সোহেল তাজের স্মারকলিপি ভালো চোখে দেখছে না আওয়ামী লীগ
সংসদ ভবন এলাকা থেকে হেঁটে গণভবনে গিয়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী তানজিম আহমেদ সোহেল তাজের প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দেওয়ার ব্যাপারটিকে খুব একটা ভালো চোখে দেখছেন না আওয়ামী লীগের নেতারা। যদিও এ বিষয়ে প্রকাশ্যে কোনো মন্তব্যও করছেন না তারা।
সোহেল তাজের এই পদযাত্রা নিয়ে প্রশ্ন আছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের অনেক নেতার। তবে উচ্চ পর্যায়ের কোনো নির্দেশনা না থাকায় শীর্ষ পর্যায়ের অধিকাংশ নেতা এ বিষয়ে মুখ খুলতে চাচ্ছেন না।
বিজ্ঞাপন
গত রোববার প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিয়ে তিন দফা দাবি জানান সোহেল তাজ। তার দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল যেহেতু স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মাধ্যমে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার গঠিত হয়, সেহেতু বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র (প্রজাতন্ত্র) হিসেবে জন্ম লাভ করে এই দিনে, তাই দিনটিকে ‘প্রজাতন্ত্র দিবস’ ঘোষণা করতে হবে। ৩রা নভেম্বর জেল হত্যা দিবসকে জাতীয় শোক দিবস হিসেবে ঘোষণা করে রাষ্ট্রীয়ভাবে পালন করতে হবে এবং জাতীয় চার নেতাসহ মহান মুক্তিযুদ্ধের সকল বেসামরিক ও সামরিক সংগঠক, পরিচালক, অমর শহীদ ও বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নাম, অবদান ও জীবনীসহ মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস যথাযথ মর্যাদা ও গুরুত্বের সাথে সর্বস্তরের পাঠ্যপুস্তকে ও সিলেবাসে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
এ বিষয়ে কথা বলতে আওয়ামী লীগের অন্তত তিনজন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য, দুইজন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক এবং তিনজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে যোগাযোগ করলে তারা কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি। দুয়েকজন নেতা খুবই সতর্ক মন্তব্য করেছেন আর দুয়েকজন কথা বলেছেন নাম প্রকাশ না করার শর্তে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে দলটির কেন্দ্রীয় এক নেতা বলেন, এই সময়ে সোহেল তাজ এই পদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচির মধ্য দিয়ে কী বোঝাতে চাইলেন সেটা স্পষ্ট নয়। একই সঙ্গে তার এই কর্মসূচিতে ‘বিতর্কিত’ একজন ব্যারিস্টার অংশ নেওয়ার বিষয়েও আপত্তি তোলেন ওই নেতা।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের একজন সাংগঠনিক সম্পাদক বলেন, এই বিষয়ে আমাদের দলে আনুষ্ঠানিক কোনো আলোচনা হয়নি। তবে কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ কিছুটা ক্ষুব্ধ। তার এই কর্মসূচি বিরোধীদের কথা বলার সুযোগ করে দেবে বলে মনে করেন ওই সাংগঠনিক সম্পাদক।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের নির্বাহী সদস্য আনোয়ার হোসেন বলেন, তাজউদ্দিন আহমেদ মুজিব নগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। আমৃত্যু বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রাজনীতি করে গেছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী দুঃসময়েও তিনি আপস করেননি। কিন্তু ’৮১ সালে আজকের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন দেশে ফিরে আসেন তখন অনেক নেতা তার সঙ্গে ছিলেন না। অনেকেরই থাকার কথা ছিল। ওই দুঃসময়ে আমার মতো এই দেশের কৃষকের সন্তান, শ্রমিকের সন্তানেরা জননেত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মানুষের ভোটের ও ভাতের অধিকারের আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম।
