ভাষা আন্দোলনে চিরস্মরণীয় বঙ্গবন্ধু
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাতৃভাষা রক্ষার দাবিতে সোচ্চার ছিলেন, অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন আন্দোলনে। ইতিহাসে বিধৃত হয়েছে সে অবদানের কথা। বাংলা ভাষার জন্য আন্দোলন করতে গিয়ে কয়েকবার রাজপথ থেকে বন্দি হন বঙ্গবন্ধু; সঙ্গে আরও অনেকে।
দূরদর্শী নেতৃত্বের অধিকারী বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন, বাংলা অবশ্যই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে, কারণ গণদাবি অস্ত্র দিয়ে প্রতিরোধ করা যায় না। ১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক মুসলিম হলে তমদ্দুন মজলিস ও ছাত্রলীগের যৌথ সভায় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। এই সভায় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, অলি আহাদ, মুহাম্মদ তোহাব, আবুল কাসেম, রণেশ দাশ গুপ্ত, অজিত গুহ প্রমুখের নাম উল্লেখযোগ্য।
বিজ্ঞাপন
বাংলা ভাষা বিরোধী কার্যকলাপের বিরুদ্ধে সক্রিয় আন্দোলন গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে এই সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। এতে গণআজাদী লীগ, গণতান্ত্রিক যুবলীগ, ছাত্রলীগ, তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রাবাসগুলোর সংসদ প্রভৃতি ছাত্র ও যুব প্রতিষ্ঠান দু’জন করে প্রতিনিধি দান করে।
এই সংগ্রাম পরিষদ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান বিশেষভাবে সক্রিয় ছিলেন এবং তার ভূমিকা ছিল যেমন বলিষ্ঠ, তেমনি সুদূরপ্রসারী। এই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট (হরতাল) পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের এক অনন্য অবিস্মরণীয় দিন। এই দিনে রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে সর্বাত্মক সাধারণ ধর্মঘট পালিত হয়। এটাই ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে তথা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এদেশে সফল হরতাল বা সাধারণ ধর্মঘট। এই হরতালে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়ে গ্রেপ্তার হন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে এটিই ছাত্রনেতা শেখ মুজিবুর রহমানের প্রথম গ্রেপ্তার।
বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর একটি স্মৃতি আমরা খুঁজে পাই তাঁর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে, “আমাদের এক জায়গায় রাখা হয়েছিল জেলের ভেতর। যে ওয়ার্ডে আমাদের রাখা হয়েছিল, তার নাম চার নম্বর ওয়ার্ড। তিনতলা দালান। দেয়ালের বাইরেই মুসলিম গার্লস স্কুল। যে পাঁচদিন আমরা জেলে ছিলাম সকাল দশটায় মেয়েরা স্কুলের ছাদে উঠে স্লোগান দিতে শুরু করত, আর চারটায় শেষ করত। ছোট্ট মেয়েরা একটুও ক্লান্ত হতো না। ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘বন্দি ভাইদের মুক্তি চাই’ ‘পুলিশি জুলুম চলবে না’ নানা ধরনের স্লোগান। এই সময় শামসুল হক সাহেবকে আমি বললাম, ‘হক সাহেব ওই দেখুন, আমাদের বোনেরা বেরিয়ে এসেছে। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে পারবে না।’ হক সাহেব আমাকে বললেন, ‘তুমি ঠিকই বলেছ, মুজিব।” (পৃষ্ঠা ৯৩)।
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণ পর্বে শেখ মুজিবুর রহমান জেলে ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে রাজনৈতিক ময়দানে অনুপস্থিত থাকলেও জেলে বসেও নিয়মিত আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করতেন। এ প্রসঙ্গে ভাষাসৈনিক গাজীউল হক তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, ‘১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে গ্রেপ্তার হওয়ার পর জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বিভিন্ন জেলে আটক ছিলেন। ফলে স্বাভাবিক করণেই ৫১ সালে ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সম্ভব ছিল না। তবে জেলে থেকেই তিনি আন্দোলনের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন এবং বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিতেন।’ (সূত্র : ভাষা আন্দোলনে বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা, গাজীউল হক)।
ভাষা আন্দোলনের সফলতায় জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদান অনস্বীকার্য এবং চিরস্মরণীয়।
ফরিদুন্নাহার লাইলী ।। কৃষি ও সমবায় সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ এবং সাবেক সংসদ সদস্য।