ছবি : সংগৃহীত

ইংরেজি নতুন বছরটা বরাবরই সশব্দে আসে। জানুয়ারির ১ তারিখ আসার আগেই শুরু হয় বর্ষবরণের নাচ-গান। সেই আয়োজন শহরে এলাকায় বড় জমকালো। হইচই হয়, অসভ্যরা কিছু এলোমেলো হট্টগোলও করে। আমাদের এই সাহেবি অভ্যাস দিন দিন বাড়ছে, কিন্তু সাহেবদের মতো কতটা মনের জগতে আলোকিত হতে পারছি সেটি বরাবরই প্রশ্নবোধক।

নতুন জামাকাপড়, নতুন খাদ্য-পানীয়, খাওয়াদাওয়ার নতুন কায়দা, আর নতুন শব্দ রপ্ত করছি ঠিকই, কিন্তু মনোজগতে সেই পুরনো ধ্যান ধারণা।

সত্যি বলতে কি, এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার মৃত্যু ঘটেছে। অনেকে এমন কথা বলায় রাগ করতে পারেন, প্রতিবাদ করতে পারেন, মন খারাপ করতে পারেন এমনকি অস্বীকারও করতে পারেন। কিন্তু একথা স্বীকার না করে উপায় নেই যে, ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের সামনে পড়ে ধর্মনিরপেক্ষতার এক বিরাট বিপন্নতা সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে।

২০২১ সাল ছিল আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ এক বছর। স্বাধীনতা সুবর্ণজয়ন্তী ছিল গত বছরে। এবং সাথে ছিল বাঙালির মহানায়ক, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকীর উচ্ছ্বাস। কিন্তু এ বছরটিই বাঙালির জীবনে কলঙ্কিত হয়ে থাকল।

মার্চ মাসে বিদেশি মেহমানের যখন উপস্থিতি তখন আমরা ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও চট্টগ্রামের হাটহাজারীসহ বেশকয়েকটি স্থানে সদর্পে বিচরণ করতে দেখেছি অন্ধকারের শক্তিকে। তারা তাণ্ডব চালিয়েছে, নরক বানিয়েছে সেইসব জনপদকে। এরা এমনটা করেছে, কিন্তু পুলিশি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনার বাইরে রাজনৈতিক কোনো প্রতিরোধ চোখে পড়েনি।

মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের প্রজন্মের একটা বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর মতো বড় মানুষের রাজনীতি দেখেছে। তারা তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতাকে দেখেছে। তারা যুক্তিবাদ আর ধর্মের মধ্যেকার জটিল সম্পর্কটি বিচার করে করে এগিয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে এক প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ...

যদি দেশটাকে আবার সুস্থভাবে বেঁচে উঠতে হয়, তা হলে ধর্মনিরপেক্ষতার ভাবনায় আমাদের এক নতুন জীবনীশক্তির সঞ্চার করতে হবে। এবং সেটা আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগকেই করতে হবে।

বেদনার জায়গা হলো টানা তৃতীয় মেয়াদে দলটি ক্ষমতায় আছে, কিন্তু তাদের ভেতর সেই জেদটা নেই এই অন্ধকারের শক্তিকে প্রতিরোধ করার। এই দলের নেতা-কর্মীদের কণ্ঠে কেমন কৈফিয়তের সুর। জঙ্গিগোষ্ঠীকে মোকাবিলা করার মতো মনোবলের প্রকাশ নেই। তারা ক্ষমতার চর্চা যতটা করে ততটা করেনি রাজনৈতিক চর্চা। 

মুক্তিযুদ্ধের আগের ও পরের প্রজন্মের একটা বড় অংশ বঙ্গবন্ধুর মতো বড় মানুষের রাজনীতি দেখেছে। তারা তাজউদ্দীনসহ চার জাতীয় নেতাকে দেখেছে। তারা যুক্তিবাদ আর ধর্মের মধ্যেকার জটিল সম্পর্কটি বিচার করে করে এগিয়েছে।

ধর্মনিরপেক্ষতা মানে এক প্রয়োজনীয় মূল্যবোধ, যার মধ্যে থাকবে দেশের বিভিন্ন ধর্মীয় গোষ্ঠী ও সমাজের মধ্যে সাম্য, সাংস্কৃতিক সংযোগ, বৌদ্ধিক সংলাপ এবং পারস্পরিক সম্মান তৈরি করার প্রয়াস। আমরা সারাজীবন জেনে এসেছি, বুঝে এসেছি যে, সমাজের পক্ষে ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদ বিপজ্জনক। কিন্তু আজ দিব্য চোখে সেই সংখ্যাগুরুর গোঁড়ামিই দেখছি।

