ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতির জীবনে এক অতি গুরুত্বপূর্ণ মাস। একই সঙ্গে শোক এবং উৎসবের মাস এই ফেব্রুয়ারি। তবে শোকের চেয়ে উৎসব বেশি। প্রায় ৭০ বছরের পুরোনো শোকও এখন উদযাপনে রূপ নিয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারি এলে অন্যরকম এক উৎসবের আবহ নিয়ে আসে বাংলাদেশে। শোকের কথাটা আগে বলে নেই। এটা অবশ্য সবারই জানা। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মাতৃভাষার মর্যাদার দাবিতে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকতসহ অনেকেই।

চিত্তরঞ্জন সাহার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার যে উদ্যোগ, তা এখন পরিণত হয়েছে বিশাল এক সাংস্কৃতিক উৎসবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের পুরোটাই এখন ফেব্রুয়ারি ও বইমেলাকেন্দ্রিক।

২১ ফেব্রুয়ারি দিনটিকে আমি শুধু ভাষায় সীমাবদ্ধ রাখতে চাই না। ২১ ফেব্রুয়ারি এলে বাঙালি জাতির মুক্তির আকাঙ্ক্ষার বীজ রোপিত হয়েছিল। বাঙালির ২৩ বছরের মুক্তি সংগ্রামের শুরুটা হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। যার ফলশ্রুতিতে একাত্তরের নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত হয়েছিল বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। আর বাংলাদেশ মানে শুধু একটি মানচিত্র নয়। বাঙালি জাতির চেতনার গঠন, আত্মপরিচয়ের সন্ধানটাও শুরু হয়েছিল ২১ ফেব্রুয়ারি। গত সাত দশকের পথচলায় ফেব্রুয়ারি আর তাই নিছক শোকের মাস নয়। শোককে শক্তিতে পরিণত করে এগিয়ে যাওয়ার মাস। ভাষা-শিল্প-সাহিত্যের বিকাশের মাস। নিজেদের চেনার মাস। 

২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম প্রহর থেকে দিনভর ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে দেশজুড়ে শহীদ মিনারে প্রভাতফেরি করে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর যে সংস্কৃতি তা এখন আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। 

চিত্তরঞ্জন সাহার ব্যক্তিগত উদ্যোগে ফেব্রুয়ারি মাসে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বইমেলার যে উদ্যোগ, তা এখন পরিণত হয়েছে বিশাল এক সাংস্কৃতিক উৎসবে। বাংলাদেশের প্রকাশনা শিল্পের পুরোটাই এখন ফেব্রুয়ারি ও বইমেলাকেন্দ্রিক। ২১ ফেব্রুয়ারির পাশাপাশি পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবস ফেব্রুয়ারিতে এনেছে নতুন রঙ। পহেলা ফাল্গুন আর ভালোবাসা দিবসে বর্ণিল হয়ে ওঠে গোটা বাংলাদেশ।

অন্য সব উৎসবের কথা যদি বাদও দেই, একুশের বইমেলাকে ঘিরে বাংলাদেশের প্রকাশনা, লেখালেখি, জ্ঞান বিকাশের যে মহা আয়োজন তা প্রতিবছর আমাদের নিজেদের নতুন করে চিনতে শেখায়। কিন্তু সেই বইমেলা নিয়েই শুরু হয়েছে দোলাচল। এর দায় অবশ্য অনেকটাই করোনা ভাইরাসের। ২০১৯ সালের শেষ দিনে চীনের উহান প্রদেশে আবিষ্কৃত করোনা ভাইরাস এরই মধ্যে ওলটপালট করে দিয়েছে গোটা বিশ্বকে। প্রায় ৫৭ হাজার মানুষের প্রাণ তো গেছেই, সঙ্গে সঙ্গে বদলে গেছে পুরো পৃথিবীই। বলাই হচ্ছে, পৃথিবী আর কখনো আগের অবস্থায় ফিরে যাবে না। ‘নিউ নরমাল লাইফ’ এই অভ্যস্ত হতে হবে আমাদের। হচ্ছিও অনেকটা।

বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় করোনা মোকাবিলায় বাংলাদেশকে বেশ সফলই বলা যায়। জনগণ হয়তো পুরোপুরি মানেনি, তবে সময়ে সময়ে সরকারের নেওয়া নানা পদক্ষেপ করোনা মোকাবিলায় আমাদের সাহসী করেছে। কিন্তু বেদনার সঙ্গে লক্ষ্য করছি, করোনা মোকাবিলার নামে শিক্ষা-সাহিত্যের ওপরই আঘাতটা আসছে বারবার। সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম থাকবে ওপরের দিকেই। ইউনিসেফ বারবার বললেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হয়নি। এখনও দেশে বাণিজ্য মেলা চলছে মহাসমারোহে। কিন্তু বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। বাণিজ্য মেলা চললেও বইমেলা নিয়ে চলছে নানা অনিশ্চয়তা।

প্রতিবছর ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা শুরু হয়, চলে পুরো ফেব্রুয়ারি মাস। কিন্তু করোনা এসে আর সবকিছুর মত বইমেলার ক্যালেন্ডারও লন্ডভন্ড হয়ে গেছে।
গতবছর বইমেলা হয়েছে মার্চ মাসে। ওলটপালট হয়ে যাওয়া সেই মেলা প্রকাশকদের ব্যবসায়িক ক্ষতির কারণ হয়েছে। এবারও বইমেলার প্রস্তুতির সময়ই করোনার সংক্রমণ বেড়ে যায়। এরই মধ্যে বইমেলা দুই সপ্তাহের জন্য পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। মজাটা হলো বইমেলা পেছানো হলেও বাণিজ্যমেলা কিন্তু বন্ধ করা হয়নি।

