জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে সরব বাংলাদেশ। সমর্থনও পাচ্ছি আমরা। কিন্তু মিয়ানমারের দিক থেকে কাঙ্ক্ষিত সাড়া নেই সেই শুরু থেকেই। প্রতিবেশী দেশটির সঙ্গে বিদ্যমান দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্য দিয়েও সংকট নিরসনে আশার আলো দেখি না।

প্রতিবেশী অন্য দেশগুলোর পক্ষ থেকেও কাঙ্ক্ষিত সহযোগিতা পায়নি বাংলাদেশ। সব মিলিয়ে এটিই বোঝা যাচ্ছে যে, রোহিঙ্গা সংকট কাটাতে নিজেদের সক্ষমতা আরও বাড়াতে হবে। সেই লক্ষে কাজও চলছে। তবে সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সংকটও তীব্র হচ্ছে।

বিভিন্ন সময় বিজিবি-বিজিপি’র পতাকা বৈঠকে মিয়ানমারের সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর পক্ষ থেকে প্রায়ই বাংলাদেশের সীমান্তে সশস্ত্র গ্রুপের অস্তিত্বের কথা বলা হয়। বরাবরের মতো বাংলাদেশ তা অস্বীকার করে। অস্বীকার করারই কথা। কারণ এদেশের মাটিকে ব্যবহার করে কোনো ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে সহ্য করবে না বাংলাদেশ। কোনোভাবেই সেই সুযোগ দেওয়া হয় না। হবেও না। এবিষয়ে সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা শীর্ষ পর্যায় থেকে আছে বলেই আমি জানি।

আরও পড়ুন : সীমান্ত সংকট ও মিয়ানমারের সামরিকায়ন : কী করছে বিশ্ব? 

বিভিন্ন সূত্র থেকেও বিষয়টি নিশ্চিতও হওয়া যায়। তবুও কিছু বিদ্রোহী সংগঠনের মুষ্টিমেয় সশস্ত্র সদস্যদের উপস্থিতি মাঝে মাঝে টের পাওয়া যায় সীমান্ত এলাকায়। আর তাদের ঠেকাতে দুর্গম আর বিচ্ছিন্ন সীমান্ত ধরে তৈরি হচ্ছে সীমান্ত সড়ক। এরই মধ্যে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর বিওপি’র সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে। বাড়ানো হয়েছে তদারকি আর গোয়েন্দা নজরদারি।

আরসা নামের একটি সংগঠনের কথা না বললেই নয়। এক সময় আল ইয়াকিন নামে পরিচিত রোহিঙ্গাদের এই বিদ্রোহী সংগঠনটি নিয়ে পরিষ্কার ধারণা থাকা প্রয়োজন। কিন্তু বাস্তবতা হলো যথেস্ট ধারণা আমাদের নেই। সংগঠনটি ২০১৭ এর আগস্ট পূর্ববর্তী সময়ে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের ভেতরে কয়েকটি সশস্ত্র হামলা ঘটায়। তার প্রেক্ষিতেই মিয়ানমারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সেনাবাহিনী হামলা চালায় রোহিঙ্গাদের বসতিগুলোতে। বিশৃঙ্খলা ছড়িয়ে পড়ে পুরো রাখাইন জুড়ে। সাধারণ মানুষদের বাড়ি-ঘর পুড়িয়ে দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ-নির্যাতনে দিশেহারা রোহিঙ্গারা দেশ ছেড়ে চলে আসে বাংলাদেশে।

শরণার্থীদের সঙ্গে আসা আরসা সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে গোপনে গড়ে উঠতে থাকে ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন। অবৈধ অস্ত্র আর ইয়াবার কারবার নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা। ভীতি ছড়িয়ে ক্যাম্পের পরিবেশকে সন্ত্রস্ত করে।

শরণার্থীদের এত বড় চাপ এই প্রথম। অতীতের অভিজ্ঞতা ছাড়িয়ে গেছে এই দফার ইনফ্লাক্স। তার নতুন করে সমস্যার শুরু দেশটিতে আরসার তৎপরতার পর। এরপর সীমান্তে জড়ো হয়েছে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। মানবিক দৃষ্টিতে বিষয়টি দেখেছে বাংলাদেশ। সীমান্ত খুলে দেওয়া হলো। আর বাংলাদেশে আসল নতুন করে সাত লাখ মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিক।

কক্সবাজারের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নেওয়া মানুষেরা তখন ভেবেছিল হয়তো এই আরসাই তাদের উদ্ধার করবে, দেশে ফিরিয়ে নেবে। আমরাও ভাবলাম এবার বোধ হয় কোনো শক্তিশালী সংগঠনের জন্ম হলো রাখাইনে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারকে বুঝি এবার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব দিতে বাধ্য করবে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই ধারণা বদলে যেতে থাকে।

আরও পড়ুন : সীমান্তে গোলাবর্ষণ, রোহিঙ্গা শিবিরে সন্ত্রাসী দল ও আমাদের করণীয়

শরণার্থীদের সঙ্গে আসা আরসা সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে গোপনে গড়ে উঠতে থাকে ক্যাম্পভিত্তিক সংগঠন। অবৈধ অস্ত্র আর ইয়াবার কারবার নিয়ন্ত্রণে নেয় তারা। ভীতি ছড়িয়ে ক্যাম্পের পরিবেশকে সন্ত্রস্ত করে। আরসার প্রতি সাধারণ রোহিঙ্গাদের সমর্থন ভেতরে ভেতরে পাল্টে যেতে থাকে। সমর্থন পরিণত হয় ভীতিতে।

এরপর থেকেই শুরু হয় কর্তৃত্ব স্থাপন আর দাপট টিকিয়ে রাখার লড়াই। যে দাপটে ক্যাম্পের তাবৎ কাজ কারবারসহ অবৈধ রোজগারের কারবারগুলোও তারা নিয়ন্ত্রণে নেয়। মাঝে মধ্যেই ঘটে সংঘর্ষ, খুন-পাল্টা খুন। যার সবশেষ উদাহরণ লাম্বাশিয়া ক্যাম্প এ রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ হত্যাকাণ্ড।

আরসা নামের সংগঠনটির প্রধান আতাউল্লাহ। বিভিন্ন ভাবে আরসা ও এর নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত। তবে তারা কারা? কোথা থেকে এসেছে? উদ্দেশ্য কী? কোথায় অবস্থান করে তারা অধিকার আদায়ের লড়াই করছে? কতজন তাদের সদস্য? এসব নিয়ে পরিষ্কার ধারণা আমাদের নেই।

যদিও ১৬ জানুয়ারি নিষিদ্ধ সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মির (আরসা) প্রধান আতাউল্লাহ আবু জুনুনীর ভাই শাহ আলীকে আটক করেছে আমর্ড পুলিশ ব্যাটালিয়ন (এপিবিএন)। কক্সবাজারের উখিয়ার রোহিঙ্গা ক্যাম্প থেকে আগ্নেয়াস্ত্র ও মাদকসহ তাকে আটক করা হয়।

ক্রমেই নানা দিক থেকে জটিল আকার ধারণ করা এই সীমান্ত অঞ্চলটিকে যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। ১৯৯২/৯৩ সালে কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম জঙ্গি আস্তানা পাওয়া যায় এই উখিয়াতে।

সম্প্রতি গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সংগঠন নিয়ে বেশ তৎপর। তারা যে রোহিঙ্গাদের স্বার্থ আদায়ে কাজ করছে না তা মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত। তাহলে তাদের উদ্দেশ্যটা কী? পাকিস্তানে জন্ম নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে বেড়ে উঠেছে আতাউল্লাহ। মিয়ানমারের মাটির সঙ্গেই যার কোনো সম্পর্ক নেই, সেই নেতা কী করে রাখাইনে এসে বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেবে সেই প্রশ্ন শুরু থেকেই মাথায় ঘুরছে। উত্তর এখনো পাইনি।

বিশ্বের বিভিন্ন সংঘাতময় অঞ্চলে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর উত্থান হয় কীভাবে? বিষয়টি নিয়ে একটু জানা দরকার। আমাদেরও এ নিয়ে প্রচুর কাজ করা প্রয়োজন। শুধু আশ্রয় নেওয়া জনগোষ্ঠীর বাংলাদেশে অবস্থান, ব্যবস্থাপনা এবং স্থানান্তর নিয়ে কাজ করতে করতেই যেন আমরা হাঁপিয়ে উঠছি। আর মাঝে মাঝে আগুন লাগা, ভূমিধস, সংঘর্ষ আর উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিদের হত্যা বা মৃত্যু নিয়ে সংবাদ করছি।

আরও পড়ুন : রোহিঙ্গা : কূটনীতির সুফল মিলবে কবে? 

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা তুলে ধরছি। এত কাজের মধ্য দিয়ে আঞ্চলিক নিরাপত্তার বিষয়টি নিয়ে কাজ পর্যাপ্ত ও সমন্বিত হচ্ছে না বলেই মনে করি।

মনে রাখতে হবে, ক্রমেই নানা দিক থেকে জটিল আকার ধারণ করা এই সীমান্ত অঞ্চলটিকে যে কেউ ব্যবহার করতে পারে। ১৯৯২/৯৩ সালে কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম জঙ্গি আস্তানা পাওয়া যায় এই উখিয়াতে। পুলিশের অভিযানে সেই আস্তানা উৎখাত করা হয়। তারপর দেশে অনেক কিছুই ঘটেছে, ঘটছে।

এ বিষয়ে আমাদের অনেক বেশি কাজ করতে হবে। যেহেতু সংকট অনেক বড় তাই যার যার অবস্থান থেকে বড় করে কাজ করতে হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী সংস্থাগুলোর তৎপরতা বেড়েছে রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোকে ঘিরে। তবে সেই সঙ্গে সংকটগুলো ভিন্ন মাত্রা নিচ্ছে। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সতর্কতা বাড়ছে বাংলাদেশের।

আরও পড়ুন : আরসা’র অস্তিত্ব ও রোহিঙ্গা ক্যাম্পের নিরাপত্তা 

সাংবাদিকতার দিক থেকে বললে প্রতিটি নিউজরুমকে একটি বিশেষ টিম তৈরি করে এই সংকট নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও কাজ করতে হবে। তা না হলে কাজগুলো শেষ পর্যন্ত অর্থবহ হবে না।

অর্থবহ ও কার্যকর সাংবাদিকতা না হলে এই সংকট নিয়ে মানুষ জানতে পারবে না। জনমত গড়ে উঠবে না। বিভ্রান্তি বাড়তেই থাকবে। আর সেই বিভ্রান্তি থেকে নীতি নির্ধারকদের সিদ্ধান্তেও বিভ্রান্তি দেখা দিতে পারে। সেই বিভ্রান্তি বিপর্যস্ত করতে পারে বাংলাদেশকে, এই অঞ্চলকে।
 
মোহসীন-উল হাকিম ।। বিশেষ প্রতিনিধি, যমুনা টেলিভিশন