দুদক, দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজ
দুর্নীতি দমন কমিশন-দুদক এখন ডিফেন্সিভ অবস্থানে। বলছে, দুর্নীতির তদন্তে প্রভাবশালীদের নাম আসায় তাদের চাপে উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিনকে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে বলে যেসব অভিযোগ উঠেছে, তা সত্য নয়। দুদক সচিব সংবাদ সম্মেলন করে জানালেন, চাকরিবিধি না মানার কারণে শরীফ উদ্দিনকে অপসারণ করা হয়েছে। কিন্তু উপস্থিত সাংবাদিকরা সেই বিধি নিয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিল কি না সেটা জানা যায়নি।
মো. শরীফ উদ্দীনকে (কর্মচারী) চাকরি বিধিমালা, ২০০৮ এর ৫৪(২) নম্বর বিধি অনুযায়ী চাকুরিচ্যুত করা হয়েছে। এই বিধিতে কোনো কারণ দর্শাতে হয় না। হাইকোর্টের এক আদেশে এই বিধি বাতিল হয়েছিল এরপর সুপ্রিম কোর্টে যায় কমিশন, সেখানেও হাইকোর্টের আদেশ বহাল থাকে।
বিজ্ঞাপন
পরবর্তীতে কমিশন রিভিউ'র আবেদন করে। সেটি গ্রহণ করে আদালত নিয়মিত আপিলের অনুমতি দেয়। এই বিবেচনায় বলা যায়—এই বিধি নিজেই এখনো বিচারাধীন। সেটিকে প্রয়োগ করা কতটা ন্যায্য হলো সেটা কমিশনই বলতে পারবে। তবে পুরো বিষয়টি দুদকের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলেছে নিঃসন্দেহে। দুদকের চাকরি বিধিতে এই বিধি ছিল না, সংযোজিত হয় ১/১১ সরকারের আমলে।
শরীফকে কোন প্রেক্ষাপটে অপসারণ করতে হয়েছে, সে ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তার বিরুদ্ধে ১৩টি অভিযোগ তুলে ধরে দুদক। তাতে দেখা যায়, সব অভিযোগই কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক। এ অভিযোগগুলোর অধিকাংশই গত কয়েক দিনে বিভিন্ন গণমাধ্যমে এসেছে এবং এসব অভিযোগের জবাবও দিয়েছেন শরীফ উদ্দিন।
ব্যাংকের ঋণ মেরে দেওয়া, প্রকল্পের টাকা নয়ছয়, এটা ওটা কেনার নামে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে জনগণের টাকায় ফূর্তি করা ও পকেটে ভরা, ঘুষ, কমিশন সবই চলছে স্প্রিন্টার গতিতে।
একটি সংবিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান নিয়ে এমন আলোচনা এই প্রতিষ্ঠানের সক্ষমতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। শরিফের চাকরি যাওয়ার খবরে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে, দুদকের স্থায়ী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অনেকেই অফিস থেকে বাইরে বেরিয়ে এসে রাস্তায় মানববন্ধন করেন।
দুদকে প্রেষণে আসা সরকারি কর্মকর্তাদের সাথে দুদকের স্থায়ী কর্মীদের একটা দ্বন্দ্ব অনেকদিন ধরেই অপ্রকাশিত ছিল বলে জানা যায়। এবার তার কিছুটা প্রকাশ্যে এলো। চেয়ারম্যান ও কমিশন সদস্যদের বাইরে মহাপরিচালক ও পরিচালকদের বড় অংশই প্রশাসন ক্যাডার থেকে আগত। কিছু আছে অন্য ক্যাডার থেকেও। ফলে স্থায়ী কর্মকর্তাদের পদোন্নতি, বিকাশ নিয়ে অসন্তোষ আছে।
এর মধ্যে আছে এই ৫৪(২) নম্বর বিধি। ফলে তাদের পক্ষে অনেক সময় সাহস করে দুর্নীতি বিরোধী সাহসী অবস্থান নেওয়া সম্ভব হয় না। যে শরিফ এসিআরে (বার্ষিক গোপনীয় অনুবেদন) ভূষিত হয়েছিলেন ‘অতি উত্তম’ হিসেবে তিনি রাতারাতি হয়ে গেলেন কমিশনের কাছে অযাচিত। এটি কোনোভাবেই কর্মীদের জন্য স্বাভাবিক বার্তা নয়। বিষয়গুলো নিয়ে ভাবনা প্রয়োজন বড় জায়গা থেকে।