শুধু বাণিজ্যমেলা নয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের প্রায় সবকিছুই চলছে স্বাভাবিকভাবে। নির্বাচন হচ্ছে, রাজনৈতিক কর্মসূচি হচ্ছে, শপিং মল খোলা, যানবাহন স্বাভাবিক, স্বাস্থ্যবিধি ছাড়াই মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। লকডাউন আর বিধিনিষেধ এলেই সামনে আসে জীবন-জীবিকার প্রশ্ন। গার্মেন্টস খুলে যায়, শপিং মল খুলে যায়, শিল্প-কারখানা খুলে যায়। যত বাধা শুধু শিক্ষা আর সংস্কৃতিতে, অর্থাৎ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আর বইমেলায়। নীতিনির্ধারকদের সিদ্ধান্তে মনে হচ্ছে করোনাভাইরাস শিক্ষিত ও সচেতন ভাইরাস, এটি যেন শুধু বইমেলা আর স্কুলেই যায়।

যে ভাইরাস গোটা বিশ্বকেই চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে, দুই বছরে কেড়ে নিয়েছে দেশের ২৮ হাজার মানুষের জীবন; তাকে উপেক্ষা করার কথা বলছি না। বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। আর আমাদের সিদ্ধান্তে সামঞ্জস্য থাকতে হবে।

আপাতত বইমেলা দুই সপ্তাহ পিছিয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্তই বহাল। ফেব্রুয়ারি এসে গেলেও বইমেলা আদৌ হবে কিনা সে ব্যাপারে এখনও সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়ূনি। আর ব্যাপারটা তো এমনও নয়, সরকার সিদ্ধান্ত দিল, কাল থেকে বইমেলা, আর সেটা জাদুমন্ত্র বলে হয়ে গেল। বইমেলার জন্য লেখক, প্রকাশক, আয়োজকদের বেশ লম্বা প্রস্তুতি দরকার। বাংলা একাডেমি বরাদ্দ দেবে, প্রকাশকরা স্টল-প্যাভিলিয়ন বানাবে। তার জন্য ন্যূনতম সময় দরকার। লেখকদের প্রস্তুতি না হয় বাদই দিলাম। 

যে ভাইরাস গোটা বিশ্বকেই চিরদিনের জন্য বদলে দিয়েছে, দুই বছরে কেড়ে নিয়েছে দেশের ২৮ হাজার মানুষের জীবন; তাকে উপেক্ষা করার কথা বলছি না। বাঁচতে হলে আমাদের সবাইকেই স্বাস্থ্যবিধি মেনে নতুন জীবনে অভ্যস্ত হতে হবে। আর আমাদের সিদ্ধান্তে সামঞ্জস্য থাকতে হবে। ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত বাণিজ্য মেলা চলতে পারলে, বিভিন্ন নির্বাচন হতে পারলে, অফিস চলতে পারলে; বইমেলা হবে না কেন বা সময়মত হতে পারবে না কেন? সময় মত হওয়ার সময় এখন আর নেই। তবুও আমি চাই ফেব্রুয়ারি মাসেই বইমেলাটি হোক। আমাদের এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে যেন কোনো ছেদ না পড়ে। 

অনেকেই বইমেলায় ভিড় কমাতে টিকিট ব্যবস্থা প্রচলনের দাবি করেছেন। এই দাবির সঙ্গে আমার প্রবল দ্বিমত। বইমেলা হলো প্রাণের মেলা; প্রাণের উচ্ছ্বাসে, জ্ঞানের তাগিদে মানুষ বইমেলায় যায়। এই উচ্ছ্বাসে বাঁধ দেওয়াটা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। টিকিটের ব্যবস্থা করা মানে মানুষকে মেলায় আসতে নিরুৎসাহিত করা। আমি বরং উল্টো মানুষকে উৎসাহিত করতে বইমেলায় যারা আসবেন, তাদের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রণোদনা রাখার দাবি করছি। হতে পারে একটি গোলাপ, একটি মাস্ক বা স্যানিটাইজার বা লটারি করে বই উপহার। করোনা ঠেকাতে বইমেলায় টিকিটের ব্যবস্থা করার দাবি আর মাথা ব্যথায় মাথা কেটে ফেলা সমান কথা।

বইমেলা এখন সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের বিস্তীর্ণ প্রাঙ্গণে হয়। কঠোরভাবে স্বাস্থ্যবিধি পালন করাটাই জরুরি। এমনিতেই বই কেনা এবং পড়ার ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ কমছে। টিকিটের বাধায় সেই আগ্রহ আরো কমানো ঠিক হবে না। ব্যবসা-বাণিজ্য সব চালু থাকবে, স্কুল আর বইমেলা বন্ধ থাকলে; করোনা শেষে আমরা অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী কিন্তু সাংস্কৃতিকভাবে পঙ্গু একটি জাতিতে পরিণত হবো। 

আমি জানি মানুষের জীবনের চেয়ে মূল্যবান কিছু নেই। কিন্তু করোনার ভয়ে বছরের পর বছর সব আটকে রাখাও সমীচিন নয়। নিয়ম মেনে সবকিছুই করতে হবে। বইমেলা, পহেলা ফাল্গুন, ভালোবাসা দিবস, শহীদ দিবস- আমাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কোনো আয়োজনই যেন ম্লান করতে না পারে করোনা। 

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