দেশে করোনা সংক্রমণের ফলে জ্যামিতিক হারে রোগী বাড়ছে। ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত করোনা শনাক্তের যে হার ১ শতাংশের ঘরে ছিল তা সোমবার (২৪ জানুয়ারি) দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক ৩৭ শতাংশে। গত এক সপ্তাহে (১৭ জানুয়ারি-২৩ জানুয়ারি) করোনা সংক্রমণ বেড়েছে ১৮০ শতাংশ। একইসঙ্গে ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বেড়েছে ৮৮ শতাংশ। হাসপাতালে এক সপ্তাহে রোগী বেড়েছে ৬২ শতাংশের বেশি। 

হাসপাতালে যারা ভর্তি হচ্ছেন তারা করোনার ডেল্টা ধরনে বেশি আক্রান্ত। এর অর্থ হচ্ছে ওমিক্রনের পাশাপাশি ডেল্টা ধরনও সক্রিয়। ওমিক্রন সুনামির কারণে সংক্রমণ যেভাবে বাড়ছে তাতে আগের সব রেকর্ড ভেঙে যাওয়ার আশঙ্কা আছে। এখন মৃত্যু তুলনামূলক কম থাকলেও নতুন রোগী বাড়তে থাকায় সামনে মৃত্যুও বেড়ে যেতে পারে এবং তাতে করে আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপরে ভয়ংকর চাপ পড়বে। এক্ষেত্রে হাসপাতালের সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রথমে আমাদের সংক্রমণ প্রতিরোধে নজর দিতে হবে। যেসব রোগীর শারীরিক অবস্থা আশঙ্কাজনক নয়, তাদের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন নেই, বরং কমিউনিটি আইসোলেশনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এতে রোগী ব্যবস্থাপনা সহজ হবে। 

গত দুই বছরের অভিজ্ঞতার আলোকে জনস্বাস্থ্যবিদদের মতে, বাংলাদেশের মতো অধিক জনসংখ্যার দেশে কীভাবে করোনা মোকাবিলা করতে হবে তা পরিকল্পনা এবং বাস্তবায়নে সমন্বয়হীনতার ঘাটতি লক্ষ করা যাচ্ছে। অফিস-আদালত খোলা রেখে গণপরিবহনে অর্ধেক যাত্রী বহনের সিদ্ধান্ত কীভাবে বাস্তবায়ন করা সম্ভব? 

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকলেও বাণিজ্য মেলা, বিপিএল চলছে এবং পর্যটন কেন্দ্র, শপিংমল, সিনেমা হল, রেস্টুরেন্টসহ সকল দোকানপাট খোলা রয়েছে। অথচ কেউ করোনার স্বাস্থ্যবিধি মানছে না এবং সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করছে না। শিক্ষিত ও সচেতন অনেকেও  করোনার জন্য প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলছে না এবং সঠিকভাবে মাস্ক ব্যবহার করছে না। করোনা মৃদু সংক্রমণে আক্রান্ত অনেক ব্যক্তি টেস্ট তো করছেনই না বরং অবাধে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। 

বর্তমানে টিকাপ্রাপ্তদের মধ্যে ওমিক্রনে আক্রান্ত অনেকের অসুস্থতার মাত্রা কম হওয়ায় এই প্রবণতা আরও বেড়েছে। এতে করে সংক্রমণ ও ঝুঁকি বেড়ে চলছে। ব্যক্তি সচেতনতার যেমন অভাব ছিল তেমনি মিডিয়াসহ সরকারও সাধারণ মানুষকে করোনার ভয়াবহতা বোঝাতেই পারেনি। অতিমারি মোকাবিলায় সরকারের কাজ তিনটি –

১. মানুষকে স্বাস্থ্যবিধি মানতে সফলভাবে উদ্বুদ্ধ করা। প্রয়োজনে আইনের প্রয়োগ করা। 
২. জীবন বাঁচাতে স্বাস্থ্যব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং 
৩. এ দুয়ের সমন্বয়ে মানুষের জীবিকা তথা দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখা। 

করোনা মোকাবিলার সবচেয়ে কার্যকর উপায় সবাইকে টিকার আওতায় আনা এবং স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলা। যেমনটি পশ্চিমা দেশগুলো করছে । আমরা দেখি ইউরোপে ওমিক্রনের কারণে সংক্রমণ বাড়লেও হাসপাতালে তুলনামূলকভাবে কম যেতে হয়েছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এর মূল কারণ হচ্ছে ইউরোপের দেশগুলোর বেশিরভাগ মানুষ টিকা পেয়েছেন। কিন্তু দুই বছরেও আমাদের দেশের জনগোষ্ঠীর বিপুল অংশ এখনও টিকার আওতায় আসেনি। এখন পর্যন্ত ১৫ কোটি ১০ লাখ টিকা দেওয়া হয়েছে। এটা অনস্বীকার্য যে, করোনা মোকাবিলায় এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় অস্ত্র হলো টিকা। মোট জনসংখ্যার সত্তর শতাংশ সব বয়সী মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে না আসা পর্যন্ত কোনো কিছু বন্ধ করে কোনো লাভ নেই। যদিও একথা সত্য যে, করোনাভাইরাসের ভ্যাকসিনের সুরক্ষা মাত্র ছয় মাসব্যাপী স্থায়ী হয়। আর যেসব ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া দ্রুত রূপান্তরিত হয় তাদের ক্ষেত্রে ভ্যাকসিন কাজ করা বেশ কঠিন। 

