প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী
ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি : আগামীর দৃঢ়তা
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শহীদ পরিবারগুলোর একটা দাবিই দেশজুড়ে সরব হয়ে উঠেছিল, যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাই। এই দাবির কণ্ঠে মিলিত হয়েছিল তখনকার বুদ্ধিজীবী, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব, লেখক, সাংবাদিক, মুক্তিযোদ্ধা এবং সাধারণ জনগণ। পরবর্তী সময়ে চলমান এই দাবি রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বদলানোর পরও কখনো থেমে যায়নি। হয়তো হয়েছে স্তিমিত। চিৎকার হয়নি, তারপরও কখনো হয়নি শব্দহীন। যেহেতু রাজনৈতিক শক্তি ছাড়া কোনো দাবিই পরিপূর্ণ আন্দোলনের রূপ পায় না সেহেতু স্বাধীনতা বিরোধী সরকারের সময় যুদ্ধাপরাধী বিচার দাবিটি কয়েক বছরের জন্য শব্দহীন হয়ে গিয়েছিল।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক দালালেরাই স্বাধীন দেশে উদ্ভূত করে আসছিল মৌলবাদী রাজনীতিতে। যাদের সাথে যুদ্ধাপরাধ ওতপ্রোত জড়িত, তারাই হয়ে উঠেছিল মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক হর্তাকর্তা। আমাদের অসাম্প্রদায়িক রক্তক্ষয়ী মুক্ত দেশে উগ্র মৌলবাদের বীজ বপন কখনো থেমে থাকেনি তাই।
বিজ্ঞাপন
২৯ ডিসেম্বর ১৯৯১ সালে শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে জামায়াতে ইসলামী তাদের দলের আমীর ঘোষণা করলে বাংলাদেশের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মূলত যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে ফিরে আসার প্রতিবাদ হিসেবেই তৈরি হয়েছিল একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ১১ ফেব্রুয়ারি ১৯৯২ সালে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের ঘাতক দালালেরাই স্বাধীন দেশে উদ্ভূত করে আসছিল মৌলবাদী রাজনীতিতে। যাদের সাথে যুদ্ধাপরাধ ওতপ্রোত জড়িত, তারাই হয়ে উঠেছিল মন্ত্রী, এমপি, রাজনৈতিক হর্তাকর্তা।
এই কমিটি ১৯৯২ সালে ২৬ মার্চ ‘গণআদালত’-এর মাধ্যমে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে একাত্তরের শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের যুদ্ধাপরাধের জন্য এক ঐতিহাসিক বিচার অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। গণআদালতে গোলাম আযমের বিরুদ্ধে দশটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগ উত্থাপিত হয়।
১২জন বিচারকের সমন্বয়ে গঠিত গণআদালতের চেয়ারম্যান জাহানারা ইমাম গোলাম আযমের ১০টি অপরাধ মৃত্যুদণ্ডযোগ্য বলে ঘোষণা করেন এবং প্রতীকী ফাঁসি হিসেবে গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা পোড়ানো হয়েছিল। লাখো মানুষের মাঝে ছড়িয়ে পড়েছিল গণআদালতের সাহসী পদক্ষেপ।
একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি যখন গঠন করা হয়েছিল, তখন থেকেই রাজনৈতিক সমর্থন চেয়েছিল সংগঠনটি। কারণ যেকোনো আন্দোলনের সফলতার মুখ দেখতে হলে রাজনৈতিক সমর্থন সব থেকে বেশি জরুরি এবং যেহেতু জেনোসাইড আইনে আন্তর্জাতিকভাবে যুদ্ধাপরাধীর বিচার চাওয়া হচ্ছিল সেহেতু চলমান রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া তা নিয়ে এগোনোর পথ খুবই সরু হয়ে গিয়েছিল।
সেই সময়ে ক্ষমতাসীন বিএনপির সাথে জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের কারণে বিএনপি এই কমিটির জন্য কখনোই কোনো সমর্থন দেখায়নি। বরং গণআদালতে জনগণের সমর্থন সরকারকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছিল। তাই তারা নির্মূল কমিটির নেতা, সদস্য বা সমর্থকদের হেনস্তা করার সব ধরনের পন্থা বেছে নিয়েছিল। আন্দোলনে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা থেকে শুরু করে মামলা, হয়রানি, গ্রেফতার করা শুরু করে তারা।
এরপরও থেমে থাকেনি এই কমিটি। সেই থেকে বর্তমান সময়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি ২০০৮ সালের নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীর বিচারে যুক্ত হয়েছে। পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল গঠন, যুদ্ধাপরাধী বিচার এবং রায়ে সোচ্চার থেকেছে।
১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্য বিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। সর্বসম্মতিক্রমে এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন জাহানারা ইমাম।
বিশ্বজুড়ে এই কমিটির শাখা-প্রশাখা কাজ করছে। আন্তর্জাতিক মহলেও সুনাম অর্জন করেছে। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় পরবর্তীতে সেক্টর কমান্ডারস ফোরাম এবং গণজাগরণ মঞ্চ তৈরি হয়। নির্মূল কমিটি লড়াই করে আসছে হেফাজত-জামায়াত-বিএনপির মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে। সংখ্যালঘু, ধর্মীয় ও আদিবাসী সম্প্রদায়ের উপর অত্যাচার রোধে সবসময় কাজ করে যাচ্ছে। বিপন্ন মানুষকে তারা সাহস জুগিয়েছে, সামাজিক প্রতিরোধ সংগঠিত করছে।
আমি মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে স্বাধীনতা বিরোধীদের স্বরূপ উন্মোচনের জন্য একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সবসময়ই সামনের সারিতে থেকেছে। বিশেষ করে যুদ্ধাপরাধী এবং প্রজন্মের মৌলবাদ উগ্রচর্চা রোধ করবার জন্য এই কমিটি আজও কাজ করে যাচ্ছে।
শহীদ জননী জাহানারা ইমাম সূচিত ১৯৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি বহমান রেখেছেন। যদিও এই কমিটিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম বা কবি সুফিয়া কামালের মতো দৃঢ় চিত্তের নেতৃত্ব আর দেখা যায়নি বলে অনেকে অভিযোগ করে থাকেন, যা এই কমিটির সদস্যদের মাঝে সৃষ্ট হওয়ার কথা ছিল।
সময়ের সাথে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ, উগ্র মৌলবাদের বিস্তার হয়েছে প্রকট রূপে। আমার মতো শহীদ পরিবারের সদস্যরা এখনো তাকিয়ে থাকে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির মতো সাহসী সংগঠনের দিকে।
ঘাতক দালালদের বিরুদ্ধে সদা লড়াই করা শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন। ঘাতক বিরোধী লড়াইয়ের জন্য রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা মাথায় নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন তিনি। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে শক্তিশালী লড়াইয়ের ইতিহাস সদা জাগ্রত রাখার দায়িত্ব এই কমিটির।
স্বাধীন বাংলাদেশে সবচেয়ে সাহসী এই সংগঠন আগামীর পথে আরও অনেক বেশি দৃঢ়তার সাথে আপসহীন পথ চলবে, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়বার শপথে এগিয়ে যাবে এই শুভ কামনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীতে জানাই অভিবাদন।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা