আগামীতে সরকার গঠন করবে জাতীয় পার্টি
মুজিবুল হক চুন্নু। জাতীয় পার্টির বর্তমান মহাসচিব। ছিলেন সরকারি কর্মকর্তা। জাতীয় পার্টির প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের শাসনামলে চাকরি ছেড়ে রাজনীতিতে আসেন। ১৯৮৬ ও ১৯৮৮ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কিশোরগঞ্জ- ৪ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০০৮ সালে মহাজোটের প্রার্থী হিসেবেও নির্বাচিত হন সংসদ সদস্য।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী এবং যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি ঢাকা পোস্টের সঙ্গে আলাপচারিতায় তুলে ধরেন দেশের বর্তমান পরিস্থিতি, সংসদে জাতীয় পার্টির ভূমিকা এবং আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দলটির পরিকল্পনা। ঢাকা পোস্টের জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক আমানউল্লাহ আমান তুলে ধরেছেন এর অংশবিশেষ।
বিজ্ঞাপন
ঢাকা পোস্ট : দেশের রাজনীতিতে আলোচনায় দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টি কী ভাবছে?
মুজিবুল হক : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে প্রথমে যে কাজটি করছি সেটি হলো আমরা সংগঠনকে শক্তিশালী করছি। সারাদেশে ইউনিয়ন, উপজেলা ও জেলা পর্যায়ে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশনে যে কমিটিগুলো আছে, সব কমিটি আমরা রি-অর্গানাইজ (পুনর্গঠন) করে সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের কাজ করছি। ইতোমধ্যে অনেক উপজেলায় ও জেলায় সম্মেলন হয়েছে। আগামী অক্টোবরের মধ্যে আমরা সব জেলা, উপজেলা ও ইউনিয়নে জাতীয় পার্টির সম্মেলন শেষ করব। অক্টোবরের পর আমরা বিভাগীয় পর্যায়ের সব কর্মীকে ডেকে বিভাগীয় সমাবেশ করব।
আগামীতে ঢাকাতে একটা মহাসমাবেশ করার চিন্তা আছে এবং জাতীয় সম্মেলন করারও ইচ্ছা আছে। ২০২৩ সালের শেষে অথবা ২০২৪ সালের শুরুতে যে নির্বাচন হবে আমরা সেটাকে টার্গেট করেছি। ৩০০ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো বা নির্বাচন করার মতো সঙ্গতি আমাদের আছে, সামর্থ্যও আছে। আমাদের যথেষ্ট কর্মী আছে। শুধুমাত্র প্রার্থীর কিছুটা ক্রাইসিস (সংকট)। প্রার্থী যাতে ভালো হয় সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন এলাকায় অনেক ভালো মানুষ আছেন, যারা বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে রাজনীতিবিমুখ। তারা আসতে চাচ্ছেন না। ওই ভালো লোকগুলোকে বুঝিয়ে-শুনিয়ে আমাদের দলের প্রার্থী করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করছি। অনেকেই এগিয়ে আসছেন।
আমাদের মূল টার্গেট হলো আগামী নির্বাচনে ৩০০ আসনেই প্রার্থী দেওয়া। ৩০০ আসনেই আমরা নির্বাচন করব। জোটের ক্ষেত্রে যে কথাটা বলছেন, সেটা হচ্ছে যেসব দেশে পার্লামেন্টারি সিস্টেমটা অনেক উন্নত; যেমন ইংল্যান্ড বলেন, ভারত বলেন, শ্রীলঙ্কা; অনেকেই এখন জোট করে নির্বাচন করছে। এটা এখন একটা সিস্টেম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা যে জোটে যাব এমন কোনো গ্যারান্টি বা কনফারমেশন দিইনি। আবার যাব না, সেটাও আমরা বলছি না। তবে, আমাদের প্রাথমিক টার্গেট হলো ৩০০ আসনে লড়াই করা। অন্যদিকে, নির্বাচনের আগে রাজনৈতিক পরিবেশ ও পরিস্থিতির ওপর ডিপেন্ড করবে আমরা কোনো জোটে যাব কি না; নাকি আমাদের সঙ্গে কেউ জোটবদ্ধ হবে কি না। সেটা তখনকার পরিস্থিতি বলে দেবে।
এখন পর্যন্ত আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচন করার জন্য প্রার্থী বাছাই এবং সংগঠনকে আরও শক্তিশালী করার জন্য কাজ করছি। কারণ, আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি সারাদেশের মানুষ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির প্রতি বীতশ্রদ্ধ। আওয়ামী লীগের এই আমলে দুঃশাসন, করাপশন (দুর্নীতি), টাকা পাচার, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, বেকারত্ব— এসব কারণে মানুষ অসন্তুষ্ট। আবার বিএনপি যখন ক্ষমতায় ছিল, তারা বিশ্বে পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তারাও সুশাসন দিতে পারেনি। এরশাদ সাহেবের আমলে অনেক কাজ হয়েছে, সুশাসনও ছিল।
মানুষের এখন দাবি জাতীয় পার্টি যাতে ক্ষমতায় আসে। সেই কারণে মানুষের মনের তাগিদে, তাদের চাহিদার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আমরা ৩০০ আসনে নির্বাচন করার প্রস্তুতি নিয়ে কাজ করছি।
ঢাকা পোস্ট : আপনি জানেন নির্দলীয় ও নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি করছে বিএনপি। তারা অভিযোগ করছে, দলীয় সরকার বা আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের অধীনে কোনো অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সম্ভব নয়। জাতীয় পার্টি বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশ নেবে কি না?
মুজিবুল হক : জাতীয় পার্টি অবশ্যই অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন চায়। কিন্তু গত ৩০ বছরে কোনো নির্বাচনই ফেয়ার (নিরপেক্ষ) হয়েছে— এমন কথা আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কারও মুখ থেকে বের হবে না। ১৯৯১ সালে নির্বাচনের মাধ্যমে বিএনপি ক্ষমতায় আসে। ওই সময় আওয়ামী লীগ বলেছিল, নির্বাচনে কারচুপি হয়েছে। আবার ৯৬ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যায় তখন বিএনপি বলেছিল, কারচুপির নির্বাচন হয়েছে। ২০০১ সালে আবার যখন বিএনপি ক্ষমতায় যায় তখন আওয়ামী লীগ বলে, কারচুপি হয়েছে। অথচ আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দাবির মুখে এরশাদ সাহেব পদত্যাগ করার পর কয়েকটি নির্বাচন নির্দলীয় কেয়ারটেকার (তত্ত্বাবধায়ক) সরকারের অধীনে হয়। বিএনপি ও আওয়ামী লীগ উভয়ই বলছে, কোনো নির্বাচনই ফেয়ার (নিরপেক্ষ) হয়নি।
জাতীয় পার্টি মনে করে বর্তমানে যে নির্বাচনের সিস্টেম (প্রক্রিয়া), সেই সিস্টেমে ১০০ পারসেন্ট নির্বাচন ফেয়ার করা সম্ভব নয়। এই পদ্ধতি যদি চেঞ্জ (পরিবর্তন) করা হয় যেটা এরশাদ সাহেব বলে গেছেন, সেটা হলো কোনো প্রার্থীকে ভোট দেবে না, ভোট দেবে দলের মার্কাকে। অর্থাৎ আনুপাতিক হারে নির্বাচন। সেই আনুপাতিক হারে নির্বাচন কিন্তু ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে চালু হয়েছে। একমাত্র আনুপাতিক হারে নির্বাচন যদি করা যায় তাহলেই সম্ভব ১০০ পারসেন্ট ফেয়ার নির্বাচন করা। বর্তমান সিস্টেমে যা সম্ভব নয়। তবুও যেহেতু গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তন করা সম্ভব নয়, তাই জাতীয় পার্টি ভালো হলেও নির্বাচনে যায়, খারাপ হলেও নির্বাচনে যায়। কারণ, জাতীয় পার্টির একটাই উদ্দেশ্য, দেশে কোনোভাবেই যাতে অনির্বাচিত সরকার বা কোনো অ্যাবনরমাল (অস্বাভাবিক) সরকার না আসে। সেজন্য আমরা প্রত্যেকটি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করি।
