চকরিয়ায় পাঁচ ভাইয়ের মৃত্যু : বিচার ও দায় স্বীকারের সংস্কৃতি
কক্সবাজারের চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের পাঁচ ভাইয়ের মর্মান্তিক মৃত্যুর খবরটি ৯ ফেব্রুয়ারি কমবেশি সব পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রাধান্য পায়। যে খবর পড়তে গিয়ে পাঠকের চোখে জল আসাই স্বাভাবিক। সবাইকে কমবেশি নাড়া দিয়েছে ভয়াবহ এই দুর্ঘটনার খবরটি।
বাবার শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে মন্দিরে যাওয়ার পথে নয় ভাই বোনের পাঁচজনই একটি পিকআপ ভ্যানের চাপায় নিহত হন। একইদিন ঢাকাসহ দেশের বিভিন্নস্থানে সড়ক দুর্ঘটনায় আরও অন্তত ১০জনের মৃত্যুর খবর প্রকাশিত হয় বিভিন্ন গণমাধ্যমে।
বিজ্ঞাপন
কথা হলো, সড়ক দুর্ঘটনার মতো জাতীয় এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কত রকমের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা শোনা যাচ্ছে দিনের পর দিন, যুগ ধরে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হচ্ছে না। কেউ কেউ বলেন, দেশে যানবাহনের সংখ্যা বেশি, মানুষ বাড়ছে, তাই দুর্ঘটনাও বাড়ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে গাড়ি উৎপাদনকারী দেশ জাপানে বাংলাদেশের চেয়ে তো যানবাহন কম নয়। সেখানে কি এত বেশি দুর্ঘটনা ঘটে? সেখানে প্রতিদিন বা প্রতিবছরে কি এত মানুষের প্রাণ যায় সড়কে? মোটেও না। এমনও দেশ আছে যেখানে বছরে সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যায় মাত্র একজন। উন্নত দেশে সবকিছু নিয়মের মধ্যে চলে, আইন কঠোর, সবাই আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাই দুর্ঘটনাও কম। তবে আমাদের দেশে কেন সড়ক দুর্ঘটনা? চলমান এই মৃত্যুর মিছিল কমিয়ে আনা যায় না?
এ আলোচনায় যাওয়ার আগে চকরিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে আরও কিছু বলার প্রয়োজন আছে। তা হলো, বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, যে পিকআপ ভ্যানের ধাক্কায় পাঁচ ভাইয়ের প্রাণ গেছে সেই ভ্যানটির নম্বর প্লেট ছিল না। চালক বা হেলপার ধরা পড়লে হয়তো জানা যাবে গাড়িটির ফিটনেস ছিল না, ছিল না ড্রাইভিং লাইসেন্সও। বেপরোয়া চালানোর কারণে যে এই দুর্ঘটনাটি ঘটেছে তা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য থেকেই স্পষ্ট।
যে কথাটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তা হলো, দেশে দায় নেওয়ার সংস্কৃতি একেবারেই নেই। কেউ কোনো বিষয়ের দায় নিতে চান না। বরং কায়দা করে অন্যের ঘাড়ে দায় চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর অপচেষ্টাই বেশি দেখা যায়।
প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আর বাৎসরিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বলছে, দিন দিন সড়ক অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বাড়ছে মৃত্যু আর আহতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে অসহায় ও দরিদ্র পরিবার।
সকালে মহাসড়কে এত বড় দুর্ঘটনা ঘটেছে, তখন হাইওয়ে পুলিশ কোথায় ছিল? নম্বর প্লেট ছাড়া গাড়িটি কীভাবে দিনের পর দিন চলেছে? এজন্য কি কারো দায় নেই? যদি চালকের লাইসেন্স বা গাড়ির ফিটনেস না থাকে তাহলে এর দায় কে বা কারা নেবে? এসব দেখার জন্য তো বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্বশীলরা ছিলেন। এরকম অসংখ্য গাড়ি সড়কে চলছে দিনের পর দিন। তবে তারা কী করেছেন? সবচেয়ে বড় কথা হলো, স্বজনহারা মানুষগুলোর এখন কী হবে?
এ ধরনের মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, চালক বা হেলপারকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা গ্রেফতার করে। এক পর্যায়ে তার জামিন হয়। শেষ পর্যন্ত মামলার পরিণতি সম্পর্কে কারো কিছু জানার সুযোগ থাকে না। যাদের অবহেলায় সড়ক-মহাসড়ক অরক্ষিত, দুর্ঘটনা ঘটছে তাদের কি বিচার হবে না? তাদের কেন আইনের আওতায় এনে শাস্তি দেওয়া হয় না? কিংবা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীলরা কেন আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের হত্যার দায় নিতে চান না। এসব প্রশ্ন আবারো নতুন করে সামনে আনা প্রয়োজন।
চকরিয়ার সড়ক দুর্ঘটনা একেবারেই হত্যাকাণ্ড। ফৌজদারি অপরাধ। প্রথমে যারা ঘটনার সঙ্গে যুক্ত তাদের দ্রুত সময়ের মধ্যে আইনের আওতায় আনতে হবে। জবাবদিহি করতে হবে হাইওয়ে পুলিশকে। উপজেলা ও জেলা প্রশাসন থেকে শুরু করে বিআরটিএ কর্তৃপক্ষসহ সর্বোপরি সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয় এ ঘটনার দায় কোনভাবেই এড়াতে পারে না। আমরা দেখতে চাই, এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবাই দায় স্বীকার করে আনুষ্ঠানিক দুঃখ প্রকাশ করেছেন। আর দায় স্বীকার করার সংস্কৃতি চালু হলে দায়িত্ব বাড়বে। সড়ক মহাসড়কে বাড়বে নজরদারি। তাহলে দুর্ঘটনাও কমবে।
এখানেই শেষ নয়, সড়ক যাদের দেখভাল করার কথা, যানবাহন বা চালকের কাগজপত্র যাদের নিয়মিত পরীক্ষা করার কথা এক্ষেত্রে দায়িত্বে অবহেলা পেলে তাদের অবশ্যই শাস্তির আওতায় আনতে হবে। পরিবহন মালিকদেরও এসব হত্যাকাণ্ডের দায় এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
শীত মৌসুমে সড়ক ও নৌপথে যানবাহন চলাচলে বাড়তি নির্দেশনা থাকে। সেগুলোর যেমন প্রচার নেই, তেমনি এসব নির্দেশনা মানা হচ্ছে কি না, তা দেখভালেরও কেউ নেই। ফলে আমরা যতই নিরাপদ সড়কের কথা বলি আসলেই কি সড়ক নিরাপদ হচ্ছে? মোটেই না। প্রতিদিনের ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনায় হতাহতের সংখ্যা আর বাৎসরিক দুর্ঘটনার প্রতিবেদন বলছে, দিন দিন সড়ক অনিরাপদ হয়ে উঠছে। বাড়ছে মৃত্যু আর আহতের সংখ্যা। সেই সঙ্গে বাড়ছে অসহায় ও দরিদ্র পরিবার।
সড়ক দুর্ঘটনা রোধে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ২০১৮ সালে পাঁচ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন। এরপর একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। সেই কমিটি সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ১১১ দফা সুপারিশ দেয়। সেই সুপারিশ বাস্তবায়ন হচ্ছে না। দুর্ঘটনারোধে সড়ক পরিবহন মন্ত্রণালয়, বিআরটিএ বা আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা সম্মিলিতভাবে কী করছে তা মানুষ জানতে চায়। যদি বাস্তবায়ন হতোই বা সড়কে নজরদারি বাড়ানো হতো তাহলে দৃশ্যপট বদলে যেত।
এ পরিস্থিতিতে মায়ের তো নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে। পাগলপ্রায় মায়ের মুখে কোনো কথা আসবে না এটাই স্বাভাবিক। এত বড় শোকের পাথর বুকে চাপা দিয়ে মা কতদিন বাঁচবেন?
যতক্ষণ পর্যন্ত দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে না আসছে ততক্ষণ পর্যন্ত মনে করার কোনো কারণ নেই সরকার এ ব্যাপারে খুব তৎপর হয়ে কাজ করছে। সবার আগে দুর্ঘটনা রোধে জনসচেতনতা জরুরি। সে কাজটিই করা সম্ভব হয়নি। তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক কীভাবে সড়ক-মহাসড়ক নিরাপদ হবে?
সর্বোপরি সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮ এতদিনেও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। পরিবহন মালিক ও শ্রমকিদের চাপে আইনের শাস্তিযোগ্য ২৯টি ধারায় সংশোধনী আনা হচ্ছে আবারও। চার বছরের বেশি সময়েও পরিবহন সংশ্লিষ্টদের কব্জা থেকে আইনটিকে বাইরে এনে আলোর মুখ দেখাতে পারেনি সরকার। এতসব সংকট চলমান রেখে সড়ক দুর্ঘটনা কমানো যাবে না। থামবে না মৃত্যুর মিছিলও।
চকরিয়ার অবসরপ্রাপ্ত স্বাস্থ্য পরিদর্শক সুরেশ চন্দ্র শীল মারা যান ১০ দিন আগে। মরদেহ শ্মশানে দাহ করার সময় হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী হাতের শাঁখা ভ্যাঙে ও স্বামীর পায়ে সিঁথির সিঁদুর মুছে দিয়ে চিরদিনের জন্য বিদায় দিয়েছিলেন সহধর্মিণী মৃণালিনী শীল (৬৫)। তখনো মৃণালিনী জানতেন না, সুরেশের শ্রাদ্ধের আগেই তার ওপর আরও বড় আঘাত অপেক্ষা করছে; নাড়িছেঁড়া ধন পাঁচ সন্তানকে একসঙ্গে সারাজীবনের জন্য হারাতে হবে।
ঘটনার দিন ডুলাহাজারা ইউনিয়নের মালুমঘাট স্টেশনের কাছে হাসিনাপাড়ায় বাড়ির কাছেই চকরিয়ায় মহাসড়কে দুই ফুট দূরে দাঁড়িয়েছিলেন আট ভাই-বোন। সবার পরনে ছিল সাদা থান ও উত্তরীয়। বাবার শশ্মানে পূজা দেওয়ার জন্য যাচ্ছিলেন তারা। পথে হঠাৎ সবজি বোঝাই দ্রুতগামী একটি পিকআপ তাদের চাপা দিয়ে পালিয়ে যায়।
বাবার শ্রাদ্ধের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছিল আগে। কয়েকদিন পরেই শ্রাদ্ধ। তা আর করা হলো না তাদের। নিজেরাই পরপারে পাড়ি দিলেন। স্বামীর শ্রাদ্ধের আগেই এত বড় সর্বনাশ যে মৃণালিনীর জন্য অপেক্ষা করছিল তা কে জানত? একদিকে স্বামী নেই। অন্যদিকে একদিনে পাঁচ সন্তানের মৃত্যু। অন্য সন্তানরাও হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে।
এ পরিস্থিতিতে মায়ের তো নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকা ছাড়া আর কীই-বা করার আছে। পাগলপ্রায় মায়ের মুখে কোনো কথা আসবে না এটাই স্বাভাবিক। এত বড় শোকের পাথর বুকে চাপা দিয়ে মা কতদিন বাঁচবেন? তা হয়তো সময়ই বলে দেবে। তাছাড়া পাঁচ সন্তানের স্ত্রী, সন্তানদের কী হবে? একটি ঘটনা পুরো পরিবারকে পথে নামিয়েছে। নিঃস্ব করে দিয়েছে।
ঘাতক যদি বুঝতে পারত দুর্ঘটনায় মৃত্যুর পর পরিবারের কী ধরনের মানবিক বিপর্যয় নেমে আসে তাহলে সে হয়তো কোনোদিনই দুর্ঘটনা ঘটাত না। তাই পরিবহন চালকদের কাছে এ বিষয়টি ভালোভাবে তুলে ধরার ব্যবস্থা করা জরুরি।
দুর্ঘটনার পর চকরিয়া থানার ওসি মুহাম্মদ ওসমান গনিকে বলতে শোনা গেছে, ঘটনাটি মহাসড়কে ঘটেছে। তাই এটি সবকিছুই দেখভাল করবেন হাইওয়ে পুলিশ। আমরা আসামিদের ধরতে সহযোগিতা করব। এরকম দায় এড়ানো বক্তব্যে দিয়ে থানা কর্মকর্তার পার পাওয়ার সুযোগ নেই।
হিন্দু রীতি অনুযায়ী মৃত ব্যক্তির আত্মার শান্তির জন্য শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। কিন্তু চকরিয়ায় বাবার শ্রাদ্ধের আগেই পাঁচ সন্তানকে পৃথিবী থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। সন্তান হিসেবে তারা বাবার আত্মার শান্তির জন্য আয়োজিত অনুষ্ঠান শেষ করতে পারেননি। দুর্ঘটনায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের আত্মার শান্তির জন্যও শ্রাদ্ধ অনুষ্ঠান হবে। কিন্তু তাদের সবার আত্মা শান্তি পাবে যদি ঘাতকদের বিচার হয়। দেখভালের দায়িত্বে নিয়োজিতদের যদি আইনের আওতায় এনে বিচার করা হয়। সড়কে দুর্ঘটনার জন্য জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করা যায়। সর্বোপরি সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী ব্যক্তিরা যদি দায় নেন। এরমধ্য দিয়ে নিরাপদ সড়ক বাস্তবায়নে কিছুটা হলেও গতি ফিরবে।
রাজন ভট্টাচার্য ।। সাংবাদিক ও কলাম লেখক