গত কয়েকদিন ধরে একটা প্রশ্নের উত্তর দিতে হয়েছে আমাকে—আগামীর প্রত্যাশা কী? এক কথায় এর উত্তর আসলে নেই। কিন্তু আমরা যারা সংবেদনশীল, যারা মানবিক বাংলাদেশের ভাবনা ভাবি, তারা বুঝতে পারি দেশের প্রধান কাজ—ধর্মীয় কট্টরপন্থীদের কবল থেকে ধর্মকে উদ্ধার করা এবং একই সাথে সমাজকে ধর্মের রাজনীতির বাইরে নিয়ে যাওয়া।

ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত জীবনের বাইরে যেন না আসে সেই প্রচেষ্টা নেওয়া। উগ্র জাতীয়তাবাদীদের কবল থেকে বাইরে বের হতে না পারলে ধর্মীয় উন্মাদনা থেকেও বের হওয়া কঠিন। সে কাজটি করতে গেলে সেরকম রাজনীতি দরকার। সেই রাজনীতি দরকার যেটি বঙ্গবন্ধু করতেন – বড় রাজনীতি। ভেদাভেদের রাজনীতি, ক্ষুদ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি, গোষ্ঠীতন্ত্রের রাজনীতির বাইরে বেরিয়ে মানুষের জীবনকে আরও বড় করে দেখার রাজনীতি।

রাজনীতি থেকে নীতিকেই বাদ দিলে যা হয় সেটাই এখনকার বাংলাদেশ। রাজনীতির নৈতিকতার ভিত্তিতেই চলে সুশাসন। বঙ্গবন্ধু ধর্মবিশ্বাসের এই উদারতা নিজের রাজনীতিতে রাখতে চেয়েছিলেন আমৃত্যু...

ধর্মনিরপেক্ষতাকে আবার নতুন করে প্রাণ দিতে চাই, কিন্তু নিশ্চয়ই ধর্মের বৃহত্তর চেতনার গুরুত্বকে বাদ দিয়ে নয়। ধর্মীয় অন্ধতার বিরোধিতা করার সময়ে কিংবা ধর্মীয় সংখ্যাগুরুবাদের প্রতিরোধ তৈরি করার সময়ে আমাদের ধর্মীয় বিশ্বাস বা ধর্মীয় ভাবধারাকে ভেতর থেকে অসম্মান করতে চাই না, যদিও ধর্মীয় রাজনীতির ধারকরা তাদের জায়গা থেকে কাউকে ছাড় দেয় না। তারা তাদের বিশ্বাসের জায়গা থেকে অন্য ধর্ম-সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি আক্রমণ শানানো কিংবা ঘৃণা পোষণ করার মতো হীন কাজ করতে দ্বিধা বোধ করে না।

আমাদের দেশের মানুষ সাধারণত ‘ধর্মভীরু’ কিন্তু ‘ধর্মান্ধ’ নয় – এ কথার প্রমাণ নষ্ট হয়েছে ২০২১ সালে। কুমিল্লার নানুয়ার দিঘীর পাড়ে দূর্গামণ্ডপে কোরআন রাখার মতো সাজানো নাটক করে দেশব্যাপী উন্মত্ত হামলা হয়েছে হিন্দুদের ওপর। এমন পরিকল্পিত হামলা এর আগে কখনো দেখা যায়নি। কিন্তু এর বিপরীতে তাৎক্ষণিক কোনো রাজনৈতিক প্রতিরোধ ছিল না যেটা আমাদের সংখ্যালঘু মননকে আঘাত করেছে সবচেয়ে বেশি করে।

রাজনীতি থেকে নীতিকেই বাদ দিলে যা হয় সেটাই এখনকার বাংলাদেশ। রাজনীতির নৈতিকতার ভিত্তিতেই চলে সুশাসন। বঙ্গবন্ধু ধর্মবিশ্বাসের এই উদারতা নিজের রাজনীতিতে রাখতে চেয়েছিলেন আমৃত্যু এবং তাকে এই কাজটা করার জন্য কোনোদিন নিজের ব্যক্তিগত বিশ্বাসকে সর্বসমক্ষে দেখিয়ে বেড়াতে হয়নি।

ধর্মনিরপেক্ষতা এরকমই একটা বড় আদর্শের কথা বলে, আর কিছু নয়। মাত্র কয়েক দশক আগে আমাদের সমাজের বড় মানুষেরা এসব কথা বলে গিয়েছেন। এর মধ্যেই আমরা সব ভুলে গেছি।

নতুন বছরে প্রত্যাশা আমরা যেন মনে রাখতে পারি সেইসব কথা। ব্যক্তিগত জীবনে গভীরভাবে ধর্ম পালন করেও দেশের কাছে, সমাজের কাছে অবিচলিত ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারাটা মোটেও কঠিন নয়।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি