আলমডাঙ্গা মহাসড়কের একদিন
আলমডাঙ্গা মহাসড়কের বুক টিপ টিপ করছে, কারণ মন্ত্রণালয়ের টেবিলে তার প্রকল্প প্রস্তাবনা ফাইলটি পড়ে আছে আর একটু পরেই সেই ফাইল অর্থাৎ তাকে নির্মাণ করা হবে কি না তা নিয়ে আলোচনা হবে। আর হলেও কী কী উপাদান থাকবে, নতুন কী যুক্ত হবে আর কোন উপাদান বাদ দেওয়া হবে তাও নির্ধারণ করা হবে। যদিও সে জানে যে, গত প্রায় দুই সপ্তাহ হলো, দেশের কোনো সড়ক বা মহাসড়কেরই মন ভালো নেই। কদিন আগেই বেশ কিছু সংস্থা বিগত বছরের সড়ক দুর্ঘটনার তথ্য-উপাত্ত উপস্থাপন করেছে—আর তার ধারণাই সত্য হলো।
এবারও অনেক বেশি মানুষ সড়কপথে মারা গিয়েছে। এই ব্যাপারটি সে আগেই কিছুটা টের পাচ্ছিল কারণ গত বছরও যখন একই ব্যাপার ঘটল তখনো প্রতিবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সবাই মিলে কত কত পরামর্শ দিল, ভালো ভালো কথা বলল—কিন্তু কই এরপর তো কেউ কোনো খোঁজ নিল না।
বিজ্ঞাপন
দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যত অব্যবস্থাপনা। তাকে নির্মাণ করার পরেও কী এসব ঘটে কি না তাই নিয়েও সে চিন্তিত। অথচ যেদিন তার জন্ম হয়—অর্থাৎ যেদিন সরকার আলমডাঙ্গা মহাসড়ক তৈরি করার জন্য প্রথম পরিকল্পনা গ্রহণ করে সেদিন থেকেই সে মনে মনে অনেক খুশি।
তার খুশির প্রধান কারণ হলো, এই দেশে প্রায় শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ ও পণ্য সড়কপথে পরিবহন করা হয়, যেখানে বলা হয় যে সড়কের উন্নয়ন মানে হলো দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন, মানুষের উন্নয়ন, সেখানে এই সড়ক পরিবারের একজন সদস্য হওয়া মানে দেশের উন্নয়নের অংশ হওয়া। সেও মনে মনে প্রতিজ্ঞা করে যে, তার উপর দিয়ে যত মানুষ যাবে সবাইকে সে নিরাপদে পৌঁছে দিবে, তার উপর দিয়ে যত পণ্য পরিবহন হবে তার সবকিছু সে নির্দিষ্ট সময়ে পৌঁছে দিবে।
প্রতিবারের মতো সড়ক দুর্ঘটনা কমানোর জন্য সবাই মিলে কত কত পরামর্শ দিল, ভালো ভালো কথা বলল—কিন্তু কই এরপর তো কেউ কোনো খোঁজ নিল না। দিন দিন গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে আর তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যত অব্যবস্থাপনা।
তার এই স্বপ্ন আরও বেশি ডানা মেলল যখন ইঞ্জিনিয়ার তার সুন্দর একটা অ্যালাইনমেন্ট দিল, তাকে তৈরি করার জন্য ভালোমানের সব নির্মাণ সামগ্রী যেমন পাথর, বিটুমিন, খোয়া এগুলো হিসাবে ধরে রাখল, তার উপর দিয়ে কত ওজনের গাড়ি চলবে সে হিসাব করে তাকে শক্তিশালী করার প্ল্যান করল—আরও কত কি।
এছাড়াও তার উপর দিয়ে চলাচলকারী চালকদের সম্ভাব্য ঝুঁকি বা রাস্তার অবস্থা সম্পর্কে আগাম সতর্কতা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত সাইন আর রোড মার্কিং ও রাখা আছে হিসাবে। কিন্তু আজ সে কিছুটা চিন্তিত, কারণ সে জেনেছে যে প্রায়শই নাকি খরচ কমানোর জন্য না বুঝেই মন্ত্রণালয় থেকে কিছু কিছু জরুরি উপাদান বাদ দিয়ে দেয় আর তার মধ্যে রোড সাইন একটা। তার চিন্তার কারণ হচ্ছে, যদি তার সাথেও এমন হয়, যদি পর্যাপ্ত সাইন আর রোড মার্কিং রাখা না হয় তাহলে সে কীভাবে চালকদের সতর্ক করবে, কীভাবে তাদের সচেতন করবে।
একটা রাস্তার ভাষাই তো এই সাইন আর রোড মার্কিং। তার চিন্তার আরেকটা কারণ হচ্ছে, এই লম্বা পথটা তাকে একাই সব ধরনের গাড়িকে নিয়ে চলাচল করাতে হবে। তার একবার বলতে ইচ্ছা করছিল যে, তার উপর দিয়ে সব গাড়িকে না নিয়ে যে গাড়িগুলোর গতি কম আর যে গাড়িগুলো স্বল্প দূরত্বে চলে তাদের জন্য পাশেই আলাদা একটা রাস্তা করে দেওয়ার জন্য। কারণ সে বুঝতে পারছিল যে, কম গতি আর বেশি গতির গাড়ি একসাথে চললে তার উপর দিয়ে বেশি বেশি ওভারটেকিং হবে আর আজকাল চালকেরা যেভাবে বেপরোয়া ভাবে গাড়ি চালায়, অনিরাপদ ওভারটেক করে বা অযান্ত্রিক ও স্থানীয়ভাবে নির্মিত যান চলাচল করে এর ফলে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। কিন্তু সে শুনেছে যে, সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সকল রাস্তায় পর্যাপ্ত সাইন আর রোড মার্কিং দিতে বলেছেন আর পাশে সার্ভিস রোড রাখতে বলেছেন। সে আশা করছে যে, মন্ত্রণালয় নিশ্চয়ই এ ব্যাপারটা খেয়াল করবে।
ইঞ্জিনিয়ার কয়দিন আগে যখন তার অ্যালাইনমেন্ট তৈরি করছিল তখন তাদের নিজেদের মিটিং-এ কিছু ঝুঁকির কথা আলোচনা করছিল যার কিছু কিছু কথা তার কানেও এসেছে। যেমন তার নকশায় যে বাঁকগুলো আছে, যে ব্রিজ বা রেল ক্রসিং আছে সেগুলো তারা কারিগরি নকশায় মানসম্মত রাখলেও বা সেখানে গতি কমানোর জন্য সাইন বা ওভার টেক না করার জন্য রোড মার্কিং দিলেও চালক যদি তা না মেনে চলে বা ঐ এলাকার মানুষজন যদি কোনো নিয়মনীতি না মেনেই রাস্তার পাশে হাটবাজার নির্মাণ করে ফেলে তাহলে সড়ক দুর্ঘটনার ঝুঁকি বেড়ে যাবে।
আলমডাঙ্গা মহাসড়কের চিন্তার আরেকটা বড় কারণ হলো, তার ঢাল বরাবর গাছ লাগানো হবে কি না বা লাগালেও কোন ধরনের গাছ লাগাবে সেটা সে নিশ্চিত না কারণ সড়কের পাশে কোন ধরনের গাছ লাগানো যাবে এই বিষয়ে এখনো কোনো নীতিমালা নেই। মানুষ কেন বোঝে না যে, রাস্তার পাশে বড় গাছ লাগালে সেগুলো কয়দিন পর ডালপালা মেলে দেবে রাস্তার উপর। তখন সে পর্যাপ্ত আলো পাবে না, পাঁচ মিনিট বৃষ্টি হলেও গাছের পাতা থেকে তার উপর টপটপ করে পানি পড়বে পরের এক ঘণ্টা।
আমাদের দেশে এখনো এ ধরনের সেফটি অডিটের প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ ভাবে না। সবাই ভাবে রাস্তা তৈরি করে কিছু সাইন আর মার্কিং দিলেই বুঝি তা নিরাপদ হয়ে গেল।
এমন হলে সে কীভাবে তার সার্ফেস ঠিক রাখবে? তার উপর ঐসব বড় গাছের লম্বা শিকড় তার ভিত্তিকে যদি দুর্বল করে দেয় তাহলে সে অল্প সময়েই ভেঙে যাবে। এছাড়াও আজকাল মালিক বা চালকেরা বেশি লাভের আশায় যেভাবে ওভারলোড করে চলে সেক্ষেত্রে তাকে যদি সময় মতো রক্ষণাবেক্ষণ করা না হয় বা এর জন্য পর্যাপ্ত বাজেট না পাওয়া যায় তাহলে দ্রুতই সে দুর্বল হয়ে যাবে তখন মানুষের কষ্ট হবে, দুর্ঘটনা হবে, সরকারের আর্থিক ক্ষতি হবে।
বিভিন্ন ধরনের রাস্তা নির্মাণের জন্য সরকারের কয়েকটি সংস্থা আছে—যেমন কেউ গ্রামের রাস্তা বানায় কেউ শহরের রাস্তা বানায়। আজ যখন ইঞ্জিনিয়ার তার ফাইল নিয়ে মন্ত্রণালয়ে আসছিল তখন থেকেই আলমডাঙ্গা মহাসড়ক ভাবছিল যে, আজকের মিটিং-এ অন্যসব সংস্থা থেকে প্রতিনিধি থাকবে কি না, কারণ সবার মধ্যে সমন্বয় করা না হলে দেখা যাবে কয়দিন পর অন্য কেউ তাদের রাস্তা মহাসড়কের সাথে সংযোগ করে দিয়েছে কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছাড়াই যা দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ায়। সে শুনেছে বিভিন্ন দেশ, যারা সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে অনেক সফল তারা নাকি সড়ক নির্মাণের বিভিন্ন ধাপে তৃতীয় কোনো অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান দিয়ে রোড সেফটি অডিট করিয়ে থাকে কারণ যিনি রাস্তার নকশা বা কারিগরি নির্দেশ করেন তার দৃষ্টিভঙ্গিতে সবধরনের সম্ভাব্য ঝুঁকি চিহ্নিত করা সম্ভব নয়।
আলমডাঙ্গা মহাসড়কের খুব ইচ্ছা ছিল যে তাকেও কেউ একজন এভাবে পর্যবেক্ষণ করবে আর এমন কিছু একটা বুদ্ধি দিবে যাতে মানুষের জীবন চলে যাওয়ার আগেই সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া যায়। কিন্তু তার আজ খুব আফসোস হচ্ছে যে, আমাদের দেশে এখনো এ ধরনের সেফটি অডিটের প্রয়োজনীয়তার কথা কেউ ভাবে না। সবাই ভাবে রাস্তা তৈরি করে কিছু সাইন আর মার্কিং দিলেই বুঝি তা নিরাপদ হয়ে গেল।
আলমডাঙ্গা মহাসড়কের বুক টিপ টিপ করছে, কারণ একটু পরেই তার ফাইল নিয়ে বসা হবে। সে চায় তার উপরের যে বিটুমিন থাকবে সেখান যেন রক্তের দাগ না লাগে, তার কারণে যাতে কেউ পঙ্গু না হয়, তার কারণে যাতে এই দেশের মানুষ ও সম্পদের কোন ক্ষতি না হয়।
কিছুদিন আগে জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিল সবাইকে নিয়ে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণ আর সড়কে শৃঙ্খলা বৃদ্ধি করতে ১১১টা সুপারিশ দিয়েছে, সেখানে অনেক কার্যকর সুপারিশ প্রদান করা হয়েছে। সেগুলো দ্রুত বাস্তবায়নে যদি আরও গুরুত্ব দেওয়া হতো তাহলে আজ সে অনেকটাই নিশ্চিন্ত থাকত।
কাজী মো. সাইফুন নেওয়াজ ।। সহকারী অধ্যাপক, এক্সিডেন্ট রিসার্চ ইন্সটিটিউট, বুয়েট