বাংলাদেশ তথা এই উপমহাদেশে ‘প্রধানমন্ত্রীর সন্তান’ মানেই প্রচার-প্রচারণা, ক্ষমতা, বড় ক্ষমতার জন্য অপেক্ষা, দম্ভ, ব্যবসা-বাণিজ্য। অন্তত বাংলাদেশে অতীতে প্রধানমন্ত্রীর সন্তানদের আমরা দেখেছি। কিন্তু এই বাংলাদেশেই অন্যরকম গল্পও আছে।

সায়মা ওয়াজেদ, যার নাম পুতুল, বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হলেও তিনি প্রচারের আলোয় নেই, কিন্তু মানবতার পাশে আছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের যা কিছু অর্জন, যা কিছু কৃতিত্ব; সব তার নিজের অর্জন। এখানে তার মায়ের মানে প্রধানমন্ত্রীর কোনো ভূমিকা নেই। বাংলাদেশের মতো দেশে এটা সত্যি বিরল।

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল শুধু যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কন্যা তাই নয়। ১৯৭২ সালের ৯ ডিসেম্বর তিনি যখন জন্মগ্রহণ করেন, তখন তার মাতামহ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। জাতির জনকের দৌহিত্র বলেই তিনি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মেছেন, এমনটি বলা যাবে না।

জাতির জনক এবং রাষ্ট্রপতি হলেও মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবার যাপন করেছে এক অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত বাঙালির জীবন। এখনো ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে গেলে দেখা যাবে, রাষ্ট্রপতির পরিবারের অতি সাধারণ জীবনযাপনের চিত্র। তাই ক্ষমতার কেন্দ্রে থেকেও আড়ালে থাকার শিক্ষাটা তিনি পেয়েছেন ছেলেবেলাতেই। 

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আজ একজন বিশ্বখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন।

ক্ষমতার লোভ না থাকলেও সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের আজকের মানবদরদী মনোবিজ্ঞানী হয়ে ওঠার কৃতিত্ব অনেকটাই পাবেন তার মা শেখ হাসিনা। পুতুলের জন্মের সময় তার মাতামহ বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি থাকলেও বয়স তিন হওয়ার আগেই তারা সব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যান।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে হত্যা করা হয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। জার্মানিতে থাকায় বেঁচে যান বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা। আগের দিন রাষ্ট্রপতির কন্যা থাকা দুইজন হঠাৎ করেই সর্বহারা হয়ে যান। আশ্রয় নেই, নিরাপত্তা নেই।

শেখ হাসিনার কাঁধে তখন বিশাল দায়িত্ব। নিজের দুই শিশু সন্তান তো আছেই, আছে সন্তানের মতো ছোট বোন শেখ রেহানাও। পিতা-মাতা-ভাই-ভাবি সবাইকে হারিয়ে শেখ হাসিনা তখন উদ্বাস্তু, নয়াদিল্লিতে ছোট্ট একটি বাসায় থাকেন। কিন্তু তিনি ভেসে যাননি। শোককে শক্তিতে পরিণত করে প্রবল বিরুদ্ধ স্রোতেও হাল ধরেন শক্ত হাতে।

বঙ্গবন্ধু হত্যার ৬ বছর পর ১৯৮১ সালে দেশে ফিরে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। তার আগে ছোট বোনকে বিয়ে দিয়েছেন। নিজের দুই সন্তানকে পড়াশোনা করিয়েছেন, ভবিষ্যতের পথ দেখিয়েছেন। তাই তো শেখ হাসিনার দুই সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় এবং সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আজ শুধু তাদের মা বা মাতামহের পরিচয়ে পরিচিত নন; তারা দেশে-বিদেশে সম্মানিত, নিজেদের একাডেমিক এক্সিলেন্সের জন্য, নিজেদের গুণে। 

সায়মা ওয়াজেদ পুতুল আজ একজন বিশ্বখ্যাত অটিজম বিশেষজ্ঞ। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারাবিশ্বেই তিনি অটিস্টিক শিশুদের অধিকার নিয়ে কাজ করছেন। সায়মা ওয়াজেদ পুতুল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানসিক স্বাস্থ্যের উপর বিশেষজ্ঞ প্যানেলের একজন সদস্য। কেউ ভাববেন না প্রধানমন্ত্রীর কন্যা হিসেবে তিনি এই সুযোগ পেয়েছেন।