ওমিক্রন জিনোমে স্পাইক প্রোটিনে ত্রিশটিরও বেশি মিউটেশন রয়েছে এবং প্রচলিত ভ্যাকসিনগুলো বিশ থেকে চল্লিশ গুণ কম কার্যকর। ফলে একজন ব্যক্তি এক বা দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও তার মধ্যে করোনা সংক্রমণ দেখা যাচ্ছে। ওমিক্রন উর্ধ্বশ্বাসনালীতে আক্রমণ করে এবং নয় ফুট দূরত্ব পর্যন্ত প্রবাহিত হতে পারে। তাহলে আমাদের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, টিকা দেওয়া নিয়ে আমরা কেন মাথা ঘামাব? হ্যাঁ, আমাদের এখনও টিকা দেওয়া দরকার এবং যত তাড়াতাড়ি আমরা টিকা দিতে পারি ততই ভালো। প্রথম ডোজ যে সুরক্ষা দেয় পরের ডোজ তা বৃদ্ধি করে। মিক্সড ম্যাচ ভ্যাকসিন ভালো কাজ করছে। তবে বুস্টার হিসেবে যে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে সেটাই দ্রুত নেওয়া উত্তম।

যখন আমরা টিকা নিই তখন আমাদের শরীরে নিউট্রালাইজিং অ্যান্টিবডি ছাড়াও আরও অনেক প্রতিরক্ষামূলক পদার্থ উৎপাদন করে এবং আমাদের রোগ হতে রক্ষা করতে সাহায্য করে। সে কারণেই একজন টিকাপ্রাপ্ত ব্যক্তির ওমিক্রন দ্বারা সংক্রমিত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম এবং হলেও মৃত্যু থেকে রেহাই পেতে পারবেন। 

গবেষণায় দেখা গেছে, এমআরএনএ ফাইজার-বায়োএনটেক ভ্যাকসিনের বুস্টার (তৃতীয়) ডোজ ওমিক্রন সংক্রমণ থেকে ৭৫ শতাংশ কার্যকর। আমরা মনে করি, বাংলাদেশে প্রস্তাবিত বঙ্গভ্যাক্স (অনুমোদিত হলে) ভ্যাকসিনসহ অন্যান্য এমআরএনএ ভ্যাকসিনের ক্ষেত্রেও একই ফল পাওয়া যাবে। কিন্তু আমাদের দেশে বিজ্ঞানী ও ওষুধ কোম্পানির সক্ষমতা এবং টিকাদান ক্ষেত্রে ইপিআই পদ্ধতির সাফল্য থাকা সত্ত্বেও গত দুই বছরে দেশে কোনো করোনা ভ্যাকসিন তৈরি বা উৎপাদন করতে সক্ষম হলাম না। এটা খুব দুঃখের ব্যাপার। বঙ্গভ্যাক্স  নিয়ে মিডিয়াতে আলোড়ন তৈরি হলেও এখনো তা আলোর মুখ দেখল না! এমনকি অন্য দেশ থেকে ভ্যাকসিন টেকনোলজি নিয়ে এসে ভারতের সেরাম ইনস্টিটিউটের মতো আমরা ভ্যাকসিন উৎপাদনেও যেতে পারলাম না। যদিও ইনসেপ্টাসহ কয়েকটি ওষুধ কোম্পানির সে সক্ষমতা রয়েছে। 

বাংলাদেশে এক গবেষণা জরিপে দেখা গেছে, ভ্যাকসিন নেওয়ার পরেও সংক্রমিত হয়েছেন ৪৭ শতাংশ মানুষ। কিন্তু তাদের শতভাগই সুস্থ হয়েছেন ও তাদের লং কোভিডের সমস্যাও কম। ঊর্ধ্ব-শ্বাসনালী ইনফেকশনকে মাথায় রেখে আমাদের সামনে আরও যুগোপযোগী ভ্যাকসিন উদ্ভাবন করতে হবে। 

ইতোমধ্যে মার্ক কোম্পানির প্রস্তুতকৃত ওরালরিবোনিউক্লিওসাইড বেশ সাড়া ফেলেছে সারা বিশ্বে এবং আমাদের দেশেও তা তৈরি করা সম্ভব। শুধু উদ্ভাবন নয়, সকল শ্রেণির মানুষকে কার্যকরী অনুমোদিত ও নিরাপদ ভ্যাকসিন দেওয়া আমাদের নিশ্চিত করতে হবে।

মাইক্রোবায়োলজিস্টসহ অন্যান্য পাবলিক হেলথ বিশেষজ্ঞদের হেলথ সিস্টেমে অংশগ্রহণ নিশ্চিত ও দেশে স্বাস্থ্য গবেষণা বাড়ানোর কোনো বিকল্প নেই। রেনডম জিনোম সিকোয়েন্সিং, পাবলিক হেলথ ডাটা, বাংলাদেশের পপুলেশনে কোন ভেরিয়েন্ট বেশি, ন্যাচারাল ও টিকা প্রাপ্তদের মধ্যে এন্টিবডির পরিমাণ কত? ওমিক্রনসহ অন্যান্য ভেরিয়েন্টের বিরুদ্ধে কার্যকর ও পোলিও ভ্যাকসিনের মতো সহজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেওয়া যাবে এমন সুপার ভ্যাকসিন উদ্ভাবনে দেশে গবেষণা করা দরকার। আপাতত টিকাদানের পাশাপাশি মাস্ক ব্যবহার ও করোনার জন্য প্রণীত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলাই করোনা প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।

লেখক : গবেষক ও অধ্যাপক, মাইক্রোবায়োলজি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
Email. khasru73@juniv.edu

এইচকে