মুন্সীগঞ্জের গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের শিমুলিয়া গ্রামের এক পরিবারের ভাইবোন মোহন মিয়া, শাহজাহান, মহসিন মিয়া, ইয়ারুন নেসা ও মমতাজ বেগম। এদের মধ্যে মোহন মিয়ার ছেলে শফিকুল ভাটেরচর ভূমি কার্যালয়ে অফিস সহকারী পদে চাকরিরত। শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে জালিয়াতি করে অন্যের জায়গা নিজের নামে রেকর্ড করার অভিযোগ উঠে। ভুক্তভোগী ব্যক্তিরা তার বিরুদ্ধে গত মঙ্গলবার জেলা প্রশাসক বরাবর লিখিত অভিযোগ দিয়েছেন। 
 
গুয়াগাছিয়া ইউনিয়নের পাঁচটি মৌজায় আরএস খতিয়ান অনুযায়ী, সর্বমোট ৫০৫ শতাংশ জমির পৈতৃক সূত্রে মালিক হচ্ছেন উপরের পাঁচ ভাইবোন। তাদের বাবার নাম মৃত আলী সরকার। উত্তরাধিকার সূত্রে মোহন মিয়া ১২৬ শতাংশ জমির মালিক। কিন্তু তার ছেলে শফিকুল গোপনে ভূমি কর্মকর্তার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জালিয়াতি করে তার বাবার নামে ভুয়া কাগজ তৈরি করে ৩০০ শতাংশ জমি নামজারি করিয়ে নেন। পরবর্তী সময়ে বিষয়টি জানাজানি হলে বঞ্চিতরা এর বিরুদ্ধে ভূমি অফিসে রেকর্ড সংশোধন (মিস কেস) মামলা করেন। 
 
উপরের মামলায় অতিরিক্ত ভূমি নামজারির বিষয় প্রমাণিত হলে সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা জামান ৮ জুন ভূমি নামজারির আগেকার আদেশটি বাতিল করেন। এ প্রসঙ্গে ফারজানা জামান গণমাধ্যমকে বলেন, ‘নামজারিতে বেশি সম্পত্তি রেকর্ড হওয়ার বিষয়টি সংশোধন করে দেওয়া হয়েছে।’ অতিরিক্ত সম্পত্তি নামজারির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘সে সময় তো আর আমি ছিলাম না। তারা কীভাবে সেটা করেছে, আমি বলতে পারব না।’
 
উপরের ঘটনায় সহকারী কমিশনারের যে মন্তব্য তাতে তার পূর্ববর্তী সহকারী কমিশনার যে অনিয়মের আশ্রয় নিয়েছিলেন তার ইঙ্গিত মেলে, যার দায় বর্তমান সহকারী কমিশনার (ফারজানা) নিতে চাইছেন না। অন্যথায় ফারজানার কাছ থেকে এ প্রশ্নের উত্তর যথাযথ আইনি ব্যাখ্যায় পাওয়া যেত, তিনি যেভাবে জবাব দিয়েছেন সেভাবে নয়। ফারজানার আগের সহকারী কমিশনারকে এ ব্যাপারে আদৌ কেউ জিজ্ঞাসাবাদ করেছিলেন কি না তা আমাদের জানা নেই। তবে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা যায়, ভূমি কর্মকর্তারা এ ধরনের অনিয়ম ঘটিয়ে কোনোভাবে অন্যত্র বদলি হয়ে যেতে পারলে তাদের আর আগের কৃতকর্মের কৈফিয়ত দেওয়া প্রয়োজন পড়ে না। 
 
দ্বিতীয় ঘটনা বর্তমানে চলমান, মানে সমস্যার সুরাহা আজও হয়নি। ইরতিজা মেরাজ অয়ন নামের এক শিশুকন্যার বাবা-মা বাংলাদেশে গুরুত্বপূর্ণ সরকারি চাকরি করতেন। ইরতিজার দু'বছর বয়সে তারা তার নামে আড়াই কাঠার ছোট্ট একটা প্লট কিনেছিলেন চট্টগ্রামে শেরশাহ কলোনির পাশে সাংবাদিক হাউজিং সোসাইটি থেকে। নোমান নামের এক সাংবাদিক জরুরি অর্থের প্রয়োজনে জমিটি ইরতিজার বাবা-মার কাছে মাত্র কয়েক হাজার টাকায় বিক্রি করেছিলেন। প্রায় দুই যুগ আগে ইরতিজার নামে কেনা সেই জমি এখন কোটি টাকার সম্পদ। মেয়েটি মাত্র ছয় বছর বয়সেই বাবা-মায়ের হাত ধরে কানাডা পাড়ি জমিয়েছিল। তবে তার উচ্চশিক্ষিত বাবা-মা তার নামে জমির নামজারি, খতিয়ান সৃজন ইত্যাদি সম্পন্ন করে ১৯৯৬ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত খাজনা পরিশোধ করেছেন। কয়েক বছর আগে তাদের এক নিকটাত্মীয়ের সহায়তায় প্লটের চারিদিকে ইটের সীমানা দেয়ালও নির্মাণ করা হয়েছে।
 
ইতোমধ্যে নোমান সাহেবের এক মেয়ে আক্তার বেগম, যিনি জমি বিক্রির সময় নাবালিকা ছিলেন, এলএলবি পাস করে দুই যুগ আগে তার বাবার বেচে দেওয়া ইরতিজার সেই জমিটি দখলের ষড়যন্ত্র করেন। এর অংশ হিসেবে শাহেদ নামের স্থানীয় এক ছিঁচকে চোরের সহায়তায় একটি গরু ও একটি ছাগল কিনে ইরতিজার জমিতে সেগুলো লালন পালনের ব্যবস্থা করেন। তাছাড়া তার বাবার নামে নতুন করে জমিটির খাজনা দেওয়ার উদ্যোগ নেন ২০২০ সালে। স্বভাবতই আক্তার বেগম তাতে ব্যর্থ হন। অতঃপর তার ব্যর্থতার বিষয়টি রিপোর্ট করেন ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামনুল সাহেবের দপ্তরে। এভাবেই শুরু হয় ইরতিজার জমি অবৈধ দখল নাটকের মঞ্চায়ন। 
 
সহকারী কমিশনার (ভূমি) অফিসের লোকজনের সহায়তায় কঠোর গোপনীয়তায় ভুয়া নোটিশ জারি, শুনানি সবকিছু সুন্দরভাবে সম্পন্ন করাতে সক্ষম হন আক্তার বেগম। প্রতারণার অংশ হিসাবে রেকর্ডরুম থেকে সুকৌশলে ইরতিজার নামে স্থিত জমির দলিলও গায়েব করে গোপনে থানায় জিডি করা হয়। দলিলে বর্ণিত ইরতিজার স্থায়ী ঠিকানায় ভূমি অফিস থেকে কোনো ধরনের নোটিশ পাঠানো হয়েছে বলে প্রমাণ নেই। ওই প্লটের পাহারার দায়িত্বে থাকা দারোয়ানের সঙ্গে কথা বলে সেখানেও কেউ নোটিশ জারি করেছে বলে শোনা যায়নি। মোটকথা, ইরতিজা বা তার বাবা-মায়ের অগোচরে অতি গোপনে এসব অপকর্ম (তথাকথিত আইনি প্রক্রিয়া) করা হয়েছে। 

এভাবে অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় শুনানি সম্পন্ন করে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামনুল, ইরতিজার খতিয়ান বাতিল ঘোষণা করে ২৪ বছর আগের মালিক, আক্তার বেগমের বাবা মরহুম নোমান সাহেবের নামে খতিয়ান বলবৎ করে দেন।
 
রহস্যজনক কারণে সহকারী কমিশনার (ভূমি) একবারও জানতে চাইলেন না, দুই যুগেরও বেশি সময় পর হঠাৎ আক্তার বেগম কি মনে করে তার বাবার বেচে দেওয়া জমির খাজনা দিতে গেলেন? তার মাথায় এ চিন্তাও এলো না, কি প্রক্রিয়ায় বা কোন দলিলমূলে ইরতিজা টানা চব্বিশ বছর এই জমির খাজনা দিতে পেরেছেন বা সংশ্লিষ্ট সরকারি অফিস কেনইবা তার নামে বছরের পর বছর এ জমির খাজনা জমা নিল? এ তরুণ কর্মকর্তা এতটাই ঘোরে ছিলেন যে কোটি টাকা মূল্যের একটা জমির খতিয়ান বাতিলে তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা নেওয়ার চিন্তাও বিবেচনায় আনলেন না। ইরতিজার না হয়ে তার নিজের বা তার কোনো স্বজনের জমি হলে তিনি কি খতিয়ান বাতিলের আগে এসব বিষয় একবারও ভাবতেন না? দেশের সাধারণ মানুষের স্বার্থ রক্ষায় তিনি কেন কোনো দায়িত্ববোধ অনুভব করলেন না? 
 
সহকারী কমিশনার পদটি একটি এন্ট্রি লেভেলের সরকারি কর্মকর্তার পদ। প্রশ্ন জাগে, এমন নিম্ন পর্যায়ের একজন কর্মকর্তা কি কেবল নিজের সিদ্ধান্তেই কারো কোটি টাকার সম্পদের মালিকানা বা খতিয়ান বাতিল করার আইনি এখতিয়ার রাখেন? এক্ষেত্রে প্রভাবিত হয়ে তিনি নিজ এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে কিছু করেননি তো? তাছাড়া পর্যাপ্ত যাচাই না করে একটি মূল্যবান জমির প্রকৃত মালিকের এতো পুরোনো একটা খতিয়ান অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় বাতিলের বিষয়টি কি ভূমি প্রশাসন বিষয়ে তার অজ্ঞতা, অদক্ষতা, অযোগ্যতা বা প্রভাবিত হওয়ার ইঙ্গিত বহন করে না? সর্বোপরি, তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিসিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়া অসাধারণ মেধাবী তরুণ, সহকারী কমিশনার (ভূমি) মামনুল, খতিয়ান বাতিলের এ ঘটনায় কতখানি মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন তাও খতিয়ে দেখার অবকাশ আছে বৈকি!  
 
একসূত্রে জানা যায়, অন্যত্র বদলি হওয়ার কিছুদিন আগে তিনি ইরতিজার খতিয়ানের বাতিলাদেশ জারি করে নিজের বদলি ত্বরান্বিত করতে কেন্দ্রে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। তার বদলির পর সহকারী কমিশনার (ভূমি) পদে নতুন যিনি দায়িত্ব নেবেন তার কাছে এই গুরুতর অনিয়মের কারণ জানতে চাওয়া হলে তিনিও হয়তো মুন্সীগঞ্জের সহকারী কমিশনার (ভূমি) ফারজানা জামানের মতো বলবেন, ‘সে সময় তো আর আমি ছিলাম না। তারা কীভাবে সেটা করেছে, আমি বলতে পারব না।’ সঙ্গত কারণেই, আগে কারা কি করেছেন তার তদন্ত হয়তো কোনোদিনও হবে না। এই হলো বাংলাদেশের বর্তমান ভূমি ব্যবস্থাপনার হালচাল। দুর্ভাগ্যজনকভাবে সত্য, সাধারণ মানুষ, বিশেষত প্রবাসী রেমিট্যান্স যোদ্ধারাই, এসব ভূমি দস্যুতা ও প্রতারণার সবচেয়ে বড় শিকার।
 
কানাডায় প্রথম শ্রেণি থেকে পড়াশোনা করা সেই ইরতিজা যখন যে বিদ্যালয়ে পড়েছে সেখানেই অসাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছে। পড়াশোনার পাশাপাশি সে একজন ভালো লেখক এবং চিত্রকরও। কানাডায় ডাক্তারিতে ভর্তি হওয়া খুব কঠিন। কঠোর পরিশ্রম ও সাধনায় সে কাজটিই এই মেয়ে সফলভাবে করেছে। কানাডার আলবার্টা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর অব মেডিসিন (এমডি) ডিগ্রি করে সে এখন ব্রিটিশ কলাম্বিয়া প্রদেশের এক হাসপাতালে মানসিক রোগ বিশেষজ্ঞ (সাইকিয়াট্রিস্ট) হতে চলেছে। ইরতিজা কানাডার যেখানে গেছে সেখানে বাংলাদেশের নাম সগৌরবে উচ্চারিত হয়েছে। অথচ, সেই মেয়েটিই আজ এ জঘন্য প্রতারণার শিকার।
 
ইরতিজা বাংলাদেশ ও কানাডার দ্বৈত নাগরিক। কানাডার মাটিতে বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করা এই মেয়েটিকে তার জন্মভূমি বাংলাদেশে অতি লোভী কিছু মানুষ এ ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটিয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কতটা নেতিবাচক ধারণা দিচ্ছেন তা ভাবতেও লজ্জা হয়। এতকাল ধরে মাতৃভূমি বাংলাদেশ সম্পর্কে তার বাবা-মার দেওয়া ইতিবাচক মনোভাব তার কাছে মারাত্মক প্রশ্নের মুখে এ কারণে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ভুক্তভোগী হিসেবে সে যারপরনাই মর্মাহত এবং একই সঙ্গে সংক্ষুদ্ধ। তার নামে বাংলাদেশের আর কোথাও কোনো জমি নেই। অর্থাৎ আক্তার বেগম গং সরকারি অফিসের সহায়তায় বৈধ খতিয়ান বাতিল করে কার্যত ইরতিজাকে ভূমিহীন বা উদ্বাস্তুতে পরিণত করেছেন। এ লেখার মাধ্যমে ইরতিজার সঙ্গে ঘটে যাওয়া এ ন্যাক্কারজনক ঘটনায় ভূমিমন্ত্রীর দ্রুত হস্তক্ষেপ কামনা করছি এবং যুগপৎ ইরতিজার খতিয়ান পুনর্বহালেরও দাবি রইল। এ বিষয়ে সহায়তা দিতে আগ্রহীরা ইরতিজার পক্ষে আমার Lgani2001@yahoo.com ই-মেইলে যোগাযোগ করতে পারেন, বা আমার ফেসবুক ML Gani আইডিতে যোগাযোগ করতে পারেন।
 
উপরের দুই ঘটনার একটির ভুক্তভোগী মুন্সীগঞ্জের এক পরিবার, আর অন্যটি কানাডা প্রবাসী ডা. ইরতিজা মেরাজ অয়ন। ঘটনা দুটি বাংলাদেশের ভূমি অফিসগুলোতে প্রতিদিন ঘটে যাওয়া হাজারো অনিয়মের নমুনামাত্র। ভূমি প্রশাসনকে কার্যকরভাবে ডিজিটাল  ব্যবস্থার অধীনে আনা সম্ভব হলে এভাবে নথি গায়েব, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় নোটিশ জারি, গোপন শুনানি, ইত্যাদির সুযোগ অনেকাংশেই বন্ধ হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বাস্তুহারা হয়ে নিরাপরাধ মানুষকেও কোর্ট-কাচারিতে দৌড়াদৌড়ি করতে হয় না। উন্নত দেশগুলোতে জমির খাজনা দেওয়া থেকে শুরু করে ভূমি প্রশাসনের সিংহভাগ কাজই অনলাইনে সম্পন্ন হয়।
 
ডিজিটাল বাংলাদেশ গত দশ বছরে জনসেবার অনেক দিক ছুঁয়েছে, কিন্তু ভূমি প্রশাসনে ততোটা নয়। অথচ গুরুত্ব বিবেচনায় ভূমি প্রশাসন অন্য সবকিছুর আগে ডিজিটাল ব্যবস্থার আওতায় আসা উচিত ছিল। ভূমি প্রশাসনের অস্বচ্ছতা এবং জটিলতার সুযোগ নিয়ে যুগযুগ ধরে নিরীহ জনগণ হয়রানির শিকার হয়ে আসছেন। তবে স্বার্থান্বেষী গোষ্ঠীগুলো ডিজিটাল ব্যবস্থার মতো যুগান্তকারী পদক্ষেপের বিরোধিতা করবে এমনটাই স্বাভাবিক। কেননা ডিজিটাল ব্যবস্থায় ঘোলা জলে মাছ শিকারের সুযোগ তেমন থাকে না। এ অরাজকতা কাটাতে ভূমি প্রশাসনসহ সব নাগরিক সেবা উন্নতদেশের আদলে কার্যকর ডিজিটাল ব্যবস্থায় আনা আজ সময়ের দাবি। 
 
এম এল গনি, আরসিআইসি, কানাডিয়ান ইমিগ্রেশন কনসালটেন্ট ও কলামিস্ট

জেডএস