাত্র রাজনীতি শেষ করে যুবলীগের রাজনীতি শুরু করি। দক্ষিণ যুবলীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি দীর্ঘ আট বছর। পরবর্তী সময়ে ২০০৩ সালে যুবলীগের ৫ম কংগ্রেসে নানক-আজম কমিটির দপ্তর সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করি।  

আরও পড়ুন : যুবলীগ : শেখ মনি থেকে শেখ পরশ

যুবলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, ২০০১ সালে বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার ফলে বাংলাদেশে যে ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়, সে সময় যুবলীগ থেকে যে কর্মসূচি দেওয়া হতো তা বাস্তবায়ন, সেই কর্মসূচির ফোকাস, পুরা দায়িত্বটাই আমি পালন করেছি। ২০০৬ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন আন্দোলন, সংগ্রাম, হরতাল, অবরোধ, প্রতিদিনই বিভিন্ন কর্মসূচি থাকতো। ২০০১ সালে বিএনপি ১০০ দিনের কর্মসূচি পালন করে। এই কর্মসূচিই ছিল আওয়ামী লীগের ভোটার, কর্মী, নেতা সমর্থকদের ওপরে নির্যাতন। তাদের বাড়ি-ঘরে অগ্নি সংযোগ। এসব ঘটনা প্রতিনিয়ত ঘটত। ২০০২-০৩ সালে বাংলাদেশের বড় বড় রাজনীতিবিদদের হত্যা করা হয়। দেশ তখন সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত হয়। সে সময় আওয়ামী লীগ কোনো কর্মসূচি করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের দুই পাশে কাঁটা তারের বেড়া ছিল। একের বেশি লোক পার্টি অফিসে ঢুকলেই পুলিশ গ্রেপ্তার করত, এটা ছিল প্রকাশ্যে। দলীয় কোনো কর্মসূচি পালন করা যেত না। ২০০৩ সালে অ্যাডভোকেট জাহাঙ্গীর কবির নানক চেয়ারম্যান এবং মির্জা আজম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেওয়ার পর তাদের নেতৃত্বে প্রথম বিএনপি-জামায়াতের বিরুদ্ধে কর্মসূচি নেওয়া হয়। ২০০৬ সাল পর্যন্ত প্রতিনিয়ত যুবলীগের কর্মসূচি ছিল। 

রাজনীতিকে বিদায় জানিয়ে ৫৬ বছর বয়সে এসে আবার শুরু করেছেন লেখাপড়া; মাস্টার্স করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে

তিনি আরও বলেন, পরবর্তীতে ফখরুদ্দিনের নেতৃত্বে তত্বাবধায়ক সরকার আমলেও আমাদের আন্দোলন শুরু হয়। তখন বিএনপি-জামায়াত সরকার তত্বাবধায়ক সরকারের প্যাটার্ন পরিবর্তন করলে ইয়াজ উদ্দিনের নেতৃত্বে সেনা সমর্থিত একটা সরকার আসে। সে সময় সংগঠনের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক আত্মগোপনে চলে যান। কিন্তু আত্মগোপনে গেলেও তারা সংগঠন পরিচালনা করেছিলেন। ১/১১ তে যখন মাইনাস-২ ফর্মুলা নিয়ে সেনা সমর্থিত সরকার কাজ করে, তখন আওয়ামী লীগের পাশাপাশি যুবলীগের মধ্যেও কিছু ঘটনা ঘটেছে।  

তিনি আরও বলেন, নেত্রীর গ্রেপ্তারে মুক্তির আন্দোলন, ১/১১ সেনা সমর্থিতদের বিরুদ্ধে অবস্থান, গণতন্ত্রের পুনরুদ্ধার, এসব কর্মসূচির মধ্যে ছিলাম। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ের বৈদ্যুতিক লাইন কেটে দেওয়া হয়। আমরা তখন মোমবাতি জ্বালিয়ে কর্মসূচি পালন করেছি। সেই সময়ের বিভিন্ন কর্মসূচি আমি হাতে লিখে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় দিয়ে আসতাম। ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এইগুলো ফলো করে আমাদের প্রোগ্রামগুলো ফোকাস করত। পরবর্তীতে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটা রাজনৈতিক সরকার আসে।

৩৮ বছরে সংগঠনে কোনো ফাঁকিবাজির রাজনীতি করিনি উল্লেখ করে ফজলুল হক আতিক বলেন, ২০০৩ সাল থেকে ২০১২ পর্যন্ত আমি যুবলীগের দপ্তর সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করি। অমানবিক পরিশ্রম করেছি, আমি মিছিল করেছি, মিটিং করেছি, সভা করেছি, প্রেস রিলিজ তৈরি করেছি, বিভিন্ন গণমাধ্যমে পাঠিয়েছি। এ কাজগুলো মূলত আমাকেই প্রতিদিন করতে হতো। এটা একটা সংগঠনের মুখপাত্রের দায়িত্ব হয়। আমার এই বিষয়গুলো সম্পর্কে তৎকালীন নেতারা অবগত আছেন। ২০১২ সালে যুবলীগের ৬ষ্ঠ কংগ্রেসে ওমর ফারুক চৌধুরী চেয়ারম্যান এবং হারুনুর রশিদ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তখন আমাকে সিলেট বিভাগের দায়িত্ব দেওয়া হয়, আমি সিলেট বিভাগের সব জেলার সম্মেলন করতে সক্ষম হয়েছি। ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর যুবলীগের সপ্তম কংগ্রেসে আমার ওপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি। অজ্ঞাত কারণে পরবর্তী কমিটিতে আমাকে রাখা হয়নি। আমার মতো আরও যারা দীর্ঘ সময় যুবলীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন, আমরা দেখলাম আমাদের রাখা হয়নি। আমি প্রায় ৩৮ বছর ছাত্রলীগ করে যুবলীগ করছি। ৩৮ বছরে সংগঠনে কোনো ফাঁকিবাজির রাজনীতি করিনি। এখন আমাদের পরিচয় নেই। রাজনীতিতে আমাদের কোনো স্কোপ নাই।’ 

আরও পড়ুন : ৫০-এ পা রাখল যুবলীগ 

যুবলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, বর্তমানে আমি লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেছি। আমি এখন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে গণসংযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে মাস্টার্স করছি। এখন আমার দ্বিতীয় সেমিস্টারের পরীক্ষা দেব। রাজনীতি এখন আমাদের নেই। এখন পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত রয়েছি। আমি বঙ্গবন্ধু এবং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে পরিচালিত, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের একজন সৈনিক হিসেবে শেখ হাসিনার যে কোনো কর্মকাণ্ডে আমার জীবন উৎসর্গ করতে প্রস্তুত। অতীতেও করেছি, ভবিষ্যতেও করব।  

এক সময় সক্রিয় ছিলেন রাজপথের রাজনীতিতে

তিনি আরও বলেন, আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি ইতিহাসে গ্রাজুয়েশন শেষ করেছি আগে। আমি মনে-প্রাণে পড়াশোনা নিয়েই ব্যস্ত। কর্মক্ষেত্রে আমি আগে ঠিকাদারী পেশার সাথে যুক্ত ছিলাম। এই মুহূর্তে আমার একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা আছে।

ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, আজ দীর্ঘ ১৩ বছর ক্ষমতায় আওয়ামী লীগ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে। আমি দুই সন্তানের জনক। আমার বড় মেয়ের বিয়ে দিয়েছি, ছোট মেয়ে আইইউবিতে শেষ বর্ষে পড়ছে। আমার স্ত্রী চাকরি করেন। আমরা চাই দেশটা শান্তিতে থাকুক। দেশটা অসাম্প্রদায়িক হোক। আজ দলের মধ্যে অর্থ ছাড়া ঢোকা যায় না। এই অভিযোগ খোদ দলের সাধারণ সম্পাদক করেছেন। হেফাজতের আন্দোলন, তার আগে বিডিআর বিদ্রোহ হয়েছে। ওই সময় সাধারণ মানুষ হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেনি। এটা একটা পরিকল্পিত ঘটনা ছিল। সরকার উৎখাতের একটা বড় ধরনের ষড়যন্ত্র ছিল। সেদিন আমরাই যুবলীগরা পিলখানার সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম। বহুবার পুলিশের নির্যাতনে শিকার হয়েছি। বিএনপির বিভিন্ন মামলায় জড়িয়েছি। দুঃসময়ের কর্মী কে তা আজকের এই কমিটির জন্য বিবেচ্য বিষয় না।

যুবলীগের সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠান প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমি দীর্ঘ সময় যুবলীগ করেছি। আমার প্রাণ প্রিয় সংগঠন যুবলীগ। যুবলীগের দুঃসময়ে চেয়ারম্যান মনি ভাইয়ের ছবি পাওয়া যেত না। আমি বাংলার বাণী থেকে ছবি নিয়ে আসতাম। আজকে ক্ষমতা আছি, এখন বিভিন্ন কালারের ছবি পাওয়া যায়। নেত্রী প্রধান অতিথি হিসেবে থাকবেন, আমরা দূর থেকে দেখব। 

যুবলীগের সাবেক এই দপ্তর সম্পাদক বলেন, তিনবারের বেশি সময় ধরে যারা এমপি হিসেবে আছেন তাদের একচ্ছত্র আধিপত্য সৃষ্টি হয়েছে। দলে যারা ত্যাগী ও দুর্দিনের কাণ্ডারি হিসেবে ছিলেন তারা আজ উপেক্ষিত। এ পর্যন্ত রাজনৈতিক অনুষ্ঠান কিংবা সম্মেলনে এমপিদের পছন্দ অনুযায়ী কমিটি হয়েছে। এসব কমিটিতে এমপির আত্মীয়-স্বজন, গুন্ডা-পান্ডাদের পদ দেওয়া হয়েছে।

 তিনি আরও বলেন, আমরা যেটা লক্ষ্য করেছি যে, সংগঠন চালাতে গিয়ে এমপিদের পছদের বাইরে যত ত্যাগী নেতাই হোক কমিটিতে স্থান পায় না। আমরা অসহায়ের মতো অনেক অভিযোগ শুনতে থাকি। দলীয় নেতাকর্মীরা এমপিকে পছন্দ করেন না। তৃণমূলের সাথে আমাদের দূরত্বের কারণে আজ আমাদের এ অবস্থা। আজ আমি যেসব কথা বলছি, এটি বর্তমান জেলা-উপাজেলার রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতি। কিন্তু চাইলেও এসব কথা হাইকমান্ডকে বলা যায় না।’

ছাত্রলীগের সাবেক এই নেতা বলেন, ‘আমার রাজনীতির ক্যারিয়ার প্রায় ৩৮ বছরের। কিন্তু বয়সসীমার কারণে আমাকে কমিটিতে স্থান দেওয়া হয়নি। কিন্তু এ বিষয়গুলো আমাকে আগে জানানো হয়নি। আমি কাজ করেছি কতটুকু এটি আগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা জানেন। আমি ব্যক্তি হিসেবে ভুল করতে পারি কিন্তু কাজের ক্ষেত্রে ফাঁকি দেওয়ার সুযোগ ছিলই না। ’
 
এমএসআই/এনএফ