ছবি : সংগৃহীত

সময় ধরে পেছন দিকে তাকিয়ে একটা জিনিস হঠাৎ মনে হলো। এই দেশে খারাপের অনেক চাহিদা। পরীক্ষিত খারাপের চাহিদা আরও বেশি। যেমন ধরুন, কোনো এক উঠতি মাস্তান কাউকে খুন করে ফেলল। তার কিন্তু অনেক কদর।

সরকার দলীয় এমপি, মন্ত্রীদের কাছে এমন মানুষদের খুব চাহিদা। তারা তাদের ক্ষমতা দিয়ে রক্ষার নামে তাদেরকে আসলে মেরে ফেলে। তাদেরকে আপাত বাঁচিয়ে তাদের দিয়ে আরও বড় বড় অন্যায় করিয়ে নেতারা হয়ে ওঠেন আরও বড় গডফাদার। আর যাদের রক্ষা করছে তারা হয়ে উঠে আরও দুর্বল। তারা রক্ষিত হয়ে অরক্ষিত হয়ে যায়।

ঠিক একই ঘটনা ঘটছে আমাদের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগের ক্ষেত্রে। গত ১০ বছর ধরে একটা নতুন ট্রেন্ড হয়ে গিয়েছে যে, যেই ভিসি যত বেশি দলান্ধতাকে বিক্রি করে বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি করেছে তারাই দ্বিতীয় মেয়াদে আবার ভিসি নিয়োগ পেয়েছে। দ্বিতীয় মেয়াদে নিয়োগ যেন দলান্ধতা প্রমাণের পুরস্কার। 

আরও পড়ুন : বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্ররাজনীতি কতটা যৌক্তিক? 

প্রথমত ৭৩ এর অধ্যাদেশে অনেক ভালোকিছুর মাঝে খুব খারাপ কিছু নিয়মও আছে। এর মধ্যে নির্বাচনের মাধ্যমে উপাচার্য ও ডিন নিয়োগ হলো চরম খারাপ একটা ব্যবস্থা। বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি জায়গা যেখানে মেধা প্রমাণের মাধ্যমে মেধাবীদের সকল ক্ষেত্রে নেতৃত্বে আসার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটির ক্ষমতা বা দায়িত্বকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। বাংলাদেশে উপাচার্যদের যেই ক্ষমতা এত ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবেন না।

বিশ্ববিদ্যালয় এমন একটি জায়গা যেখানে শিক্ষক নিয়োগ এবং প্রমোশনের নিয়মকে সদা উপরে উঠাতে হয়। কিন্তু নির্বাচন যারা করে তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিতে হয় কীভাবে সেই নিয়মকে আরও সহজ করা যায়। একটা সময় ছিল যখন নিয়োগ বা প্রমোশনে বড় বড় স্কলারদের সুপারিশ নেওয়া হতো।

সত্যেন বোসের অধ্যাপক হওয়ার সময় স্বয়ং আইনস্টাইন সুপারিশ পত্র দিয়েছিলেন। নিয়োগ ও প্রমোশন বোর্ডে স্কলারদের রাখা হতো। এমনকি মতামতের জন্য প্রার্থীদের দরখাস্ত বিদেশি স্কলারদের কাছেও পাঠানো হতো। কোথায় সারা পৃথিবীর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নিয়োগ এবং প্রমোশনের নীতিমালাকে আস্তে আস্তে উপরে উঠাতে উঠাতে এখন এমন হয়েছে যে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হওয়ার ন্যূনতম যোগ্যতা পিএইচডি।

অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি ডিগ্রিও যথেষ্ট না। সাথে পোস্ট ডক্টরাল অভিজ্ঞতাও লাগে। আবার অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতাও যথেষ্ট না। একাধিক পোস্ট-ডক্টরাল অভিজ্ঞতা লাগে। ওগুলো থাকা সত্ত্বেও প্রথম ধাপেই স্থায়ী পদ পায় না। প্রথমে অস্থায়ী পদে নিয়োগ দিয়ে তারপর যোগ্যতার প্রমাণ সাপেক্ষে স্থায়ী নিয়োগ পান। 

