সমাজের প্রতি আমাদের দায়দায়িত্ব
করোনার চাদরে ঢাকা আরেকটি বছর আমরা পার করছি। কী দুঃসহ সময়ই না গত দুবছর আমরা অতিক্রম করলাম! এসময়ে যেসব সমস্যা দেশে ছিল তা আরও বেড়েছে, নতুন সমস্যাও অনেক সৃষ্টি হয়েছে। যেমন চাকরি ছিল এমন অনেকেই চাকরি হারিয়ে নতুন করে সমস্যায় পড়েছেন, মধ্যপ্রাচ্যে কর্মরতরা ছাঁটাই হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন।
সব মিলিয়ে সমস্যাসংকুল এদেশে করোনার কারণে সমস্যা পাহাড়সম হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু সমস্যা সরকার ও বিভিন্ন বেসরকারি সংগঠন সমাধান করার চেষ্টা করছে, কিন্তু উদ্বেগজনক হলো কিছু সমস্যা, যেগুলোও অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত সেদিকে কেন জানি আমরা নজর দিচ্ছি না। আমার মতে, এগুলোর দিকে নজর না দিলে ভবিষ্যতে আমাদের চরম মূল্য দিতে হবে। যেমন—
বিজ্ঞাপন
১। করোনার সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় গোটা শিক্ষাব্যবস্থায় ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে। অনলাইনে পড়াশোনা হয়েছে নামমাত্র, তাও সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তা চালু করার সক্ষমতা ছিল না।
আমরা অটো পাস, সীমিত আকারে পরীক্ষা নিয়ে সমস্যাটি মোকাবিলা করছি। এছাড়া হয়তো ভালো সমাধানও নেই, কিন্তু এর কারণে আমাদের পরের প্রজন্মের মাঝে ভয়াবহ একটি ‘নলেজ গ্যাপ’ তৈরি হয়েছে। বলা যায়, প্রায় পড়ালেখা না করেই তারা পরের ক্লাসে গেছে। ভবিষ্যতে এর ফলাফল হবে ভয়াবহ।
বেকার তারুণ্য পারমাণবিক বোমার চাইতেও বেশি ভয়ংকর। আবার এটাও ঠিক যে, এত বেকারের কর্ম সৃষ্টিও রাতারাতি সম্ভব নয়।
তাই সামনের দিনগুলোতে এসব শিক্ষার্থীর এ নলেজ গ্যাপ পূরণে সমন্বিত একটি কর্মসূচি গ্রহণ জরুরি। যার মাধ্যমে ফেলে আসা সময়ের শিক্ষাজনিত দুর্বলতা তারা কাটিয়ে উঠতে পারে। এক্ষেত্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে নিয়মিত কোর্সের বাইরে মানব সম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে আলাদা কোর্স চালু করা উচিত।
২। এসময় দেশে অসংখ্য ক্ষুদ্র ব্যবসা ধ্বংস হয়ে গেছে। এসব ব্যবসায়ী শুধু পথে বসেননি, তাদের সাথে দুয়েকজন কর্মচারী, যারা এসব জায়গায় কাজ করতেন তারাও পথে বসে গেছেন। সরকার বড় ব্যবসায়ী/শিল্পপতিদের প্রণোদনা দিয়েছে, কিন্তু এসব ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর কান্নার জল আমাদের চোখে পড়েনি।
আমার মতে, এদের সাহায্য করার জন্য সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশেষ কর্মসূচি নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে এদের ঋণের সুযোগ দিতে হবে, অভিজ্ঞতা বলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ঋণের টাকা সাধারণত মেরে দেন না।
৩। দীর্ঘদিন সরকারি নিয়োগ বন্ধ ছিল, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে নিয়োগও প্রায় বন্ধ—তাই বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। এর সাথে যুক্ত হয়েছেন করোনার কারণে চাকুরিচ্যুত নতুন কর্মহীন মানুষগুলো। এদের যদি দ্রুত কাজ দেওয়া না যায় ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটবে।
কথায় আছে, বেকার তারুণ্য পারমাণবিক বোমার চাইতেও বেশি ভয়ংকর। আবার এটাও ঠিক যে, এত বেকারের কর্ম সৃষ্টিও রাতারাতি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে একটি সমাধান হতে পারে ‘সামাজিক ব্যবসা’-এর মাধ্যমে এদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা। এতে বেকারত্বই শুধু কমবে না- একইসাথে খুবই সম্ভাবনাময় একটি উদ্যোক্তা গোষ্ঠী গড়ে উঠবে। সরকার ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বিষয়টি বিবেচনা করতে পারেন।
৪। প্রচুর শিক্ষার্থী আর্থিক সমস্যার কারণে ঝরে পড়েছেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এদের আবার পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি, নয়তো এরা ভবিষ্যতে দেশের বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
প্রচুর শিক্ষার্থী আর্থিক সমস্যার কারণে ঝরে পড়েছেন। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় এদের আবার পড়ালেখায় ফিরিয়ে আনা খুব জরুরি, নয়তো এরা ভবিষ্যতে দেশের বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়াবে।
পক্ষান্তরে, এদের পড়াশোনায় ফিরিয়ে আনলে দেশ পাবে তারুণ্য দীপ্ত মানবসম্পদ। কেন জানি, এ ব্যাপারটি কেউ নজর দিচ্ছেন বলে মনে হয় না।
৫। আমরা একটা ব্যাপারে মোটেই পাত্তা দিচ্ছি না, তাহলো করোনার ভয়াবহ ট্রমাকালে বয়স নির্বিশেষে অনেকেই মানসিক স্বাস্থ্যজনিত সমস্যায় পড়েছেন। ব্যাপারটি জাতির সুস্থতার জন্য অতীব জরুরি, কিন্তুই ব্যাপারটি কোনোভাবেই পাত্তা পাচ্ছে না। যার কারণে অচিরেই আমাদের জনগোষ্ঠীর একটি বড় অংশ আপাতদৃষ্টিতে সুস্থ হলেও ভেতরে ভেতরে তীব্র মানসিক রোগে আক্রান্ত হবেন- যার প্রতিক্রিয়া ভাবতেই গা শিউরে ওঠে। এ ব্যাপারে বিজ্ঞজনদের ভাবা উচিত, কাজ করা উচিত। পশ্চিমা বিশ্বে ব্যাপারটি খুব গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে- আমরা এই আসল ‘কালোমেঘ’ দেখতে পাচ্ছি না।
আমার মনে হয়, উপরের সমস্যাগুলো আমাদের মনোযোগের দাবি করে, কিন্তু আমরা তা দিচ্ছি না। অথচ এগুলো মৌলিক সমস্যা- যা প্রাধিকার পাওয়া উচিত ছিল। এদিকে নজর না দিয়ে আমরা বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের যে চেষ্টা করছি, তা কিছুদিন পরই ‘ফেইসপাউডার’ সল্যুশন বলে প্রমাণিত হবে- ফেইসপাউডার চেহারার ক্ষতকে কিছুক্ষণের জন্য লুকিয়ে রাখতে পারে, এক সময় না এক সময় সে ঘা উন্মুক্ত হবেই এবং তা হবে আরও দগদগে।
আমি সবার প্রতি সবচেয়ে দগদগে সমস্যার দিকে নজর না দিয়ে ফেইসপাউডার সমাধানে না যাওয়ার বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি।
আসন্ন ঝড় এড়াতে হলে এর বিকল্প নেই, নয়তো ঝড় আসলে হাতের কাছে ছাতা থাকবে না।
বাদল সৈয়দ ।। সমাজকর্মী ও কথাসাহিত্যিক
badalsyed@yahoo.com