মহসিনের কষ্ট বোঝার কেউ কি ছিল না?
ভাবতেই বুকটা দুমড়ে মুচড়ে যাচ্ছে। ২ ফেব্রুয়ারি রাতে লাইভে এসে জলজ্যান্ত একজন মানুষ সকলের কাছে ক্ষমা চেয়ে, দোয়া পড়ে, মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করে নিজের জীবনের অবসান ঘটানের ঘোষণা দিচ্ছেন। ফেসবুক লাইভে আত্মহত্যা করার আগে সব কষ্টের কথা, নিজের বার্ধক্যের নিঃসঙ্গতা এবং পরিবার নিয়ে হতাশার কথা জানান আবু মহসিন খান নামের ঐ ব্যক্তি।
তিনি নায়ক রিয়াজের শ্বশুর। একসময় ব্যবসা, বাড়ি, গাড়ি, প্রতিপত্তি, সংসারে সুখ সবই ছিল তার। প্রায় বার্ধক্যে এসে সব হারিয়েছেন, প্রতারিত হয়েছেন বন্ধুবান্ধবদের কাছে। কষ্ট পেয়েছেন পরিবারের লোকদের কাছেও। ফেসবুক লাইভে কষ্টের কথা বলতে গিয়ে বারবার থেমে যান, আর কিছু বলতে পারছিলেন না। চোখ গড়িয়ে জল ঝরছিল। কষ্ট বোধহয় অনেক বেশিই ছিল তার।
বিজ্ঞাপন
একসময় কান্না চেপে বলতে শুরু করেন, ‘আমার এক ছেলে থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। আমি ক্যানসার আক্রান্ত। ফ্ল্যাটে একাই থাকি। আমার ভয় করে যে আমি বাসায় মরে পড়ে থাকলে, লাশ পচে গেলেও কেউ হয়তো খবর পাবে না।’
ঢাকার বাসায় একা থাকেন জানিয়ে মহসিন বলেন, ‘একা থাকা যে কি কষ্ট যারা একা থাকে তারাই একমাত্র বলতে পারে বা বুঝে। আমার আসলে এখন আর পৃথিবীর প্রতি, মানুষের প্রতি...।’
মহসিন খানের কষ্টে কথা, অবহেলার কথা খুব বুঝতে পারি আমরা। আসলে মহসিন খানের কষ্ট বোঝার কেউ ছিল না। এমন হাজারো মহসিনের বাস বাংলাদেশে। এটা মহসিনের একার গল্প নয়, হাজারো বৃদ্ধের অবহেলা আর কষ্টের গল্প। এ গল্প এদেশের দেড় কোটি প্রবীণের গল্প। যারা মহসিনের মতো আত্মহত্যা করতে পারেন না। নীরবে চোখের জল ঝরান।
মহসিন খান মৃত্যুর আগে কেবল নিজের কষ্ট নয় নিজের বৃদ্ধ সদ্য প্রায়ত দুই খালার পরিণতির কথাও জানিয়েছেন। আর এখানেই ছিল তার বেশি হতাশা। নিজের খালার মৃত্যুর কথা উল্লেখ করে জানান, ‘আমার বয়স ৫৮ বছর। আমার খালা কিছুদিন আগে মারা গেছেন। তার একমাত্র ছেলে আমেরিকায় থাকে। কিন্তু সে খালাকে দেখতেও এলো না। এর আগে আরও এক খালা মারা গেছেন, তার বেলায়ও এমন ঘটেছে।' গোটা বিশ্বে অবহেলিত বৃদ্ধদের কথা যেন এখানে অন্তর্নিহিত। এমন কষ্টে যাদের হৃদয় আছে তাদের চোখ গড়িয়ে তো জল আসেই। অনেক কষ্ট তার বুকে চাপা ছিল। তিনি লাইভে এসে বলেন, তার সাথে অনেকেই বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, এমন কি নিজের স্বজনরাও।
পরিশেষে তিনি বলেন, ‘নিজেকে আর মানিয়ে নিতে পারলাম না। যারা দেখছেন তাদের সাথে এটাই শেষ দেখা, সবাই ভালো থাকবেন।’ এর আগে তিনি নিজের পিস্তল এবং সেটির লাইসেন্স দেখিয়ে বলেন, ‘আমি যেটা দিয়ে আত্মহত্যা করছি, সেটা ইলিগ্যাল কিছু না। এটির লাইসেন্স আছে। সেটি নবায়নও করা হয়েছে।’ এরপর লাইভের ১৬ মিনিটের মাথায় এসে কালেমা পড়তে পড়তে মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন আবু মহসিন খান। কেবল নিজের জন্য নয় অন্য বৃদ্ধদের জন্যও কষ্ট ছিল মহসিন খানের যা ফেসবুক লাইভে স্পষ্ট হয়েছে।
তিনি বলেন আমরা ছেলে, মেয়ে, স্ত্রী আমরা যাদেরকে নিয়েই যা কিছু করি আমরা সবকিছুই ফ্যামিলির জন্য করি। আপনি যদি ১০০ টাকা আয় করেন তার মধ্যে আপনার ২০ শতাংশও আপনি আপনার নিজের জন্য ব্যয় করেন না। যদি ২০ শতাংশও নিজের জন্য ব্যয় করেন এবং ৮০ শতাংশ পরিবারের পেছনে খরচ হয়। তারপরও কেন এমন হয়? এটা এক মহসিনের গল্প নয়, এ যেন এদেশের দেড় কোটি বৃদ্ধদের গল্প।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক হিসাবে দেখা গেছে, বাংলাদেশের মানুষের বর্তমান গড় আয়ু ৭১ বছর। এদেশে মোট জনসংখ্যার ৮ শতাংশ বয়োজ্যেষ্ঠ। অতীতের এক গবেষণা রিপোর্টে জানা যায়, ২০৫০ সালে দেশে বয়োজ্যেষ্ঠের সংখ্যা ৩ কোটি ৬০ লাখে পৌঁছবে, যা মোট জনসংখ্যার ২৫.৯০ শতাংশ হবে (Ref: Ageing population in Bangladesh; Health Age Asia, 2019)। এখানে বয়োজ্যেষ্ঠ বলতে ষাটোর্ধ্বদের ধরা হয়েছে। মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বয়োজ্যেষ্ঠ মানুষের সংখ্যাও বাড়ছে। সে হিসেবে বাংলাদেশে প্রবীণদের কল্যাণে তেমন কোনো সুব্যবস্থা কি বাড়ছে?
বাংলাদেশ সরকার দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠী সামাজিক নিরাপত্তা বিধানে এবং পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে বয়স্ক ভাতা কর্মসূচি চালু করে। ২০২০-২১ অর্থবছর থেকে ৪৯ লাখ বয়স্ক ব্যক্তির জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হচ্ছে।
আমাদের বয়স্করা কিছু অর্থ পাচ্ছে এটাও কম কি? বর্তমানে পিতা-মাতা বিশেষ করে বৃদ্ধরা যেভাবে অবহেলিত তাতে রাষ্ট্রকে এ বিষয়ে ভাবতে হবে। প্রবীণদের কল্যাণে যে সমস্ত পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন তা খুবই অপ্রতুল। বৃদ্ধদের জন্য বিশেষ চিকিৎসা ব্যবস্থা, বৃদ্ধনিবাস, আর্থিক সমর্থন তৈরি, পুষ্টিকর খাদ্য, ইত্যাদি সরবরাহের ব্যবস্থা করা প্রয়োজনের। এ দেশের প্রবীণ জনগোষ্ঠী ষাটোর্ধ্ব বয়স থেকে কর্মহীনতা, আর্থিক প্রবঞ্চনা, পুষ্টিহীনতা, নিরাপদ পানি ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পারিবারিক অবহেলা, নিঃসঙ্গতাসহ নানা জটিল অবস্থার ভেতর দিয়ে দিনযাপন করে। এটা কেবল যে বাংলাদেশেই হচ্ছে তা নয়।
Help Age Global Network -এর তথ্যমতে, বিশ্বব্যাপী প্রতি ৬জন প্রবীণ ব্যক্তির মধ্যে একজন নিপীড়নের শিকার হচ্ছেন। বাংলাদেশের এর সংখ্যা দ্বিগুণের কম নয়। বাংলাদেশে চলমান বিভিন্ন ঘটনায় বৃদ্ধদের প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও অবহেলা বৃদ্ধির চিত্র ক্রমাগত পরিলক্ষিত হচ্ছে।
কেউই নেই যে বৃদ্ধদের অবস্থাটা একটু বুঝবে। একটু আশার বাণী শোনাবে। পরম মমতায় তাদের মাথায় হাত রাখবে এমন কেউ নেই। অথচ এই মানুষটিই এক সময় নিজের কর্মজীবন, সন্তানদের বড় করে তোলা এবং পারিবারিক দায়িত্ব পালন করেছেন কত না সতর্কতার সাথে। কেউ যেন কষ্টে না থাকে, কেউ যেন একটু কষ্ট না পায় তার কত না চেষ্টা করেছেন। বাবা-মা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করেন, ফ্যামিলিকে সারাক্ষণ দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু ফ্যামিলি অনেক সময় বুঝতে চায় না। আর সেই মানুষটিকেই আমরা শেষ বয়সে এসে কত না কষ্ট দেই।
মহসিন খান লাইভে এসে বলেন, ‘আসলে আরেকটা জিনিস দেখলাম যে, পৃথিবীতে আপনিই আপনার। ছেলে বলেন, মেয়ে বলেন, স্ত্রী বলেন কেউই আপনার না। কারণ আজকে আপনি যেভাবে হয়তো আপনার ফ্যামিলিকে মেনটেইন করছেন। কাল যদি আপনি মেনটেইন করতে না পারেন তখনই দেখা যাবে আপনার ওয়াইফের সঙ্গে আপনার দ্বন্দ্ব হবে। আপনার ছেলে বা মেয়ে আপনাকে পছন্দ করছে না। এগুলো কেন করে? ফ্যামিলির লোকজন কেন বুঝতে চায় না? আগে ওয়াইফের বুঝতে হবে।’
মহসিন বলেন, ‘যখন বিয়ে হয় ২৪, ২৫ বা ৩০ বছরের একটা ছেলেকে যে পরিমাণ পরিশ্রম করে উপার্জন করতে হয় পরবর্তীতে তো সে সেটা আর পারে না। তার বয়স হয়। সে পরিশ্রম কম করতে পারে। উপার্জন কমে যায়। সব মিলিয়ে আসলে অনেকদিন ধরেই আমি মানসিকভাবে খুব বিপর্যস্ত। আসলে নিজের ওপর নিজের এতটাই বিতৃষ্ণা এসে গেছে, পৃথিবীতে এখন আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি জানি আমি যদি এখন সুইসাইড করি বা মরে পড়েও থাকি আমি যদি ফেসবুক লাইভে না যাই তাহলে কেউ জানবেও না।’
মহসিন খানের কষ্টটা অনুধাবন করার মতো। তিনি লাইভে বলেছেন, ‘সন্তানদের বোঝা উচিত যে তার বাবা যতক্ষণ পর্যন্ত এফোর্ড করতে পারে... প্রকৃত বাবারা চেষ্টা করে সন্তানদের সেভাবে মানুষ করার জন্য। বাবারা না খেয়েও সন্তানদের খাওয়ানোর চেষ্টা করে। পরিবারকে দেওয়ার চেষ্টা করে। কিন্তু পরিবার অনেক সময় অনেক কিছু বুঝতে চায় না। কেন বুঝতে চায় না, কেন বুঝে না এগুলো আসলে... নিজেকে আর মানায় নিতে পারলাম না।’
প্রতিটি মানুষের পৃথিবীর মুখ দেখার সৌভাগ্য হয় পিতা-মাতার কল্যাণে। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় হলো, এই স্বর্গতুল্য পিতা-মাতা বার্ধক্যে উপনীত হলে আমাদের কাছে বোঝা মনে হয়। ঝামেলা মনে হয়। ফল হিসেবে অনেক পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে জীবন কাটাতে হয়। অনেককেই ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবন কাটাতে হয়। মহসিন খানদের একাকী জীবন কাটাতে হয়। সন্তানেরা নতুন সংসার নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। কেউ কেউ একক বা ক্ষুদ্র পরিবার গড়তে পিতা-মাতাকে দূরে ঠেলে দেন। পিতা-মাতার খোঁজ নেওয়ার ফুরসতটুকু কারও কারও হয় না।
বার্ধক্য মানুষের জীবন চক্রের একটি অপরিহার্য অংশ। আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ফলে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও মানুষের গড় আয়ু বাড়ছে। বাড়ছে প্রবীণদের প্রতি অবহেলা। প্রবীণ জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গৃহীত সরকারি ব্যবস্থাইবা কতটুকু আছে এদেশে। লেখার শুরুতেই তা উল্লেখ করেছি। যা খুব যৎসামান্য।
বৃদ্ধ বয়সে পিতা-মাতাকে সুরক্ষা প্রদানের জন্য ‘পিতা-মাতা ভরণপোষণ আইন, ২০১৩’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই আইন অনুযায়ী প্রত্যেক সন্তানকে তার পিতা-মাতার ভরণ-পোষণ নিশ্চিত করতে হবে, পিতা-মাতার একই সঙ্গে একই স্থানে বসবাস নিশ্চিত করতে হবে, তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাদেরকে কোনো বৃদ্ধনিবাস কিংবা অন্য কোথাও একত্রে কিংবা আলাদাভাবে বসবাস করতে বাধ্য করবে না, তাদের চিকিৎসাসেবা ও পরিচর্যা করবে। তাদের অবর্তমানে বৃদ্ধ দাদা-দাদী, নানা-নানীর ভরণ-পোষণ করবে। তা পালন হচ্ছে কতটা?
সন্তানদের প্রতি পিতা-মাতার অফুরন্ত ভালোবাসা থাকে। তাদের নিয়ে থাকে শত স্বপ্ন। তাদের মুখে হাসি ফোটানোই হয়ে থাকে তাদের জীবনের মূল লক্ষ্য। সন্তানদের সুখে রাখার জন্য পিতা-মাতা কত ত্যাগ শিকার করেন, তা বলা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু সময়ের ব্যবধানে সম্পর্ক বদলে যায়। জন্মদাতা পিতা-মাতাই হয়ে যায় সন্তানদের বোঝা, অবহেলার পাত্র।
বর্তমানে অনেক পরিবারেই বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে চরম অবহেলা ও অবজ্ঞা করা হয়। অনেকে তাদের বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আবার অনেকে তাদেরকে ভয়ভীতি দেখিয়ে সম্পদের মালিকানা নিজের নামে লিখে নেওয়ার চেষ্টা করে। তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে বৃদ্ধ পিতা-মাতারা নানাভাবে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের শিকার হচ্ছেন। অকথ্য লাঞ্ছনা-গঞ্জনা সহ্য না করতে পেরে অনেকে আত্মহত্যার চেষ্টা করে। গণমাধ্যমে আসে এমন সংবাদ। কিন্তু কেন এমন হচ্ছে এর প্রধান কারণ সন্তানের সঠিক শিক্ষা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের অভাব এবং বাস্তবতার অত্যুজ্জ্বল ঝলকানির মোহে শৈশবের স্মৃতিগুলো ভুলে যাওয়া। বৃদ্ধ বয়সে সবাই সন্তানদের কাছ থেকে সদাচরণ প্রত্যাশা করে। এটা সন্তান হিসেবে আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।
মীর আব্দুল আলীম ।। সাংবাদিক