আওয়ামী লীগসহ সব দলের কাছে আমাদের চাওয়া, আগামী নির্বাচনটা যেন সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে হয়। বিদেশের চাপ বা অমুকের চাপ— এটা বড় প্রশ্ন নয়। বড় প্রশ্ন হলো আমাদের জনগণের চাপ। জনগণ চায় একটা সুষ্ঠু নির্বাচন। আমরাও সেটা চাই। সেজন্য কারও সঙ্গে যদি কোনো রকম কো-অপারেশন (সহযোগিতা) করতে হয়, জাতীয় পার্টি সেটা করতে রাজি আছে।
ঢাকা পোস্ট : বিরোধী দল হিসেবে জাতীয় সংসদে সরকারের ভুলত্রুটি তুলে ধরা জাতীয় পার্টির দায়িত্ব। অভিযোগ রয়েছে, সংসদে সরকারের চেয়ে বিএনপির সমালোচনা করেন জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্যরা। এই বিষয়ে আপনার মন্তব্য…
মুজিবুল হক : আপনি যাদের কথা বলছেন, তারা (বিএনপি) যখন ক্ষমতায় ছিল জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের রাস্তায় মিছিল পর্যন্ত করতে দেয়নি। পিটুনি দিয়েছে। মিনিমাম (সামান্যতম) গণতান্ত্রিক অধিকার বিএনপির সময় আমরা পাইনি। একটা মিটিং করতে পারিনি, মিছিল করতে পারিনি। তাদের আমরা কী বলব? তারা যখন বড় গলায় পার্লামেন্টে বলে, তারা খুবই গণতান্ত্রিক, সুশাসন দিয়েছে; তখন আমাদের গায়ে লাগে। কারণ, তাদের সময়ে আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি নির্যাতিত হয়েছি আমরা।
আজ বলতে হয়, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া অসুস্থ, তার চিকিৎসা প্রয়োজন। তাকে দেশের বাইরে চিকিৎসার জন্য পাঠানোর বিষয়ে আমরা নৈতিকভাবে সমর্থন করি। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এরশাদ সাহেব জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান ছিলেন। তিনি সেনাপ্রধান ছিলেন। নয় বছর প্রেসিডেন্ট (রাষ্ট্রপতি) ছিলেন। তাকে জেলে রাখা হয়। জেল কর্তৃপক্ষ বললেন, তার জন্ডিসের মাত্রা ২৯ (রক্তে বিলিরুবিন মাত্রা ২৫ মি গ্রাম/ডেসির বেশি হলে বিপজ্জনক)। ২৯ বিলিরুবিন মানে একটা মানুষ মারা যাবে— এমন অবস্থা। সেই সময় বোর্ড (মেডিকেল বোর্ড) বললো, তাকে পিজিতে চিকিৎসা দিতে হবে। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে, প্রধানমন্ত্রীর কাছে ধর্ণা দিলাম। দরখাস্ত করলাম এরশাদ সাহেবকে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য। সরকার আমাদের কথা কানে নেননি। এটাই বিএনপি।
তারা (বিএনপি) যে আজ বড় বড় কথা বলেন, তারা ফেব্রুয়ারির নির্বাচন করেননি। আমরা বলতে চাই, আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সময়ে দেশের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করা হয়েছে। দুই দল যে আন্দোলন করেছিল, এরশাদ সাহেবকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে তারা গণতন্ত্র কায়েম করবে; আজ তারাই বলে, গণতন্ত্রের কী অবস্থা!
বলা হয়, এরশাদ সাহেব স্বৈরাচার। আজ বিএনপি বলে, আওয়ামী লীগের চেয়ে বড় স্বৈরাচার নেই। আবার আওয়ামী লীগ বলে, বিএনপির চেয়ে বড় দুর্নীতিবাজ ও স্বৈরাচার নেই। তাহলে কী বলবেন, ওই দুই দল সম্পর্কে আমাদের ধারণা খুব একটা ভালো না। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে আমরা কয়েকটা নির্বাচন করেছি। দুইটা কারণে। প্রথম কারণ হলো, আমাদের রাজনীতি আর বিএনপির রাজনীতি কাছাকাছি। তাদের (বিএনপি) সঙ্গে যদি আমাদের জোট হয়, আমাদের রাজনীতি বলে কিছু থাকবে না। দ্বিতীয় কারণ হলো, বিএনপি আমাদের ওপর এত অত্যাচার করেছে যে তাদের সঙ্গে আমাদের জোট করার কোনো মানে হয় না। কোনো নেতাকর্মীর পক্ষে মানসিকভাবে এটা গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তুলনামূলকভাবে আওয়ামী লীগ আমাদের ক্ষতি কম করেছে।
আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর দল, তারা স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছে। আমরা ভেবেছিলাম স্বাধীনতার যুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী দলের সঙ্গে জোট করি এবং নির্বাচনে যদি তারা ক্ষমতায় আসে তাহলে দেশের ভালো করবে, মঙ্গল করবে। তারা যে দুর্নীতি করবে ব্যাপকভাবে এবং সুশাসন দিতে পারবে না— এটা আমরা চিন্তা করিনি। এখন আমাদের ধারণা, ওই দুই দলকে মানুষ আর চায় না। আমরাও চাই না। আমরা চাই, নিজস্ব স্বকীয়তায় ৩০০ আসনে নির্বাচন করার।
আপনি পার্লামেন্টে (সংসদ) জাতীয় পার্টির ভূমিকার কথা বলছেন, আমাদের অনেক মেম্বারের (সংসদ সদস্য) বক্তব্য সম্পর্কে বলছেন। আপনি দেখবেন, আমরা পার্লামেন্টে সরকারের ভালো কাজগুলোকে ভালো বলছি। যেগুলো ভালো করেনি, আমরা বলছি ভালো করেননি। যেমন আমি নিজেও বলেছি, এই সরকার অনেক উন্নয়নের দাবি করে। আপনি ঢাকা শহরে বাস করেন না? আপনিই বলেন, ঢাকা শহরে বর্তমান সরকারের আমলে একটা ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট (যোগাযোগ ব্যবস্থাপনা) বাস্তবায়ন করা যায়নি। পাবলিক ট্রান্সপোর্ট (গণপরিবহন) নেই। লাখ লাখ মানুষ নিজের পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে বাসে যাবে, কিন্তু বাস নাই। লক্কর-ঝক্কর মার্কা ৩০/৪০ বছরের বাস, রং নেই, ড্রাইভার (দক্ষ চালক) নেই। একটা বাজে ব্যবস্থাপনায় বাস চলছে। আমি সরকারকে বলেছি, আপনারা এত দাবি করেন, এত কিছু করেন; আকাশ দিয়ে ট্রেন লাইন (মেট্রোরেল) করেন, এক হাজার বাস কিনে দেন না কেন? মানুষ টিকিট কেটে যাবে, দিতে পারেন না।
আমাদের সড়কমন্ত্রী (সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের) অনেক কাজ করেছেন। টঙ্গী থেকে গাজীপুর পর্যন্ত ১২ বছর ধরে ১৬ জেলার মানুষ যাতায়াত করতে পারেন না। রাস্তাটা ঠিক করতে পারেন না। কিসের কাজ করেন? আসলে বড় বড় প্রকল্প, বড় বড় কমিশন! ওই চিন্তা ওনাদের আছে। মানুষের কল্যাণের চিন্তা করেন না। বিএনপিও না, আওয়ামী লীগও না।
৩১ বছর হলো আমরা বিরোধী দলে। আওয়ামী লীগ ২১ বছর ক্ষমতায় ছিল না। তারা খণ্ড খণ্ড হয়ে গিয়েছিল, টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মেয়ে ১৯৮১ সালে আসার কারণে আওয়ামী লীগ আবার এক হয়েছে। বিএনপি আজ ১২ বছর ক্ষমতায় নেই। আপনি দেখবেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি ক্ষমতায় না আসলে তারাও ভেঙে যাবে। কিন্তু এরশাদের জাতীয় পার্টি ৯০ থেকে আজ ২০২২ সাল, ৩১ বছর ক্ষমতায় নেই কিন্তু এখনও টিকে আছে। ইনশাল্লাহ, মানুষের দোয়া-সমর্থন এবং এরশাদ সাহেবের কাজের কারণে আমরা টিকে আছি। আগামীতেও মানুষের জন্য কাজ করব। আমাদের যে পরিকল্পনা, সেগুলো মানুষের কাছে পৌঁছে দিলে, মানুষের সমর্থন পেলে আগামীতে আমরা সরকার গঠন করব।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টির একটা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, দলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব ছাড়া নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কোনো নেতা কথা বললে ওই নেতার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এই ধরনের সিদ্ধান্ত গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক কি না এবং দলের শীর্ষ নেতৃত্বের স্বৈরাচারী মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ কি না?
মুজিবুল হক : এটা প্রত্যেক দলেই দেখবেন। বিএনপি বলেন, আওয়ামী লীগ বলেন, সব দলের পক্ষ থেকে মুখপাত্র সিলেকশন করে দেওয়া হয়। কারণ, একটা দলে অনেক নেতা থাকেন। সবারই চিন্তা-ভাবনা এক রকম নয়। সব দলের নীতিনির্ধারণী বিষয়গুলো একটা ডিসিপ্লিনের (শৃঙ্খলা) মধ্যে আনতে এটা করা হয়। আওয়ামী লীগে দেখবেন, হয় তাদের দপ্তর সম্পাদক অথবা সাধারণ সম্পাদক, বিএনপিরও ঠিক তাই। জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকেও মুখপাত্র হিসেবে মহাসচিব কথা বলেন, নীতিনির্ধারণী বিষয়ে চেয়ারম্যানও কথা বলেন।
চেয়ারম্যান ও মহাসচিব দুজনই কথা বলেন সিদ্ধান্তের বিষয়ে। অনেক সময় দেখা যায় না জানার কারণে বা ধারণা না থাকায় বলতে গিয়ে একটা ভুল তথ্য দিয়েছেন। সেই ভুলটা যাতে না হয়, দলের মধ্যে একটা ডিসিপ্লিন থাকে সেই কারণে দলের মহাসচিব ও চেয়ারম্যান নীতিনির্ধারণী বিষয়ে কথা বলবেন। এখানে গণতন্ত্র হরণের কিছু নেই। কারণ, আপনি জানেন গণতন্ত্র বলতে কী বুঝায়। সেই জিনিসটা কোনো দল সঠিকভাবে পালন করে কি না— সেটা চিন্তার বিষয়।
ঢাকা পোস্ট : জাতীয় পার্টির পক্ষ থেকে বিভিন্ন সময়ে প্রশাসনিক পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। সেই প্রস্তাবগুলো সম্পর্কে জাতীয় পার্টির বর্তমান অবস্থান এবং দেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জাতীয় পার্টির রাজনৈতিক কর্মসূচি কী হবে?
মুজিবুল হক : দেশের বর্তমান যে জনসংখ্যা সেই অনুপাতে প্রশাসনে যে সিস্টেম, সেই সিস্টেম দিয়ে সরাসরি মানুষের কাছে সরকারের সুফলটা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব নয়। তাই এরশাদ সাহেব উপজেলা পরিষদ করেছিলেন। যেটা বিএনপি বাতিল করেছিল। পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ আবার উপজেলা পরিষদটা ফিরিয়ে আনে। তবে, এরশাদ সাহেবের আমলে উপজেলা পরিষদের যে ক্ষমতা ছিল, সেই ক্ষমতা কিন্তু এখন নেই। আমরা (জাতীয় পার্টি) যদি ক্ষমতায় যাই উপজেলা পরিষদকে আমরা শক্তিশালী করব। জেলা পরিষদকেও আমরা একটা শক্তিশালী স্থানীয় সরকার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করব।
দেশে এখন ২০ কোটির কাছাকাছি মানুষ। এত মানুষকে সুফল দেওয়ার জন্য ঢাকাকেন্দ্রিক সবকিছু গড়ে তোলা হয়েছে। ঢাকা থেকে যাতে বের হওয়া যায় সেজন্য এরশাদ সাহেব প্রাদেশিক সরকারের ফর্মুলা দিয়েছিলেন। সেই প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা যদি আমরা দাঁড় করাতে পারি তাহলে দুর্নীতি কমবে। মানুষ সরাসরি পার্টিসিপেট (অংশগ্রহণ) করতে পারবে প্রশাসনিক কাজে।
মানুষের কল্যাণের জন্য যা যা করা দরকার, যেমন- এলাকাভিত্তিক বাজেট করা, এলাকাভিত্তিক প্রকল্প করা, তাহলে ডেভেলপমেন্ট (উন্নয়ন) কাজটা সহজ হবে। এজন্য আমাদের দলের মেনিফেস্টোতে (ঘোষণাপত্র) আছে, যদি ক্ষমতায় যাওয়ার সুযোগ পাই আমরা প্রশাসনকে মানুষের দোরগোড়ায় নেওয়ার জন্য প্রাদেশিক সরকার ব্যবস্থা চালু করব।
নির্বাচন নিয়ে যে এত প্রশ্ন, সেই নির্বাচনকে আনুপাতিক হারে সিস্টেমের মধ্যে আনতে আমরা আমাদের মেনিফেস্টো তৈরি করছি। আমরা একটা টিম করে দিয়েছি। তারা আগামী ইলেকশনের জন্য মেনিফেস্টো তৈরি করছে।
এই মুহূর্তে বাংলাদেশের পাঁচ কোটি মানুষ বেকার। তাদের কাজে লাগানোর জন্য আওয়ামী লীগ-বিএনপির কোনো রোডম্যাপ (রূপরেখা) নেই। সুষ্ঠু কোনো প্ল্যানিং নেই। জাতীয় পার্টির বর্তমান চেয়ারম্যান অত্যন্ত শিক্ষিত মানুষ, হাইলি কোয়ালিফাইড। বুয়েট থেকে ৬৪ সালে গ্র্যাজুয়েট সম্পন্ন করেছেন, অভিজ্ঞ মানুষ। তিনি চিন্তা করেছেন, শুধুমাত্র মুখে বললে হবে না, বেকারদের কীভাবে কাজে লাগানো যায় তার একটা রূপরেখা তৈরির জন্য একটা টিম করে দিয়েছেন।
আমাদের লেখাপড়ার সিস্টেম, এই যে আইএ, বিএ, অনার্স; লাখ লাখ ছেলে-মেয়ে পাস করছে কিন্তু চাকরি নেই। একটা ছেলে অনার্স পাস করে, মাস্টার্স পাস করে পিয়নের চাকরির জন্য দরখাস্ত করছে। জনপ্রতিনিধি হিসেবে এটা আমাদের জন্য চরম লজ্জার। জি এম কাদের সাহেব এটা ফিল করেছেন। তিনি বলেছেন, আমাদের বর্তমান শিক্ষাব্যবস্থা কর্মবিমুখ। এর বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে শিক্ষাকে কর্মমুখী হিসেবে চালু করতে চাই। আপনি জানেন, দেশের জব মার্কেটে প্রতি বছর ১৫/২০ লাখ নতুন চাকরিপ্রত্যাশী আসছেন। তাদের মধ্যে মাত্র ৩/৪ লাখ লোককে আমরা দেশে-বিদেশে প্রভাইড করতে পারি। বাকিরা বেকার হয়ে যান। কেউ এটা নিয়ে চিন্তাও করেন না।