সাম্প্রতিক কালে বড়সড় দুর্নীতির খবরে জেরবার সারাদেশ। ব্যাংকের ঋণ মেরে দেওয়া, প্রকল্পের টাকা নয়ছয়, এটা ওটা কেনার নামে বিদেশ যাওয়ার কথা বলে জনগণের টাকায় ফূর্তি করা ও পকেটে ভরা, ঘুষ, কমিশন সবই চলছে স্প্রিন্টার গতিতে।
সরকারের প্রচেষ্টা নেই, দুদক সক্রিয় নয় এমনটা বলা কোনোভাবেই ন্যায্য হবে না। কিন্তু দুর্নীতির প্রকার ও বিস্তার দেখে একটা ভাবনা তো আসেই যে, দুর্নীতি থেকে আমাদের মুক্তি নেই।
অনেকে নৈতিকতার শিক্ষা প্রসারের কথা ভাবছেন। অনেকে বলছেন যে, অর্থনৈতিক সংস্কার বা উদারনৈতিক উন্নয়ন পন্থাই এই বিশাল দুর্নীতির প্রধান উৎস। এরকম অনেক ভাবনাই আসবে। কিন্তু সবার আগে দেখা দরকার দুর্নীতি নির্মূল করতে যে প্রাতিষ্ঠানিক আয়োজন আছে আমাদের, অর্থাৎ একটি কমিশন যে আছে, সেটি কী পারছে সর্বক্ষণ তদারকি করতে?
কাগজে কলমে দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দুদক শুরু থেকে নিজেদের স্বাধীন হিসেবে দাবি করে আসলেও রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবশালীদের চাপের মুখে অনেক ঘটনা তদন্তে এই স্বাধীনতা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অনেকবার।
কাগজে কলমে দুদক একটি স্বাধীন প্রতিষ্ঠান। দুদক শুরু থেকে নিজেদের স্বাধীন হিসেবে দাবি করে আসলেও রাজনৈতিক ও ব্যবসায়িক প্রভাবশালীদের চাপের মুখে অনেক ঘটনা তদন্তে এই স্বাধীনতা অনেকাংশেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে অনেকবার। এর একটি ছিল বেসিক ব্যাংক দুর্নীতি।
এতবড় আর্থিক কেলেঙ্কারি, অথচ এর চেয়ারম্যানকে ছাড় দিয়ে রাখা হয়েছে বরাবর। দুর্নীতি দমনের বিষয়গুলা চূড়ান্তভাবে দুর্নীতি দমন কমিশনেরই দেখার কথা। কিন্তু দুদকের কাজে বিভিন্ন সময় হস্তক্ষেপ হয় বলেই প্রতীয়মান হয। সেখানে কমিশনের ভেতর সৎ, নিষ্ঠাবান কর্মীরা চাকরি নিয়ে ভীতিকর অবস্থায় থাকলে দুর্নীতি বিরোধী কাজে গতি আসবে না।
আবার এ কথাও ঠিক যে, দায়িত্ব শুধু দুদকের একার না। দুদকের পাশাপাশি সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের দায়িত্ব আছে। দুদকের গোয়েন্দা বিভাগকে যেমন আরও শক্তিশালী করা প্রয়োজন সেই সঙ্গে দুর্নীতি অনুসন্ধানের দায় শুধুমাত্র দুদকের উপর না চাপিয়ে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, প্রতিষ্ঠান ও নিরাপত্তাবাহিনীকে যুক্ত করা প্রয়োজন।
দুর্নীতি প্রতিরোধ করা এবং প্রতিকার করা প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব একটা কাজ। দুদক একাই সব করবে, অন্যরা চুপচাপ থাকবে এমন ভাবনা অস্বাস্থ্যকর। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সচিবের দায়িত্ব আছে অভ্যন্তরীণ দুর্নীতিগুলো দেখে ব্যবস্থা নেওয়া।
চাকরিচ্যুত কর্মকর্তা যে অভিযোগ তুলেছেন, সে ব্যাপারে তদন্ত করা উচিত এবং সেটি দুদকের বাইরে থেকে করা সম্ভব হলে ভালো হয়, কারণ বলা হচ্ছে, এই কর্মকর্তাকে অপসারণের ক্ষেত্রে প্রভাবশালী চক্রের হাত রয়েছে। এর মধ্যেই কথা উঠেছে যে, যারা ভালো কাজ করে, তারা যদি শাস্তির মুখোমুখি হয়, তাহলে সেটা প্রকারান্তরে দুর্নীতিতে জড়িতদের উৎসাহিত করে।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি