মার্কিন নিষেধাজ্ঞা ও ঢাকা-ওয়াশিংটন বোঝাপড়া
বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্ক নিয়ে যারা চর্চা করেন, তারা এ বিষয়ে অবহিত যে, শুরু থেকেই এই সম্পর্কের টানাপোড়েন ছিল। শুরুটা ১৯৭১-এ আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার সেনারা যখন বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছিল, তখন যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধ বন্ধ না করে পাকিস্তানকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছিল।
সে সময় যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ছিলেন রিচার্ড নিক্সন। তার নিরাপত্তা উপদেষ্টা ছিলেন হেনরি কিসিঞ্জার। সে সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আন্তর্জাতিক মহলকে আহ্বান জানিয়েছিলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য। অথচ কিসিঞ্জারের পরামর্শে নিক্সন তা বাতিল করে দেন। কেবল তা-ই নয়, সে সময় বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সর্বজ্যেষ্ঠ কূটনীতিক ছিলেন আর্চার ব্লাড। তিনিও মত দিয়েছিলেন যে, ওই হত্যাযজ্ঞ বন্ধে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু নিক্সন প্রশাসন এ ধরনের প্রস্তাবে কান দেয়নি, বরং পাকিস্তানের জন্য সহযোগিতা অব্যাহত রেখেছিল। ১৯৭৪ সালেও দুর্ভিক্ষের অনেক কারণের মধ্যে বলা হয় মার্কিন প্রতিশ্রুত খাদ্য সাহায্যের জাহাজ ফিরিয়ে নেওয়াকে।
বিজ্ঞাপন
অনেক ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে ঠান্ডা যুদ্ধোত্তর পর্বের অস্বস্তি অতিক্রম করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে উষ্ণতা এসেছে। বেশ কয়েকবারই সর্বোচ্চ পর্যায়ে রাষ্ট্রীয় সফর হয়েছে দুই দেশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ধসের পর বাংলাদেশ-মার্কিন ঘনিষ্ঠতার যে অধ্যায়ের সূচনা সেটা কখনো কখনো বেশ বড় রকমের হৃদ্যতার প্রকাশ, আবার কখনো কিছুটা ঠান্ডা হয়ে যাওয়ার দৃষ্টান্ত।
বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এ নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই ক্ষতিকর। উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের নামও উচ্চারিত হলো।
১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মার্কিন অর্থ দফতরের ফরেন অ্যাসেটস কনট্রোল অফিস (ওএফএসি) জানায় ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) এবং এর সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এদের মধ্যে রয়েছেন বর্তমান পুলিশ প্রধান বেনজির আহমেদ।
বাংলাদেশ যখন বিজয়ের ৫০ বছর উদযাপন করছে তখন এমন একটি বার্তা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে ডেকে প্রতিবাদ করেছে, মন্ত্রীরা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন এবং দিচ্ছেন।
আমেরিকার এই ট্রেজারি স্যাংশনকে একেবারে উড়িয়ে না দিয়ে এর পরিপ্রেক্ষিত বিশ্লেষণ প্রয়োজন। বাংলাদেশের ভাবমূর্তির জন্য এ নিষেধাজ্ঞা অবশ্যই ক্ষতিকর। উত্তর কোরিয়া, চীন, রাশিয়া, ইরানের মতো দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের নামও উচ্চারিত হলো।
আমরা মনে করি না যে, এর ফলে দুই দেশের কূটনৈতিক সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। তবে এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে নতুন হিসাব নিকাশেরও প্রয়োজন পড়তে পারে। এই নিষেধাজ্ঞা যুক্তরাজ্য ও কানাডায় প্রযোজ্য। সরকার মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়টি অস্বীকার করেছে। কিন্তু এই স্বীকার অস্বীকারের চেয়ে বেশি প্রয়োজন এমন অবস্থায় এলো কি করে তার খোঁজ নেওয়া।
দীর্ঘদিন ধরেই র্যাবের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগের কথা যুক্তরাষ্ট্র প্রশাসনের কাছে মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলে আসছিল। মার্কিন গণমাধ্যমগুলো ফলাও করে মানবাধিকার লঙ্ঘনকারী হিসেবে বাংলাদেশের নাম প্রচার করছে।
আমেরিকার রাজনীতি মূলত বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার, শিল্পপতি ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেখানে নৈতিকতা, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের মুখোশের কোনো স্থান নেই।
গত বছর অক্টোবর মাসে ট্রাম্প প্রশাসনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেওর কাছে সিনেটের আটজন সদস্য চিঠি দিয়ে র্যাবের বিরুদ্ধে কিছু সুস্পষ্ট অভিযোগ করেছিলেন। তখনই যদি বাংলাদেশ কূটনৈতিকভাবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিত, আমাদের দূতাবাস ও পররাষ্ট্র দফতর নিজেদের সংশ্লিষ্ট করতো, তাহলে এখন প্রতিক্রিয়া দেখাতে হতো না যে, আমেরিকায় আমাদের চেয়ে বেশি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।
যারা আমেরিকার রাজনীতি বোঝেন, তারা জানেন যে, আমেরিকার রাজনীতি মূলত বিনিয়োগকারী, ব্যাংকার, শিল্পপতি ও অস্ত্র ব্যবসায়ীদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। যেখানে নৈতিকতা, স্বাধীনতা বা গণতন্ত্রের মুখোশের কোনো স্থান নেই। আছে শুধু লাভক্ষতির চুলচেরা বাণিজ্য। কিন্তু তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারা ধরে রেখেছে এবং বিশ্বব্যাপী তাদের অর্থনৈতিক প্রভাব সুবিস্তৃত করে রেখেছে। খবরদারিটা সেখান থেকেই আসে।
আমেরিকায় পাড়ি দিয়েছেন বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশি। তারা স্বীকৃতি পাচ্ছেন কর্মকুশলতার। বড় অংশ ক্ষুদ্র কাজ করলেও অনেকেই এখন মূলধারায় ঢুকে পড়েছেন। তাই আমেরিকার বাংলাদেশ ধারণার মধ্যে তাদেরও ভূমিকা আছে। আমাদের বিভাজিত ও সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতির ছোঁয়া সেখানেও লেগেছে এবং অনেকেই উদ্যমী হয়ে দেশ সম্পর্কে নেতিবাচক কথা সেখানকার নীতি নির্ধারণী স্তরে পৌঁছে দিচ্ছেন। এছাড়া বৈশ্বিক বাস্তবতায় এখন কোনো দেশের কোনো তথ্যই আর অজানা থাকছে না।
এটা স্পষ্ট যে, বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত গণতন্ত্র সম্মেলনেও বাংলাদেশকে আমন্ত্রণ করেনি যুক্তরাষ্ট্র। অনেকেই বলছেন, চীন বিরোধী অবস্থানকে সংহত করতে বাইডেন এই উদ্যোগ নিয়েছেন এবং চীনের চাপেই আমন্ত্রণ পেয়েও এই সম্মেলনে যায়নি পাকিস্তান।
বাংলাদেশ পুরোপুরি চীনের দিকে চলে গেছে এমনটা বলা যাবে না। তবে চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কের একটা গতিময়তা চলছে এখন। গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের কথা বলে বিভিন্ন দেশকে চীন-রাশিয়ার পক্ষ থেকে সরিয়ে আনতে চেষ্টা করছেন বাইডেন। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও সেটা বলা যায়।
আন্তর্জাতিক রাজনীতির জটিলতা আছে। সেটা বুঝেই এগোতে হবে বাংলাদেশকে। আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করছে বাংলাদেশ। চীন আমাদের অনেকগুলো বড় প্রকল্পের অংশীদার। তাই ঢাকা-বেইজিং সম্পর্কে নজর রয়েছে আমেরিকার।
বাংলাদেশকে উপেক্ষা করা সম্ভব না আমেরিকার। ঢাকা-ওয়াশিংটন পারস্পরিক বোঝাপড়া নতুন জায়গায় নিশ্চয়ই যাবে, কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে প্রয়োজন অনেক বেশি ‘এঙ্গেজমেন্ট’। ঝঞ্ঝা আসবে যেমন এবার এলো। তবে এসব মোকাবিলার জন্য দেশের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং কূটনৈতিক শক্তি দৃঢ় করাই বাংলাদেশের অপশন।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি