ঢাকা পোস্ট : আস্থা অর্জনের চেয়ে ধরে রাখা কঠিন
বাংলাদেশে সবচেয়ে সহজ কাজ হলো একটি নিউজ পোর্টাল করে সাংবাদিক বনে যাওয়া। আর সবচেয়ে কঠিন কাজ হলো, সেই নিউজ পোর্টালকে বিশ্বাসযোগ্য এবং পাঠকপ্রিয় করে তোলা। মহিউদ্দিন সরকার যখন গতবছর তার পুরোনো কর্মক্ষেত্র জাগোনিউজ ছেড়ে একটি নতুন অনলাইন করার উদ্যোগ নিলেন, তখন আমি একইসঙ্গে শঙ্কিত হয়েছি এবং আশাবাদী হয়েছি।
শঙ্কিত হয়েছি, কারণ একটি নতুন অনলাইনকে বিশ্বাসযোগ্যভাবে পাঠকপ্রিয় করা পাহাড় ডিঙানো সমান কথা বলে। আশাবাদী হয়েছি, জাগোনিউজে তার সাফল্য দেখে। পাহাড় ডিঙাতে না পারলেও অনেক উঁচুতে উঠতে পারবেন, এই আশা আমার ছিল।
বিজ্ঞাপন
মহিউদ্দিন সরকার আসলে চমক দেখিয়েছেন। আর চমকটা দেখিয়েছেন জাগোনিউজে থাকতেই। সেই সময় জাগোনিউজ বাংলাদেশে অনলাইন পোর্টালের মধ্যে শীর্ষ আসন দখল করে। সে কারণেই আশা ছিল, নতুন কর্মক্ষেত্রেও নিশ্চয়ই সফল হবে। তবে তার নেতৃত্বে ঢাকা পোস্ট যা করেছে, তা আমার প্রত্যাশার বাইরে। মাত্র একবছরের মধ্যে নিউজ পোর্টালের তালিকায় ঢাকা পোস্টের দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসা বিস্ময়করই বটে। রেটিংটা অবশ্য আমার নয়, অ্যালেক্সার।
আমি একটু পুরোনো ঘরানার মানুষ। সারাদিন সংবাদেই থাকি। তাও সকালে ছাপা পত্রিকা না পেলে দিন শুরু হতে চায় না। ঘুম ভাঙার পর থেকেই দরজার সামনে গিয়ে ঘোরাঘুরি করি, কখন আসবে দৈনিক পত্রিকা। করোনা এসে সেই অভ্যাসে কিছুটা পরিবর্তন এনেছে। সকালটা শুরু হয় ডিজিটাল ডিভাইসে ই-পেপার পড়েই। তবে অফিসে এসে প্রথম কাজ হলো পত্রিকা হাতে নেওয়া। ছুঁয়ে না দেখলে আমার পড়াটা ঠিক পূর্ণ হয় না। অনেকদিন ধরেই ছাপা পত্রিকার ভবিষ্যৎ নিয়ে নানারকম শঙ্কার কথা শুনে আসছি। কিন্তু আমাদের মতো পুরোনো ঘরানার মানুষ যতদিন আছে, ততদিন ছাপা পত্রিকা থাকবেই।
আমার ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দ যাই হোক, অনলাইন নিউজ মিডিয়া এখন বাস্তবতা। যত দিন যাবে, মানুষের অনলাইন নির্ভরতা তত বাড়বে। গণমাধ্যমের তথ্য প্রচারের যে কটি মাধ্যম তার মধ্যে সর্বশেষ এবং সবচেয়ে সম্ভাবনাময় নিঃসন্দেহে অনলাইন। ছাপা পত্রিকা, রেডিও, টেলিভিশন হয়ে গণমাধ্যমের ভবিষ্যৎ এখন অনলাইনে।
শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্বজুড়েই এই প্রবণতাই এখন বাস্তবতা। সংবাদ সংগ্রহের জন্য মানুষের নির্ভরতা ক্রমশ অনলাইনমুখী হচ্ছে। সব ছাপা পত্রিকারই অনলাইন ভার্সন আছে, অধিকাংশ টিভিরও আছে। অনেক পত্রিকার সার্কুলেশনের চেয়ে অনলাইনে পাঠক বেশি। এখনই আমি এমন অনেক লোককে চিনি, যারা পত্রিকা পড়েন না, টিভি দেখেন না। কিন্তু তারা আবার পিছিয়েও থাকেন না। অন্তর্জাল জগতের নানা মাধ্যম থেকে তারা প্রয়োজনীয় নিউজের লিঙ্কটি ঠিকই খুঁজে নেন।
শিক্ষিত হোক, অশিক্ষিত; কানে শুনতে পেলেই যে কেউ বেতারের শ্রোতা হতে পারেন। টেলিভিশনের দর্শক হতে হলে, কানের সঙ্গে দৃষ্টিশক্তিও থাকতে হবে। কিন্তু পত্রিকার পাঠক হতে হলে আপনাকে অন্তত বানান করে পড়ার মতো শিক্ষিত হবে। আর অনলাইনের পাঠক হতে হলে শুধু শিক্ষিত হলেই চলবে না, কিছুটা প্রযুক্তি শিক্ষাও থাকতে হবে। সঙ্গে থাকতে হবে ইন্টারনেট কেনার মতো আর্থিক সক্ষমতাও। তার মানে অনলাইনের পাঠক হচ্ছে, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশ। আশা করা নিশ্চয়ই অন্যায় নয়, সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর অংশের মাধ্যমটিতে সাংবাদিকতাও উৎকর্ষের চূড়া স্পর্শ করবে। কিন্তু ঘটনা ঘটছে উল্টো। সমাজের সবচেয়ে অগ্রসর পাঠকদের মাধ্যম অনলাইনেই হচ্ছে সবচেয়ে অনগ্রসর সাংবাদিকতার চর্চা।
আপনি বাংলাদেশের কয়টি অনলাইন নিউজ পোর্টালের নিউজ বিশ্বাস করেন? আচ্ছা প্রশ্নটা আরও সহজ করে দেই। আপনি বাংলাদেশের কয়টি নিউজ পোর্টালের নাম জানেন? ৫টা, বড় জোর ১০টা। আমি কিন্তু ১০টার বেশি পারব না। কিন্তু বাংলাদেশে অনলাইন নিউজ পোর্টাল আছে কয়টি? এক হাজার, ৫ হাজার, ১০ হাজার। হা হা হা। স্কাই ইজ দ্যা লিমিট। একসময় বলা হতো, আকাশের যত তারা, পুলিশের তত ধারা। এখন বলতে হবে, আকাশের যত তারা, বাংলাদেশে তত অনলাইন। সরকার নিউজ পোর্টালের নিবন্ধনের উদ্যোগ নিয়েছে বটে, তবে এখনো নিবন্ধনের বাইরে রয়ে গেছে অনেক অনলাইন।
গণমাধ্যমের কাজ হলো, মানুষকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ তথ্য সরবরাহ করা। কিন্তু সাংবাদিকতার পাশেই শুয়ে থাকে অপসাংবাদিকতা। পত্রিকায় নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে চাঁদা আদায় অনেক পুরোনো অভিযোগ। চাঁদা না পেলে সত্য-মিথ্যা মিলিয়ে নিউজ ছাপিয়ে দেওয়ার অভিযোগও কম নেই।
সাংবাদিকতার নামে সেই চাঁদাবাজিটা করতে আগে অনেক কষ্ট করতে হতো। অন্তত পত্রিকা ছাপতে তো হতোই। অনলাইন আসার পর এখন সবকিছু জলবৎ তরলং। কারো বিরুদ্ধে যে কোনো একটা ডটকম-এ একটা নিউজ প্রকাশ করতে হবে। তারপর সেই নিউজের লিঙ্ক ফেসবুকে শেয়ার দিতে হবে, বন্ধু-বান্ধবদের দিয়ে শেয়ার দেওয়াতে হবে। আরও বেশি প্রচার চাইলে অল্প কিছু টাকা দিয়ে বুস্ট করাতে হবে। ব্যস, আপনি যাকে ঘায়েল করতে চাইছেন, তিনি শেষ হয়ে যাবেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন শত শত লিঙ্ক ঘুরে বেড়ায়।
