মাস্টারদা সূর্য সেন : ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের মহানায়ক
মানুষের মুক্তির আকাঙ্ক্ষা, দেশকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত করে স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা, সচেতন মানুষের তো থাকবেই। এটা সাধারণভাবে মনে হতে পারে। কিন্তু এই মুক্তি অর্জন ও স্বাধীনতা অর্জনে নিজের জীবনকে উৎসর্গ করা, এজন্য অন্যদের সংগঠিত করার ইতিহাসে অনন্য নাম সূর্য সেন। তিনি মাস্টারদা সূর্য সেন নামে খ্যাত।
১৯৩৪ সালের ১২ জানুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে ব্রিটিশ শাসকেরা যাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছিল। ঐ সময় জেল গেটের বাইরে শহীদ সূর্য সেনের সহযোদ্ধারা অপেক্ষা করছিলেন, তাদের প্রিয় সহকর্মী, নেতাকে স্যালুটের মাধ্যমে বিদায় জানাবেন। তাকে সামনে রেখে স্বাধীনতার জন্য আরেকবার জীবন উৎসর্গ করার শপথ নেবেন।
বিজ্ঞাপন
ব্রিটিশ শাসকেরা জীবিত সূর্য সেনকে যেমন ভয় পেত, তেমনি ভয় পেত সূর্য সেনের মৃতদেহকেও। তাইতো ঐ মৃতদেহ গুম করা হয়েছিল। জানা যায়, লোহার খাঁচায় ভরে সমুদ্রে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু মানুষের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা দমাতে পারেনি।
ফাঁসিতে যাওয়ার আগে সহযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে সূর্য সেন লেখেন, ‘...আমার বন্ধুরা—এগিয়ে চলো, এগিয়ে চলো, কখনো পিছিয়ে যেও না। পরাধীনতার অন্ধকার দূরে সরে যাচ্ছে। ওই দেখা যাচ্ছে স্বাধীনতার নবারুণ। কখনো হতাশ হয়ো না। সাফল্য আমাদের হবেই...’
২০০ বছরের ব্রিটিশবিরোধী শাসন-শোষণের বিরুদ্ধে নানা সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে। তার মধ্যে অন্যতম হলো ১৯৩০ সালের ১৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের যুব বিদ্রোহ। মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে সংগঠিত এই যুব বিদ্রোহের মাধ্যমে ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চট্টগ্রামকে তিনদিনের জন্য স্বাধীন করে রাখা হয়েছিল।
ব্রিটিশ শাসকেরা জীবিত সূর্য সেনকে যেমন ভয় পেত, তেমনি ভয় পেত সূর্য সেনের মৃতদেহকেও। তাইতো ঐ মৃতদেহ গুম করা হয়েছিল।
দেশের ইতিহাসে এ এক অনন্য ঘটনা। ঐ সময় চট্টগ্রামের ব্রিটিশ শাসক আর বণিকরা আশ্রয় নিয়েছিল সমুদ্রে। সূর্য সেন বাহিনী অল্প স্বল্প অস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে ব্রিটিশ বাহিনীকে পরাজিত করতে পারলেও পরবর্তীতে সংগঠিত হয়ে বিপুল বাহিনী ও ব্যাপক অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে নিষ্ঠুরভাবে এই বিদ্রোহ দমনের পথ বেছে নেয় ব্রিটিশ শাসকেরা।
ব্রিটিশ শাসকেরা ও ঘটনা লিপিবদ্ধকারীরা এই বিদ্রোহকে পরিচিত করতে চেয়েছে, ‘চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন’ নামে। ঐ বিদ্রোহ সাময়িকভাবে দমন করা গেলেও আদর্শের পথ থেকে সংগ্রামীদের ফেরানো যায়নি।
তাইতো দেখা যায় আত্মগোপনে থাকা অবস্থায়ও ব্রিটিশ বাহিনীর সাথে যুদ্ধে জীবন দিতে হয় অসংখ্য বিপ্লবীদের। পরিকল্পনা অনুযায়ী বীরকন্যা প্রীতিলতার নেতৃত্বে ইউরোপিয়ান ক্লাব আক্রমণ করে সফল হলেও বীরকন্যা প্রীতিলতাসহ অনেকেই জীবনে উৎসর্গ করতে হয়।
এসব সংগ্রামের পথ ধরেই ১৯৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধ। স্বাধীনতা অর্জন। বিজয় অর্জন। এই বিজয়ের সুবর্ণজয়ন্তী আমরা অতিক্রম করেছি। তাইতো এবার ১২ জানুয়ারিতে বিশেষভাবে স্মরণ করি মাস্টারদা সূর্য সেনের ফাঁসিতে জীবন দেওয়ার দিনটিকে, মাস্টারদা সূর্য সনকে ও আত্মদানকারী বিপ্লবীদের।
মাস্টারদার ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।
এ অঞ্চলে কৃষক বিদ্রোহ, সাঁওতাল বিদ্রোহ, নানকার বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তিতুমীর বিদ্রোহ, হাজং বিদ্রোহ, তেভাগা আন্দোলন, নৌ বিদ্রোহ, সিপাহি বিদ্রোহ, নাচোল বিদ্রোহ, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহ, অসহযোগ আন্দোলন, স্বদেশি আন্দোলন, ফরায়েজি আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন, আজাদ হিন্দ ফৌজ আর ভারত ছাড় আন্দোলনসহ অসংখ্য আন্দোলনের বীরত্বের রক্তস্নাত পথ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতার অংশ।
এসব আন্দোলন সংগঠিত করতে সচেতন প্রয়াস ছিল। সংগঠিত করা ও সংগঠিত হওয়ার প্রধান শক্তি ছিল তারুণ্য। নানা মাধ্যমে, নানা পথে তারা তাদের লক্ষ্য বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা নিয়েছেন। ভুল থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন নতুন পথ তৈরি করেছেন।
মাস্টারদার ইতিহাস সংগ্রামের ইতিহাস। শ্রেণি সংগ্রামের ইতিহাস। পরাধীনতা থেকে মুক্তি, শোষণ থেকে মুক্তি ছিল তার অন্যতম লক্ষ্য।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ পূর্ববর্তী আন্দোলন সংগ্রামে বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের মধ্যেও এই তারুণ্যের শক্তিকে দেখতে পাই। ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান আর ৭১-এর সশস্ত্র সংগ্রামেও ছিল তারুণ্যের শক্তি। কৃষক শ্রমিকের মধ্যে তরুণরাই ছিল সামনের সারিতে।
এসব সংগ্রামে এই শক্তির সামনে ছিল আদর্শ। শুধু নিজের স্বার্থ না, ছিল সমষ্টির স্বার্থ। ছিল আগামী দিনের সোনালি সূর্যের আকাঙ্ক্ষা। ব্যতিক্রম ছাড়া আত্মোৎসর্গের দৃশ্যমান নেতৃত্ব ছিল অনেক ক্ষেত্রে। যা তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করে মুক্তির সংগ্রামে যোগ দিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে।
আজ সূর্য সেনের আত্মোৎসর্গের ৮৮ বছর পর নানা অগ্রগতির মাঝে ব্যক্তি স্বার্থের প্রবণতা যেন দৃশ্যমান বাস্তবতা। দৃশ্যমান বাস্তবতা যেন আত্মোৎসর্গের মনোভাবের অভাব। তাইতো মানুষের নিজের স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষার মাত্রা বাড়লেও নানা মাত্রায় পরাধীনতা বাড়ছে।
নিজের ক্ষমতা, দাপট, অর্থবিত্ত যেন যাচাইয়ের বড় মাপকাঠি। শুধুমাত্র এর পেছনে ছুটে সাময়িক আত্মতুষ্টি অর্জন করতে পারলেও তা স্থায়ী হয় না। চলতি ধারা ও প্রবণতার পথ, আত্মোৎসর্গী বীরদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়ন থেকে দূরে সরিয়ে রাখেছে।
এটাই কি একমাত্র বাস্তবতা? না। এর বিপরীতে আদর্শ নিষ্ঠ আত্মোৎসর্গের তরুণ প্রজন্ম রয়েছে। এখনকার বাস্তবতায় মানুষ, সমাজ, দেশকে অগ্রসর করতে তারা নানা মাধ্যমে ভূমিকা পালন করে চলেছে।
সূর্য সেনসহ আত্মত্যাগী বিপ্লবীদের ইতিহাস, তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে এসব আদর্শনিষ্ঠ শক্তিকে তাদের বহুমাত্রিক ভূমিকা পালনে উৎসাহিত করে চলেছে।
শুধু তাই নয়, জনস্বার্থ বিরোধী শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামের অন্যতম অনুপ্রেরণা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে বিপ্লবীদের উৎসর্গের জীবন। এদের জীবন সংগ্রাম আমাদের অনুপ্রাণিত করে, সাহস জোগায়। যেকোনো সংকটে পথ দেখায়।
তাই নিজেদের ও নতুন প্রজন্মকে সূর্য সেনদের জীবনী পাঠে উৎসাহিত করা আজকের অন্যতম কর্তব্য। এসব বিপ্লবীদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে সচেতন ও সংগঠিত প্রচেষ্টা নেওয়ার মধ্য দিয়েই তাদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে হবে। নতুন সূর্য এনেই সূর্য সেনের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে তাদের আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের পথেই হাঁটতে হবে।
রুহিন হোসেন প্রিন্স ।। সম্পাদক, কেন্দ্রীয় কমিটি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)
hossainprince@yahoo.com