বর্তমান সরকার দাবি করেন, তারা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করছেন, মাটির নিচ দিয়ে এবং ওপর দিয়ে রাস্তা করছেন; ভালো কথা। কিন্তু সংবিধানের মৌলিক যে অধিকার, মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার, বাঁচার অধিকার; একটা মানুষের বাসস্থান, তার সুচিকিৎসার বিষয়ে সরকারের কি কোনো চিন্তা আছে? আপনি ঢাকা মেডিকেল, পিজি হাসপাতাল (বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়) বা সরকারি কোনো হাসপাতালে যান। দেখবেন হাজার হাজার রোগী, দেখার কেউ নেই। এক্ষেত্রে জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যানের চিন্তা হলো- মাটির নিচ দিয়ে রেললাইন বা মাটির ওপর দিয়ে গাড়ি যাওয়ার ফ্লাইওভার না করে প্রতিটি উপজেলায় আমরা মিনিমাম ৫০ জন চিকিৎসকের ব্যবস্থা করে স্পেশালাইজড (বিশেষায়িত) হাসপাতাল গড়ে তুলব। ফলে কোনো উপজেলার মানুষকে চিকিৎসার জন্য ঢাকায় আসতে হবে না। এটা হলো আমাদের চেয়ারম্যান এবং জাতীয় পার্টির চিন্তা-ভাবনা। দেশের মানুষের কল্যাণে কী কী করা যায় সেই চিন্তা করে জাতীয় পার্টি, অন্য দল নয়।
ঢাকা পোস্ট : আমরা দেখেছি এরশাদ সাহেবের মৃত্যুর আগে দলে ভাঙন দেখা দেয়। এমন কী জাতীয় পার্টির বিগত সম্মেলনের আগেও এটা লক্ষ্য করা যায়। মহাসচিব পরিবর্তন হয়। রওশন এরশাদের নেতৃত্বে বিকল্প কমিটিও হতে দেখা যায়। বর্তমানে বিদিশা এরশাদ নিজেকে জাতীয় পার্টির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান দাবি করছেন। এসব বিষয়ে আপনার মন্তব্য…
মুজিবুল হক : দেখেন, বেগম এরশাদের সঙ্গে দলের কেউ বের হয়ে গেছেন, এটা ঠিক নয়। আমি উনার সঙ্গে ছিলাম। তখন আমাদের একটা প্রশ্ন ছিল, গোলাম মোহাম্মদ (জি এম) কাদের এরশাদ সাহেবের ভাই। উনার নেতৃত্বের কোনো বিকল্প নেই। উনি পার্টির চেয়ারম্যান। আমাদের মধ্যে কেউ কেউ বলেছেন, পার্লামেন্টের অপজিশন লিডার (বিরোধীদলীয় নেতা) হবেন জি এম কাদের। আমরা কয়েকজন এটা অপোজ (বিরোধিতা) করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, যেহেতু বেগম এরশাদ বেঁচে আছেন, তিনি পার্লামেন্টের অপজিশন লিডার হবেন এবং জি এম কাদের ডেপুটি লিডার হবেন। এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে একটা দ্বন্দ্ব ছিল। পরে আমরা মিটমাট করে নিয়েছি। এটা তো ইন্টারনাল (অভ্যন্তরীণ) বিষয়, বড় কোনো ঘটনা নয়।
বেগম এরশাদ আমাদের মুরুব্বি। আমাদের পার্টির পৃষ্ঠপোষক। উনার আশীর্বাদে আমরা আছি। পার্টির নেতৃত্বে জি এম কাদের, এর কোনো বিকল্প নেই এবং সারাদেশে এটা স্টাবলিশড (প্রতিষ্ঠিত)।
আপনি একটা মহিলার কথা বললেন। তার লজ্জা নেই, শরম নেই? ওই নামটা উচ্চারণ করতে চাই না। আমি দুঃখিত, জাতীয় পার্টির মধ্যে এমন কেউ নেই যে তার কথা শুনবে! জি এম কাদেরের নেতৃত্বে সারাদেশে জাতীয় পার্টি এক ও ঐক্যবদ্ধ। ইনশাল্লাহ, আগামী নির্বাচন পর্যন্ত আমরা একসঙ্গে কাজ করব। দেখবেন, ফলাফল কী হয়?
এইউএ/এমএআর/