র্যাবের বিরুদ্ধে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার নেপথ্যে
৩ মার্চ ২০২১, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৪২ দিনের মাথায় অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করেন জো বাইডেন। ১৯৮৬ সালের গোল্ডম্যান-নিকোলস আইন অনুযায়ী, দেশটির প্রত্যেক প্রেসিডেন্টকেই নিজস্ব নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করতে হয়। বাইডেনও তার ব্যতিক্রম নন। ২৮ পৃষ্ঠার এই কৌশলপত্রের বেশিরভাগই মার্কিন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা নীতির চর্বিত চর্বণ হলেও একটি বিশেষ নীতির ক্ষেত্রে পূর্বসূরি তিনজন প্রেসিডেন্টের থেকে উল্টো পথে হেঁটেছেন বাইডেন।
২০০১ সালের ৯/১১ ঘটনার পর থেকে জর্জ ডব্লিউ বুশ, বারাক ওবামা এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্রনীতি এবং নিরাপত্তা ভাবনার প্রায় সিংহভাগ জুড়ে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের ছায়া থাকলেও বাইডেনের নিরাপত্তা কৌশলপত্রের কোথাও এর ছিটেফোঁটা উল্লেখও ছিল না।
বিজ্ঞাপন
নিজ প্রশাসনের নিরাপত্তা অগ্রাধিকারের তালিকায় বাইডেন যা যা এনেছেন, তা মোটাদাগে এই, ক) চীনের সঙ্গে সামনের স্নায়ুযুদ্ধ পরিস্থিতি মোকাবিলা করা, খ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির উৎসমুখ, যেমন- গণতন্ত্র, অর্থনীতি ইত্যাদি আরও শক্তিশালী করে তোলা, গ) উদার ও নিয়মতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা গণতন্ত্র এবং মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধজনিত ইস্যুগুলোতে দেশটির নেতৃত্ব স্থানীয় অবস্থান পুনরুদ্ধার।
সন্ত্রাস বিরোধী যুদ্ধের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের এই ভোলবদলের কারণ খুঁজতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। ২০১৭ সালের পর থেকে ইসলামিক স্টেট বা আইএসের বিরুদ্ধে বড় ধরনের সামরিক জয় পেয়েছে মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোট। সিরিয়া এবং ইরাক জুড়ে যে কথিত খিলাফত রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটি, তাও ভেঙে পড়েছে তাসের ঘরের মতো।
সামরিক অভিযান, দুর্বল নেতৃত্ব, অন্তর্কোন্দল ও অন্যান্য সংকটে আল-কায়েদাও রয়েছে ভগ্নদশায়। অন্যদিকে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং-এর নেতৃত্বে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ক্রমশই আগ্রাসী হয়ে উঠছে চীন। বিশেষ করে সদ্য সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় থেকেই দুই দেশের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা চরমে পৌঁছেছে।
অর্থনৈতিক, সামরিক এবং প্রভাব বিস্তারের প্রচেষ্টায় চীনা প্রতাপের মুখে নিজের বিশ্ব মোড়লের আসনটি টিকিয়ে রাখতে বেগ পেতে হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রকে। প্রতিরক্ষা, অর্থনীতি এবং কূটনীতি – এই তিন শিবিরে মার্কিন সামর্থ্যের পুরোটাই বাইডেন চীনকে ঠেকাতে বিনিয়োগ করবেন বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
বাইডেনের অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশের প্রায় ছয় মাসের মাথায় দুই দশক ধরে আফগানিস্তানে চালানো অর্থহীন যুদ্ধের ইতি টানে হোয়াইট হাউস। ৩০ আগস্ট ২০২১ তারিখ সর্বশেষ মার্কিন সেনাটি প্রত্যাহারের আরও দুই সপ্তাহ আগেই তালেবানের হাতে কাবুলের পতন হয়।
তালেবান নিয়ন্ত্রণাধীন আফগানিস্তান আবার নতুন করে সন্ত্রাসের স্বর্গরাজ্যে পরিণত হতে পারে, এমন আশঙ্কা প্রকাশ করছেন নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা। তবে আফগানিস্তানকে কেন্দ্র করে শত তোলপাড় সত্ত্বেও নিজ নীতিতে অটল বাইডেন। অথচ দেশটিতে আইএস খোরাসান (আইএস-কে) জঙ্গিগোষ্ঠীর ক্রমবর্ধমান তৎপরতা এরই মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তাই বলা যায়, ভূ-রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষই সন্ত্রাসবাদ ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্রের অগ্রাধিকারের তালিকা থেকে সরিয়ে দিয়েছে। আর সম্প্রতি বাংলাদেশের সন্ত্রাস বিরোধী এলিট প্যারামিলিটারি বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব)-এর ওপর যে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, তা পুরোপুরি বুঝে উঠতে দেশটির এই নতুন অবস্থান বিবেচনায় না নিয়ে উপায় নেই।
সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলার মতো একটি ইস্যু বাদ দিয়ে নিরাপত্তা কৌশলপত্র প্রকাশ করার মাস কয়েকের মাথায় র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আসাটা কি নেহাতই কাকতালীয় ঘটনা?
চলতি শতাব্দীর একদম সূচনালগ্নেই একের পর এক জঙ্গি অপতৎপরতার সাক্ষী হতে থাকে দেশ। এমন নৃশংস উন্মাদনার সঙ্গে এর আগে চাক্ষুষ পরিচয় হয়নি বাংলাদেশের। ২০০১ সালের রমনা বটমূলে নববর্ষ বরণ অনুষ্ঠানে হামলা, ২০০২ সালের ময়মনসিংহে সিনেমা হলে হামলা, ২০০৩ সালে নারায়ণগঞ্জ জেলায় হামলার মতো ঘটনার প্রেক্ষাপটেই ২০০৪ সালের ১৪ এপ্রিল যাত্রা শুরু করে র্যাব। এরপর থেকে র্যাবের পরিসর যতটা বেড়েছে, বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী সক্ষমতাও ততটাই বেড়েছে এবং সাথে সাথে র্যাবকে কেন্দ্র করে বিতর্কও বেড়েছে সমানতালে। তবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ তুলে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থা বিভিন্ন সময়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও দেশে ক্রমশ অবনতির দিকে যেতে থাকা নিরাপত্তা পরিস্থিতির উন্নয়নে ভূমিকা রাখায় জনসমর্থনের ঘাটতি হয়নি কখনো এই বাহিনীর।
২০১০ সালে ইউকেভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সেফারওয়ার্ল্ড এক জনউপলব্ধি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, ৯৮ শতাংশ উত্তরদাতা বলেন, র্যাব সৃষ্টির ফলে অপরাধ ও সন্ত্রাস দমনে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে। শতকরা ৯৩ ভাগ উত্তরদাতা বাহিনীর প্রতি আস্থা রয়েছে বলে জানান। এমনকি উইকিলিকসের ফাঁস করা মার্কিন গোপন কূটনৈতিক নথিতেও দেখা যায়, বিতর্ক সত্ত্বেও র্যাবের জনপ্রিয়তাকে স্বীকার করে নিচ্ছে ওয়াশিংটন—
‘স্থানীয় সুশীল সমাজ ও এনজিও সূত্র থেকে জানা যায়, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে সফল হওয়ায় দেশটির জনগণের শ্রদ্ধা ও প্রশংসার পাত্রে পরিণত হয়েছে র্যাব।’
র্যাবকে ঘিরে শত অভিযোগ সত্ত্বেও এই বাহিনীর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠভাবেই কাজ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত মাত্র চার বছরেই সোশ্যাল মিডিয়ায় নজরদারি, ফরেনসিক, মাদক শনাক্তকরণসহ বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য র্যাবের কাছে অন্তত ১১টি অত্যাধুনিক যন্ত্র বিক্রি করেছে আমেরিকা।
এই সময়ে অন্তত ২২জন র্যাব সদস্য প্রশিক্ষণ নেওয়ার উদ্দেশে যুক্তরাষ্ট্রে গিয়েছে। র্যাবের এয়ার উইং-এর যাত্রাও শুরু হয় যুক্তরাষ্ট্র থেকে কেনা দুটি বেল-৪০৭ মডেলের হেলিকপ্টার দিয়ে। কেবল যুক্তরাষ্ট্রই নয়, ওয়াশিংটনের মিত্র যুক্তরাজ্যও বেশ কয়েকদফায় র্যাব সদস্যদের প্রশিক্ষণ দিয়েছে।
সিআইএ এবং আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি (এনএসএ)-এর সহায়তায় নিউজিল্যান্ডের একটি সংস্থার সঙ্গে বছরের পর বছর গোয়েন্দা তথ্য আদান-প্রদানও হয়েছে র্যাবের। ২০১২ সালে আমেরিকার ডিপার্টমেন্ট অব জাস্টিসের উদ্যোগে র্যাবের অভ্যন্তরীণ তদন্ত সেল (আইইসি) যাত্রা শুরু করে।
তবে কি সন্ত্রাসবাদ ইস্যুর গুরুত্ব ফুরাতেই ওয়াশিংটনের কাছে প্রাসঙ্গিকতা হারিয়েছে র্যাব? আবার সন্ত্রাসবাদ বিরোধী যুদ্ধের একসময়কার নির্ভরযোগ্য সঙ্গী র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা চাপিয়েই কি ‘গণতন্ত্র ও মানবাধিকার’-এর ধ্বজা ওড়াতে চায় বাইডেন প্রশাসন?
ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থের হিসাব-নিকাশ আমেরিকার কাছে সন্ত্রাসবাদ বিরোধী তৎপরতার গুরুত্ব কমিয়ে দিতে পারে, কিন্তু বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কাছে সন্ত্রাসবাদের হুমকি এখনো জীবন্ত।
২০২০ সালের বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ সূচকে তাই এই অঞ্চলকে সন্ত্রাসবাদের সবচেয়ে গুরুতর ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বলা বাহুল্য, র্যাবের সদা তৎপর অভিযান এবং অতন্দ্র প্রহরার কারণে এই সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ভালো অবস্থানে আছে বাংলাদেশ।
তবে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা যে র্যাবের সন্ত্রাসবাদ বিরোধী কার্যক্রমে বাধার সৃষ্টি করবে, তা অস্বস্তিকর হলেও সত্য। আর গত দুই দশকের অভিজ্ঞতা থেকে ওয়াশিংটন জানে, সন্ত্রাসের প্রেত সীমানা মানে না। তাই দীর্ঘস্থায়ী নিরাপত্তার চিন্তা মাথায় রেখে সন্ত্রাসবাদ ঠেকাতে নিষেধাজ্ঞা নয় বরং দ্বিপাক্ষিক সংলাপের মধ্য দিয়ে র্যাবের সংস্কারের ওপর জোর দিবে ওয়াশিংটন, এটাই কাম্য।
তন্ময় চৌধুরী ।। গবেষক