পত্রিকার সার্কুলেশন নির্ধারিত হয় বিক্রির ভিত্তিতে, টেলিভিশনের টিআরপি নির্ধারিত হয় দর্শক সংখ্যার ভিত্তিতে। আর অনলাইনের জনপ্রিয়তা মাপা হয় ক্লিকের ভিত্তিতে। যত পাঠক ঐ লিঙ্কে ক্লিক করবে অনলাইন তত হিট। এই হিটের জন্য পাগলপারা সব অনলাইন। আর ক্লিক পেতে মরিয়া অনলাইনগুলো যা করে, তার সঙ্গে সাংবাদিকতার দূরতম কোনো সম্পর্কও নেই। শিরোনামের সঙ্গে কনটেন্টের কোনো মিল নেই। কনটেন্ট যা থাকে তা করার ক্ষেত্রে সাংবাদিকতার নিয়মকানুন মানা হয় না।
গোটা দশেক বাদ দিলে বাংলাদেশের অধিকাংশ অনলাইন নিউজ পোর্টালের কোনো মা-বাপ নেই। মা-বাপ নেই বলাটা বোধহয় ঠিক হলো না। আদরের সন্তানের নামের শেষে ২৪ডটকম জুড়ে দিলেই হয়ে গেল একটি অনলাইন নিউজ পোর্টাল। মা প্রকাশক, বাবা সম্পাদক। ব্যস সাংবাদিক পরিবার। গাড়ির সামনে ‘সংবাদপত্র’ লাগিয়ে ঘুরবেন, চাঁদাবাজি করবেন, মাস্তানি করবেন। সব জায়েজ। শত শত, হাজার হাজার অনলাইনের ভিড়ে সত্যিকারের সাংবাদিকতা করা গোটা দশেক অনলাইনের মান-সম্মান নিয়ে টিকে থাকাই মুশকিল। কোনটা ভুরুঙ্গামারি২৪ডটকম, কোনটা ঢাকা পোস্ট, আর কোনটা বিডিনিউজ২৪ডটকম বোঝা দায়।
ইন্টারনেটের বিশাল জগতে ঘুরে বেড়ানো শত শত, হাজার হাজার লিঙ্কের কোনটা নিউজ, কোনটা ফেক তা যাচাই করতে পাঠককে রীতিমত গোয়েন্দা হতে হয়। এসব লিঙ্কের এমন চটকদার শিরোনাম, দেখলেই আপনার আঙুল নিশপিশ করবে ক্লিক করতে। কিন্তু ক্লিক করে দেখবেন ভেতরে আসলে কিছু নেই। আর হাতেগোনা গোটা দশেক অনলাইন ছাড়া, বাংলাদেশের বাকি সব অনলাইন ক্লিক নির্ভর। তাদের চাই হিট, যেকোনো মূল্যে। আর এই হিটের পেছনে ছুটতে গিয়ে আমরা ভুলে যাই সাংবাদিকতার নীতি-নৈতিকতা।
এখন যারা অনলাইন সাংবাদিকতা করছেন, তাদের একই সঙ্গে দুটি কাজ করতে হবে। নিজেদের আরও ভালো সাংবাদিকতা করতে হবে এবং আবর্জনার বিরুদ্ধে লড়াইটা চালাতে হবে। সরকারকেও অনলাইনকে একটা জবাবদিহিতা ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। অনলাইন হোক ভালো এবং আধুনিক সাংবাদিকতার প্লাটফর্ম, ব্ল্যাকমেইলের নয়।
শুরুতে যেমনটি বলছিলাম, একটি অনলাইন করা সবচেয়ে সহজ। কিন্তু সবচেয়ে কঠিন হলো, সেটি বিশ্বাসযোগ্যভাবে পাঠকের কাছে উপস্থাপন। তারচেয়েও কঠিন হলো আস্থা আর বিশ্বাস ধরে রাখা। আশা করি ঢাকা পোস্ট লাইকের পেছনে না ছুটে অনলাইনে ভালো সাংবাদিকতার চর্চা করবে। গত একবছরে তাদের যে সাফল্য তা আরও বিশ্বাসযোগ্যভাবে ধরে রাখার কঠিন লড়াইটা চালিয়ে যাবে।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
জেডএস