করোনার তৃতীয় ঢেউ, স্ববিরোধিতা ও সমন্বয়হীনতার পাঁচালী
করোনার তৃতীয় ঢেউ সুনামির শক্তি নিয়ে বাংলাদেশে আঘাত হেনেছে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে রোগীর সংখ্যা। হাসপাতালের শয্যাগুলো প্রায় পরিপূর্ণ। যে হারে সংক্রমণ বাড়ছে তাতে আগামী কয়েকদিনের মধ্যে হাসপাতালগুলোর ধারণক্ষমতা নিঃশেষ হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এই তৃতীয় ঢেউয়ের মূল সংহারক শক্তি হলো, করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট।
করোনা মহামারির বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক সংক্রমণ প্রবাহের ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশে তৃতীয় ঢেউ আঘাত হেনেছে। বিষয়টি আগে থেকে অনুমান করা হচ্ছিল। তবে এই ঢেউয়ের সময়কাল নিয়ে দুই ধরনের মত ছিল। ভারতীয় স্বাস্থ্য বিজ্ঞানীদের অনুমান ছিল, ২০২১-র অক্টোবরে সেদেশে করোনা বাড়বে। এই বিষয়টি বিবেচনায় রেখে ধারণা করা হয়েছিল, বাংলাদেশে করোনার সংক্রমণ অক্টোবরের শেষ নাগাদ অথবা নভেম্বরের প্রথম দিকে বাড়তে শুরু করবে। তবে বাস্তবে অনুমিত সময়ের মোটামুটি একমাস পরে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়।
বিজ্ঞাপন
দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ কিন্তু কওমি ও হাফেজিয়া মাদরাসা প্রভৃতি কেন খোলা তার কোনো সদুত্তর কোনো কর্তৃপক্ষ অবশ্য এখনো প্রদান করেনি। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো কিন্তু নানা পর্যায়ের নির্বাচন, বাণিজ্য মেলা, পিঠা উৎসব, ওয়াজ মাহফিল, রাজনৈতিক সমাবেশ ইত্যাদি অবাধে অনুষ্ঠিত হতে থাকল।
বাংলাদেশে করোনার প্রথম ও দ্বিতীয় ঢেউ শুরু হয়েছিল যথাক্রমে ২০ ও ২১ সালের মার্চ মাসে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে অনেকে ভেবেছিল ২২ সালের মার্চ মাসে তৃতীয় ঢেউ শুরু হতে পারে। বলাবাহুল্য তার আগেই দেশে করোনার তাণ্ডব শুরু হয়ে গিয়েছে।
করোনাভাইরাসের ওমিক্রন ভ্যারিয়েন্ট বা ধরন প্রথম শনাক্ত হয় দক্ষিণ আফ্রিকায়। ওমিক্রনের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এটি আগের সবধরনের ভ্যারিয়েন্ট থেকে কয়েকগুণ দ্রুত গতিতে ছড়িয়ে পড়তে পারে। বাস্তবে তাই ঘটছে। বিদ্যুৎ গতিতে সারা পৃথিবীতে ওমিক্রনের বিস্তার ঘটছে। গত ডিসেম্বরের ১১ তারিখে দেশে প্রথমবারের মতো দুইজন ওমিক্রন রোগী শনাক্ত হয়।
চলমান জানুয়ারি মাসের শুরু থেকে ওমিক্রন স্বরূপে আত্মপ্রকাশ করতে শুরু করে। এই প্রেক্ষাপটে ৪ জানুয়ারি স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ১৫ দফা নির্দেশনা প্রদান করে। দেশে করোনা মহামারি চলাকালে সংক্রামক রোগ (প্রতিরোধ, নিয়ন্ত্রণ ও নির্মূল) আইন, ২০১৮ বলবৎ করা হয়। এই আইনের প্রাধান্য নির্দেশ করে এর ৩ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, ‘আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে যাহা কিছুই থাকুক না কেন, এই আইনের বিধানাবলি প্রাধান্য পাইবে।’
আইনটির প্রয়োগের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে মূল চালকের আসনে বসানো হয়েছে। অথচ আমরা অর্থাৎ এদেশের আমজনতা দেখতে পেলাম স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ১৫ দফা নির্দেশনা বাস্তবায়নের সাথে যুক্ত অধিকাংশ পক্ষ নির্দেশনাগুলোকে আমলে নিল না। অতঃপর ১১ জানুয়ারি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে ১৩ জানুয়ারি কার্যকর হওয়া সাপেক্ষে করোনা প্রতিরোধে বিধি-নিষেধ সম্বলিত ১১ দফা নির্দেশনা জারি করা হয়। জানানো হয়, আপাতত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা থাকবে, তবে অতিদ্রুত ১২ এবং তদূর্ধ্ব বয়সের শিক্ষার্থীদের দুই ডোজ টিকা প্রদান করা হবে। তবে যেসব শিক্ষার্থী অন্তত এক ডোজ টিকা পেয়েছে কেবল তারাই বিদ্যালয়ে যেতে পারবে। গত ২১ জানুয়ারি দেশের সকল স্কুল- কলেজ ও সমপর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ২১ জানুয়ারি থেকে ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত বন্ধ ঘোষণা করে প্রজ্ঞাপন জারি করে মন্ত্রিপরিষদের বিভাগের জেলা ও মাঠ প্রশাসন অধিশাখা।
দেশের মানুষের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনো টিকা পায়নি। কেউ এক ডোজ, কেউ দুই ডোজ এবং একটি ক্ষুদ্র অংশ তিন ডোজ পেয়েছে। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি লোক জমায়েত হতে পারবে না। অন্যদিকে বাণিজ্য মেলায় হাজার হাজার লোক যেতে পারবে।
এ প্রসঙ্গে আমজনতা মনে করতেই পারে স্কুল কলেজ বন্ধ করার প্রজ্ঞাপন জারির আগের দিনে করোনা বিষয়ক জাতীয় কারিগরি ও পরামর্শক কমিটি মত প্রকাশ করেছিল, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো করোনা সংক্রমণের হটস্পট নয়’।
দেশে স্কুল-কলেজ বন্ধ কিন্তু কওমি ও হাফেজিয়া মাদরাসা প্রভৃতি কেন খোলা তার কোনো সদুত্তর কোনো কর্তৃপক্ষ অবশ্য এখনো প্রদান করেনি।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হলো কিন্তু নানা পর্যায়ের নির্বাচন, বাণিজ্য মেলা, পিঠা উৎসব, ওয়াজ মাহফিল, রাজনৈতিক সমাবেশ ইত্যাদি অবাধে অনুষ্ঠিত হতে থাকল। যেন একদিকে করোনা প্রতিরোধের বিধি-নিষেধ জারি আবার অন্যদিকে করোনা বিস্তারের বিস্তর আয়োজন মহা-উৎসাহে করা হচ্ছে।
করোনার টিকা বিষয়ক ব্যাপারটি ইতিমধ্যে ব্যাপক জটিলতায় জড়িয়ে গিয়েছে। প্রায় পাঁচ কোটির মতো মানুষ জাতীয় পরিচয়পত্র, জন্ম নিবন্ধন সনদ, অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল ফোন না-থাকা, নিবন্ধন করার অক্ষমতা ইত্যাদি জটিলতায় নিবন্ধন করতে পারেনি। তাদের ক্ষেত্রে কীভাবে টিকা দেওয়া হবে সেটা এখনো নির্ধারিত হয়নি।
দেশের মানুষের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ কোনো টিকা পায়নি। কেউ এক ডোজ, কেউ দুই ডোজ এবং একটি ক্ষুদ্র অংশ তিন ডোজ পেয়েছে। কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে ১০০ জনের বেশি লোক জমায়েত হতে পারবে না। অন্যদিকে বাণিজ্য মেলায় হাজার হাজার লোক যেতে পারবে।
দুই ডোজ টিকা নিয়ে সামাজিক অনুষ্ঠান বা বাণিজ্য মেলায় যাওয়া যাবে কিন্তু স্কুল-কলেজে যাওয়া যাবে না। অন্যদিকে কোনো টিকা না নিয়ে অনায়াসে মাদরাসা মক্তবে যাওয়া যাচ্ছে। দুই ডোজ টিকার সনদ ব্যতীত হোটেল-রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া যাবে না কিন্তু এক-তৃতীয়াংশ হোটেল-রেস্টুরেন্ট কর্মীগণ কোনো টিকা পায়নি।
গণপরিবহনের প্রায় ৭০ শতাংশ শ্রমিক এক ডোজ টিকাও নিতে পারেনি। এরকম আরও অনেক উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। মোদ্দা কথা, সবকিছু মিলে একটি হ-য-ব-র-ল তৈরি হয়েছে। করোনা মহামারির দুই বছর পার হওয়ার পর দেশবাসী একটি সুসমন্বিত ও দক্ষ ব্যবস্থাপনা প্রত্যাশা করেছিল। কিন্তু সবাই দেখছে তিমিরের ঘনত্ব একইরকম রয়ে গিয়েছে।
করোনার টিকা নিলে কি ওমিক্রনের আক্রমণকে রুখে দেওয়া যায়? টিকা নেওয়ার ফলে ওমিক্রনের আক্রমণকে পুরোপুরি থামিয়ে দেওয়া যায় না। তবে টিকা প্রাপ্তরা আক্রান্ত হলেও সেটা হবে মৃদু, তাদের খুব কম অংশকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে।
টিকাপ্রাপ্ত ওমিক্রন আক্রান্তদের মধ্যে মৃত্যুর হার অত্যন্ত কম, তাদের আইসিইউ-তে কম যেতে হয়। করোনার বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত মাস্ক পরা ও স্বাস্থ্যবিধির সঙ্গে একমাত্র টিকাই হচ্ছে কার্যকর অস্ত্র। অতএব টিকা সবাইকে নিতে হবে।
ডা. লেলিন চৌধুরী ।। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