একজন স্বীকৃত মনোবিজ্ঞানী এবং অ্যাক্টিভিস্ট হিসেবেই তার এ অর্জন। সায়মা ওয়াজেদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মনোবিজ্ঞানে স্নাতক এবং ক্লিনিক্যাল মনস্তত্ত্বে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। স্কুল মনস্তত্ত্বেও রয়েছে তার ডিগ্রি।

ব্যারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়ই তিনি বাংলাদেশের নারীদের উন্নয়নের ওপর গবেষণা করেন। এ বিষয়ে তার গবেষণাকর্ম ফ্লোরিডার অ্যাকাডেমি অব সায়েন্স কর্তৃক শ্রেষ্ঠ সায়েন্টিফিক উপস্থাপনা হিসেবে স্বীকৃতি পায়। শিশুদের অটিজম এবং স্নায়ুবিক জটিলতা সংক্রান্ত বিষয়ের ওপর কাজের স্বীকৃতি হিসেবে বিশ্ব সংস্থা তাকে ‘হু অ্যাক্সিলেন্স’ পুরস্কারে ভূষিত করেছে। 

সায়মা ওয়াজেদ এই অটিস্টিক শিশুদের পাশে দাঁড়ালেন। বদলে দিলেন সমাজের ভাবনা। অটিস্টিক শিশুরা এখন স্পেশাল চাইল্ড, তাদের বাবা-মা এখন পাওয়ার প্যারেন্টস।

একসময় বাংলাদেশে অটিস্টিক্ট শিশুদের অবহেলার চোখে দেখা হতো। অটিজমে আক্রান্ত শিশুদের পিতামাতাদেরও দায়ী করা হতো। নিজের সন্তান নিয়ে বাবা-মা লজ্জায় থাকতেন, সন্তানকে আড়ালে রাখতেন। তাতে সেই শিশু আরও অসুস্থ হয়ে যেত।

সায়মা ওয়াজেদ এই অটিস্টিক শিশুদের পাশে দাঁড়ালেন। বদলে দিলেন সমাজের ভাবনা। অটিস্টিক শিশুরা এখন স্পেশাল চাইল্ড, তাদের বাবা-মা এখন পাওয়ার প্যারেন্টস। অটিস্টিক শিশুদের মধ্যে লুকিয়ে থাকা বিশেষ গুণ খুঁজে তুলে আনলেন সায়মা ওয়াজেদ। তারা এখন আর সমাজের বোঝা নয়, বাবা-মার সম্পদ।

তবে শুধু অটিজম নয়; প্রান্তিক জনগণের জন্য তার নানা উদ্যোগ আছে, কাজ করছেন জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত, নবায়নযোগ্য জ্বালানি নিয়েও। আসলে তার স্বপ্ন ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ, ভবিষ্যৎ বিশ্ব নিয়ে। নবজাতকের জন্য একটি বাসযোগ্য বিশ্ব গড়ার যে চিরকালীন আকাঙ্ক্ষা তা বাস্তবায়নেই কাজ করছেন তিনি।

সরাসরি রাজনীতিতে জড়িত নন সায়মা ওয়াজেদ পুতুল। কিন্তু রাজনীতি তার রক্তে। তাই রাজনীতির যে মূল লক্ষ্য মানুষের কল্যাণ, মানুষের জীবনমান উন্নয়ন; সে লক্ষ্যে আড়ালে থেকেও নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তিনি। দেশের গুণগত ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে মায়ের পাশে আছেন তিনি ভরসা হয়ে।

বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও রক্তের উত্তরসূরি সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের জন্মদিনে শুভেচ্ছা এবং আকাঙ্ক্ষা—একটি উন্নত বাংলাদেশ গড়তে মাতামহ এবং মায়ের মতো কখনো যেন ক্লান্ত না হন।

প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ
probhash2000@gmail.com