আরও পড়ুন : শাবিপ্রবি উপাচার্য : বিস্ময়কর ক্ষমতাবান

এখন ডিন এবং উপাচার্য নিয়োগ যদি নির্বাচনের মাধ্যমে হয় তাহলে ভোট পেতে হলে মন জুগিয়ে চলে জনপ্রিয় হতে হবে। ভোটারদের কাছে গিয়ে সকল কিছু সহজীকরণের প্রতিশ্রুত দিতে হবে। ধরুন, সহযোগী অধ্যাপক থেকে অধ্যাপক হতে বর্তমানে ১২টি প্রকাশিত গবেষণা প্রবন্ধ লাগে।

এখন যদি কেউ শিক্ষকদের আশ্বাস দেওয়া হয় ১২টির জায়গায় ৫টি হলেই চলবে, পিএইচডি ডিগ্রি না থাকলেও চলবে তাহলে সেই হবে জনপ্রিয়। কিন্তু এতে কি প্রতিষ্ঠানের জন্য ভালো হবে? যেখানে জ্ঞানের চর্চা হওয়া দরকার সেখানে নির্বাচন থাকতে পারে না। সেই জন্যই ডিন ও উপাচার্য নির্বাচনে শক্তিশালী সার্চ কমিটির মাধ্যমে হওয়া উচিত। যেই কমিটিতে থাকবে দেশ ও বিদেশের বিখ্যাত স্কলাররা।

একই সাথে বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদটির ক্ষমতা বা দায়িত্বকে ঢেলে সাজানোর সময় এসেছে। বাংলাদেশে উপাচার্যদের যেই ক্ষমতা এত ক্ষমতা পৃথিবীর কোনো দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পাবেন না। পৃথিবীর যেকোনো একটি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বা প্রো-উপাচার্য সকল নিয়োগ কমিটির প্রধান থাকেন?

উপাচার্য হলো, সম্পূর্ণ প্রশাসনিক একটি পদ। যার কাজ শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড বাড়ানো যায়, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায় সেই জন্য কাজ করা।

পৃথিবীর এমন আরেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম বলুন যেখানে বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা থেকে শুরু করে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন করতে হয় উপাচার্যকে। মোট কথা, উপাচার্যের এমন ক্ষমতা যেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গাছের পাতাও উপাচার্যের ইশারা ছাড়া পড়ে না। এত ক্ষমতা একটি পদে! এত ক্ষমতাই বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য কাল হয়েছে। সরকার মনে করে এই একটি মানুষকে নিয়ন্ত্রণ করলেই তো গোটা বিশ্ববিদ্যালয়কে নিয়ন্ত্রণ করা যায়।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো সিস্টেমই যেন একটি স্বৈরাচারী সিস্টেম। শিক্ষক নিয়োগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি কম্পোনেন্ট। শিক্ষকদের মানের উপরই বিশ্ববিদ্যালয়ের মান নির্ভর করে।

হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক দিয়ে অদলবদল করা হয় তাহলে এক লাফে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান অনেক উপরে উঠে যাবে আর হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় নেমে যাবে অনেক নিচে। যেটা যত বেশি গুরুত্বপূর্ণ তার নিয়োগ প্রক্রিয়া কেবল ২০ মিনিটের একটি ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে হতে পারে না। এটি হওয়ার জন্য অনেকগুলো ধাপ থাকা উচিত।

আরও পড়ুন : শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার, আমাদের মানসিকতা ও বাস্তবতা

প্রতিটি ধাপেই প্রার্থীদের শর্টলিস্ট করতে করতে একেবারে চূড়ান্ত নিয়োগের বোর্ডে উপাচার্য থাকতে পারেন। অনেকগুলো ধাপ থাকলেই শিক্ষক নিয়োগ ও প্রমোশনে রাজনীতিকরণ কমে যেত। পৃথিবীর যেকোনো একটি ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে শিক্ষার্থীদের জিজ্ঞেস করে দেখুন তো কতজন তাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের নাম জানে?

উপাচার্য হলো, সম্পূর্ণ প্রশাসনিক একটি পদ। যার কাজ শিক্ষক, গবেষক ও শিক্ষার্থীদের জন্য শিক্ষা ও গবেষণার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করা। কীভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড বাড়ানো যায়, গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা যায় সেই জন্য কাজ করা। উপাচার্যের কাজ হলো শিক্ষার্থীদের আবাসিক ব্যবস্থা কীভাবে ভালো করা যায় সেই জন্য কাজ করা। আমাদের উপাচার্যরা কি দেখে না আমাদের শিক্ষার্থীরা কী রকম মানবেতর জীবন যাপন করে?

সরকার এমন শিক্ষকদের উপাচার্য বানায় যারা কোনো প্রকার দাবি করে সরকারকে যেন বিব্রত না করে। তাই আন্দোলনের পর আন্দোলন হবে। এতে উপাচার্যের পর উপাচার্য আসবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিবর্তন আসবে না।

চারজনের থাকার ব্যবস্থা আছে এইরকম একটা রুমে ৪০ থেকে ৫০ জন থাকে। আমি নিশ্চিত আমাদের উপাচার্যরা অন্তত জানেন পড়াশোনার জন্য ন্যূনতম কী রকম একটি পরিবেশ লাগে। সবকিছু জেনেবুঝেও আমরা কি কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো উপাচার্যকে সরকারের কাছে বরাদ্দ বৃদ্ধির দাবি জানিয়েছে?

এই ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নেতৃত্ব দিতে পারতো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য যদি বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল শিক্ষকদের নিয়ে সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের কাছে দাবি জানায় যে ৭০০-৮০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ চলতে পারে না।

আমাদের শিক্ষার্থীরা এত অমানবিকভাবে থাকতে পারে না। এইভাবে রেখে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পটেনশিয়ালকে নষ্ট হতে দিতে পারি না। গত ২০ বছরে বাংলাদেশ অর্থনৈতিকভাবে অনেক এগিয়েছে। কিন্তু তার প্রতিফলন কি শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দে পড়েছে? গত ৪০ বছর ধরেই শিক্ষায় জিডিপির ১.৮% থেকে ২.১% এর মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে। অথচ ইউনেসকো বলছে, একটি দেশকে উন্নত হতে হলে শিক্ষায় জিডিপির ন্যূনতম ৫.৫% বরাদ্দ দেওয়া উচিত।

আরও পড়ুন : শিক্ষার সংকটের একটি দিক

এত বড় একটা ন্যায্য দাবি কি কখনো আমাদের উপাচার্যরা করেছে? এই দাবি কোনো উপাচার্য যেন না করে সেই জন্যই তো দলান্ধ উপাচার্য নিয়োগ দেয়। সরকার এমন শিক্ষকদের উপাচার্য বানায় যারা কোনো প্রকার দাবি করে সরকারকে যেন বিব্রত না করে। 

তাই আন্দোলনের পর আন্দোলন হবে। এতে উপাচার্যের পর উপাচার্য আসবে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো পরিবর্তন আসবে না। পরিবর্তন আনতে হলে আমাদেরকে উপাচার্য নিয়োগ পদ্ধতি এবং উপাচার্যের ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ দরকার।

দেশের মঙ্গল চাইলে উপাচার্য নিয়োগে রাজনীতি একেবারে বন্ধ করা উচিত। সত্যি বলতে কি, শিক্ষা ক্ষেত্রে জাতীয় রাজনীতি একদম থাকা উচিত না। রাজনীতি থাকবে কিন্তু সেটা ক্ষমতাকেন্দ্রিক না। সেটা হবে ছাত্রদের রাজনীতি, সেটা হবে শিক্ষকদের রাজনীতি। যেই রাজনীতির মাধ্যমে দেশে শিক্ষা ও গবেষণার মানের উন্নয়ন ঘটবে।

বর্তমানে তো বঙ্গবন্ধুর আওয়ামীলীগ ক্ষমতায়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধু কাদের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন এবং কীভাবে আর কেমন করে অনুনয় বিনয় করে নিয়োগ দিয়েছিলেন একটু খোঁজ নিয়ে জানুন। যাদেরকে নিয়োগ দিয়েছিলেন তারা প্রস্তাব পাওয়ার পর প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া ছিল না।

বঙ্গবন্ধু তখন তাদের বলেছিলেন, আপনারা যদি দায়িত্ব না নেন তাহলে আমি দেশ গড়ব কীভাবে? এইভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। আর সেই দায়িত্ব দেওয়া এখন হয়ে ক্ষমতা দেওয়া। এখানেই সমস্যার মূল। আমাদের এমন মানুষকে খুঁজে বের করতে যিনি উপাচার্য পদটিকে দায়িত্ব মনে করবেন।

ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়