তিনি বলেন, অনেক বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা আজকের অবস্থানে এসেছেন। সেই ক্ষেত্রে আজ এই পদযাত্রার নাটক যারা করেছে, কী উদ্দেশ্যে এবং কেন করেছে, জানি না। প্রকারান্তরে কিন্তু বিএনপির মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীররা যে কথাবার্তাগুলো বলেন, তারই একটা সংস্কার কিন্তু এই পদযাত্রা। কাদের নিয়ে উনি হাঁটছেন? তার উদ্দেশ্য কী? এগুলো পরিষ্কার হওয়া দরকার।
আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য মো. আব্দুর রহমান এ প্রসঙ্গে বলেন, এই স্মারকলিপি প্রদানের মধ্যে তো কোনো নতুনত্ব নেই। স্মারকলিপি দেওয়ারও কোনো কারণ নেই। তার কোনো বক্তব্য থাকলে, তিনি তো এখনো দলের লোক, দলীয় প্রধান ও বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে তিনি নিজেই বলতে পারতেন। এই স্মারকলিপি প্রদানের মধ্য দিয়ে এমন নাটকবাজির তো কোনো অর্থ নেই।
দেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী ও জাতীয় চার নেতার অন্যতম তাজউদ্দিন আহমদের ছেলে তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গাজীপুর-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ওই নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের মন্ত্রিসভায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান। ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। কিন্তু মাত্র ৫ মাসের মাথায় তিনি পদত্যাগ করেন। তারপরও দপ্তরবিহীন প্রতিমন্ত্রী হিসেবে তাকে বহাল রাখেন প্রধানমন্ত্রী। ২০১২ সালের ৭ জুলাই সশরীরে স্পিকারের কাছে পদত্যাগপত্র দিয়ে এমপি পদ থেকে সরে দাঁড়ান তিনি।
ওই সময় গাজীপুরের কাপাসিয়ার জনগণের উদ্দেশ্যে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন সোহেল তাজ। খোলা চিঠিতে তিনি লেখেন, সংসদ সদস্যের পদ থেকে পদত্যাগের এই সিদ্ধান্ত নিতে আমার অনেক চিন্তাভাবনা করতে হয়েছে। মানুষের প্রত্যাশা, ভালোবাসা, স্নেহ— আমার জন্য এলাকার মানুষের ত্যাগ স্বীকার, আবেগ এই সবকিছু চিন্তা করার পরও বাস্তবতা বিচার করে আমি পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছি। কাপাসিয়ার মানুষের সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না।
সক্রিয় রাজনীতিতে আবার ফিরে আসার সম্ভাবনা নেই জানিয়ে তিনি আরও লেখেন, কথার পেছনে অনেক কথা থাকে। অনেক লুকায়িত সত্য থাকে - যা দেশ, জনগণ ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে জনসম্মুখে বলা উচিত নয়। আর তা সম্ভবও নয়। শুধু এইটুকু বলি, আমি ‘সঙ্গত’ কারণেই এমপি ও মন্ত্রিত্বের পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি।
পদত্যাগের প্রায় ৭ বছর পর ২০১৬ সালের ২৪ জানুয়ারি গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সপরিবারে দেখা করেছিলেন তানজিম আহমেদ সোহেল তাজ। তারপর থেকে আওয়ামী লীগের কোনো কর্মসূচিতে না থাকলেও ২০১৬ সালে দলটির কেন্দ্রীয় কাউন্সিলে উপস্থিত থাকতে দেখা যায় তাকে। দীর্ঘদিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সক্রিয় থাকা সোহেল তাজ গত বৃহস্পতিবার নিজের ফেসবুক পেজে তিন দফা দাবিতে পদযাত্রা কর্মসূচি পালন করবেন বলে ঘোষণা দেন। কেউ তার সঙ্গী না হলে একাই কর্মসূচি পালন করবেন বলে জানান।
তবে শেষ পর্যন্ত ওই পদযাত্রা ও স্মারকলিপি প্রদান কর্মসূচিতে সোহেল তাজের কয়েকশ কর্মী-সমর্থক অংশ নেন। তারা তিন দফা দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড বহন করেন এবং এসব দাবি বাস্তবায়নে বিভিন্ন স্লোগান দেন।
এইউএ/এনএফ/জেএস