প্রস্তাবিত ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটকে তদবিরের বাজেট বলে আখ্যায়িত করেছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেছেন, যারা বিভিন্ন ধরনের তদবির করেছেন তাদের জন্য বাজেট ভালো হয়েছে। বাজেটে ট্যারিফের যে কয়েকটি বই আছে সেটিই আসল। অথচ এসব বই এখনো অনেকে পাননি।

শুক্রবার (২৪ জুন) বিকেলে মুভমেন্ট ফর ওয়ার্ল্ড এডুকেশন রাইটস আয়োজিত ‘জাতীয় বাজেট ২০২২-২৩: স্বাস্থ্য ও পরিবেশ বিষয়ক পর্যালোচনা’ শীর্ষক ওয়েবিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্যে  এ কথা বলেন।

ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, শুল্কের ৮টি স্তর করা হয়েছে। এটি তদবির ও বড় লোকের বাজেট। রপ্তানিকারকরা আগে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ কর দিতেন তা এখন শূন্য দশমিক ১ শতাংশ করা হয়েছে, এটি ভালো দিক। বাকি সবখাতে ভুল সিদ্ধান্ত।

পাচার করা অর্থ বৈধতার সুযোগ বিষয়ে প্রবীণ এ চিকিৎসক বলেন, সাড়ে ৭ শতাংশ ট্যাক্স দিয়ে আমার টাকা বিদেশে নিয়ে ব্যবসা করা হচ্ছে। সেই দেশের সরকার যখন প্রশ্ন করেছে এ টাকা কোথায় পেলে? তখন সার্টিফিকেটের জন্য এই কাজ করা হয়েছে।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, সাড়ে ৬ কোটি শ্রমিকের জন্য বাজেটে কিছু নেই। ঈদে তাদের মুখে হাসি ফুটবে না। তাদের সুলভ মূল্যে রেশন দেন। ফ্রি নয় টাকাতেই দেন। শ্রমিকদের সন্তানদের বিনা পয়সায় স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করার সুযোগ করে দেন। তা হলে নোবেল পুরস্কার প্রধানমন্ত্রীর পেছনে ঘুরবে।
 
তিনি বলেন, ওষুধের দাম বাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। ২০ টাকার শ্বাস কষ্টের সিরিঞ্জ ২৭০ টাকা হয়ে গেছে। এখন রুগ্ন মেডিকেল কলেজ তৈরি করা হচ্ছে। নার্সিং, ফিজিওথেরাপির জন্য আলাদা কলেজ। আমলারা একদিকে। আর বাকিরা একদিকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকরা কয়েক জায়গায় খেপ মারেন। অথচ বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অধ্যাপকদের ট্যাক্স ধরেছেন এটা ঠিক না। এটি সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।

ডা. জাফরুল্লাহ বলেন, সরকারকে সামনের দিকে তাকাতে হবে। আগামী ২০ বছর কী হবে তা চিন্তা করতে হবে। তখন মানুষ হবে ২৫ কোটি। সরকারি তথ্যমতে ৪ কোটি মানুষের বয়স ৬০ বছরের ওপরে। বয়স্ক লোকদের সেবা করাবে কে? 

সংগঠনের ফরেস্ট, এনভাইরনমেন্ট, টুরিজম, এনিম্যাল অ্যান্ড ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যাফেয়ার্স সেক্রেটারি রঞ্জিত কুমার বর্মনের সঞ্চালনায় সভাপতির বক্তব্যে স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, পরিবেশ ভালো হয়ে গেলে স্বাস্থ্যখাতে ব্যয় কম হবে। কেননা পরিবেশগত রোগবালাই বেড়ে যাওয়ার কারণে আমরা পানি, বায়ু, খাদ্য, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাতে হুমকির মুখে পড়েছি। এ সমস্যা সমাধানে বর্তমান বাজেট অপ্রতুল বরং আরও কয়েকগুণ বাজেট প্রয়োজন পরিবেশখাতে।

বিশেষ অতিথি উপস্থিত ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ। তিনি বলেন, বর্তমানে বিশ্বে ভ্যাবারেজ ও বিসমার্ক মডেলে স্বাস্থ্যখাত চলছে। ভ্যাবারেজ মডেলটি যুক্তরাজ্যের। এটি জনগণ থেকে সরকার ট্যাক্স নিয়ে জনগণকে স্বাস্থ্যসেবা দেয়। অপরটি বিসমার্ক মডেল। যা জার্মানিতে শুরু হয়। বাংলাদেশে ভ্যাবারেজ মডেলে চলে। আর এখন মূলত বিশ্ব চলে বিসমার্ক মডেলে।

তিনি বলেন, ২০১২ সালের স্বাস্থ্যনীতিমালা যা করা হয়েছে তাতে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যবিষয়ক তেমন কিছু বলা হয়নি। এজন্য যুগোপযোগী একটি নীতিমালা প্রয়োজন।

হেলথ এন্ড হোপ স্পেশালাইজড হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, স্বাস্থ্যসেবাকে চিকিৎসাতে পরিবর্তন করে ফেলা হয়েছে। চিকিৎসাসেবা মূলত রোগের হয়। আর স্বাস্থ্যসেবা মূলত পুরো জাতির সুস্থ মানবিক বিকাশ।

তিনি বলেন, বেসরকারি হাসপাতালে ৬০-৬৫ শতাংশ মানুষ সেবা নেয় কিন্তু তাদের জন্য বাজেটে কিছুই নেই। সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালের অর্থনৈতিক দায়-দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। প্রস্তাবিত বাজেটটি হচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠানের বেতন-ভাতা, সামান্য ওষুধপাতি দিয়ে চালিয়ে নিতে। অথচ ৮০-৮৩ শতাংশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা বাইরে থেকে করা হয়। অর্থাৎ সরকার ইচ্ছা করেই বেসরকারি হাসপাতালের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের বাজেটটি জনবান্ধব স্বাস্থ্যসেবা বাজেট করতে হবে।

ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, প্রস্তাবিত বাজেট শুধু সরকারি হাসপাতালের জন্য করা হয়েছে। প্রতিটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে তামাক, স্বাস্থ্য বিষয়ক প্রতিষ্ঠানের সিএসআরের ৫০ শতাংশ, মোবাইল থেকেসহ বিভিন্ন স্থান থেকে অর্থ নিতে হবে। এসব ২০-২৫ হাজার কোটি টাকা যুক্ত করে স্বাস্থ্য বিমায় প্রিমিয়াম হিসেবে ব্যবহার করা যায়।

বাংলাদেশ হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মাঈনুল হাসান সোহেল বলেন, স্বাস্থ্যখাতে সচিব ও অন্যান্য নীতি-নির্ধারক পর্যায়ে ডাক্তারদের থেকে নিয়োগ দেওয়া দরকার। আর ব্যয়ের দিকে সঠিক পরিকল্পনাও দেখা যায় না।  

ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আবদুর রহমান মাসুম প্রশ্ন রেখে বলেন, স্বাস্থ্যখাত আসলে কার? এ প্রশ্ন আমাদের মনে ঘুরপাক খাচ্ছে। কেননা স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার চেয়ে বিল্ডিং ও অবকাঠামো নির্মাণ ও টেকনিক্যাল পণ্য কিনতেই এখানে বেশি আগ্রহ দেখা যায়। তাতে করে দুর্নীতিও প্রচুর বৃদ্ধি পায়।

জেইউ/আইএসএইচ