চারদিকে একটা গেল গেল রব উঠেছে। ডাক্তার মুরাদ হাসান গেল। কিন্তু কী দিয়ে গেল আর কী নিয়ে গেল সেটা বোঝা যাচ্ছে না। মুরাদ গেছেন, অনেকেই হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন। ব্যক্তিগত আক্রমণের যে বাহুল্য গত কয়েক মাস যাবৎ প্রত্যক্ষ করেছে বাংলাদেশ, তা অনেকের কাছেই অসহ্য ঠেকেছিল।

রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই। যুদ্ধ ও রাজনীতি কোনো নিয়ম মেনে চলে না। রাজনৈতিক সহিষ্ণুতা, শিষ্টাচার, নীতিবোধের উপর দাঁড়িয়ে কোনোদিনই রাজনীতি চলে না বা চলতে পারেনি এদেশে। রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ আগেও ছিল, এখনো আছে। এ আক্রমণ কখনো মনস্তাত্ত্বিক, কখনো ভাষাগত।

স্মৃতি সততই ক্ষণস্থায়ী। নচেৎ, এই ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা যে আমাদের রাজনীতির একটি বহু চর্চিত পথ, তা বুঝতে বিলম্ব হতো না। অনেকদিন ধরেই বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। স্বৈরাচার এরশাদের আমলে দুই নেত্রীকে নিয়ে নোংরা কথা বলে বিখ্যাত হয়েছিলেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন।

খালেদা জিয়ার আমলে যুদ্ধাপরাধী সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীও দেখিয়েছিলেন কতটা তিনি পারেন। কিন্তু সম্প্রতি দু’দুটো ঘটনায় এখন আলোচিত ব্যক্তি সদ্য বিদায় নেওয়া তথ্য প্রতিমন্ত্রী ডাক্তার মুরাদ হাসান, এমপি। প্রথমে তারেক রহমানের কন্যা জাইমা রহমানকে নিয়ে একটি অনলাইন শো-তে এসে বাজে কথা বলেছেন। একদিন না যেতেই বের হয়েছে এক চলচ্চিত্র নায়িকার সাথে তার ফোনালাপ যেখানে তিনি ধর্ষণের হুমকিও দিচ্ছেন।

যে অবস্থাতেই হোক, যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছে তার মুখ দিয়ে, সেসব কথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সীমারেখার মধ্যে তো স্থান পায় না, সামাজিকতা বা সুস্থ রুচির গণ্ডিতেও কোথাও ঠাঁই নেই সেসব কথার।

প্রধানমন্ত্রী ব্যবস্থা নিয়েছেন এবং প্রশংসিত হচ্ছেন দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ায়। এরকম অডিও-ভিডিও ভাইরালের কারণে পদ গেছে গাজীপুর ও রাজশাহীর কাটাখালীর মেয়রের। কিন্তু সংবেদনশীল মানুষের প্রশ্ন, এরকম কত রকমভাবে অবক্ষয়ের মুখ দেখতে হবে রাজনীতিকে? কারণটা এই যে, তিনি কোনো সাধারণ নাগরিক নন, একজন চিকিৎসক, জনপ্রতিনিধি এবং প্রতিমন্ত্রী। তিনি যে ভাষার প্রয়োগ করলেন, তাতে এইসব নেতা-নেত্রীর রাজনৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে।

ফোনালাপটা গোপনেই ছিল, কেউ ফাঁস করে দিয়েছে। কিন্তু তার ফেসবুকের অনুষ্ঠানটি প্রকাশ্যে। যে অবস্থাতেই হোক, যেসব কথা উচ্চারিত হয়েছে তার মুখ দিয়ে, সেসব কথা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের সীমারেখার মধ্যে তো স্থান পায় না, সামাজিকতা বা সুস্থ রুচির গণ্ডিতেও কোথাও ঠাঁই নেই সেসব কথার।

সামাজিক ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ থাকলে কেউ এ ধরনের মন্তব্য যে করতে পারেন না, সে তো বলাবাহুল্য। এই মন্তব্যগুলো বলে দিচ্ছে, ন্যূনতম রাজনৈতিক শিক্ষাদীক্ষা ও শিষ্টাচারের অভাব রয়েছে এই নেতার। তিনি ভব্যতা ও শিষ্টাচারকে অতিক্রম করেছেন ভয়ংকরভাবে। তার বক্তব্য সরাসরি নারী বিদ্বেষী ও বর্ণবাদী। অথচ এই তিনিই কিছুদিন আগে দেশ থেকে রাষ্ট্রধর্ম বাতিলের কথা বলেছিলেন, তখন অনেক উদারনৈতিক মানুষ তাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আজ তারা লজ্জিত হচ্ছেন।

গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে একদলের সঙ্গে অন্যদলের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকবেই। একদল অন্যদলকে আক্রমণ করবে, এটাও অত্যন্ত স্বাভাবিক। কিন্তু আক্রমণ তো হবে রাজনৈতিক, সমালোচনা তো হবে নীতির প্রশ্নে, রুচি বহির্ভূতভাবে কাউকে ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন করা হবে বা তার পরিবারের সদস্যদের চরিত্রহনন কেন করা হবে? অন্যদিকে একজন চলচ্চিত্র নায়িকাকে এই ভাষায় চাপে ফেলার অর্থইবা কী?

রাজনীতিতে একদলের সঙ্গে অন্যদলের লড়াই আসলে নীতির সঙ্গে নীতির লড়াই। নীতির প্রশ্নে মতবিরোধ, বিতণ্ডা, সংঘাত চরমে পৌঁছনোও কোনো অস্বাভাবিক কিছু নয়।

বিএনপি আওয়ামী লীগকে আক্রমণ করে, আওয়ামী লীগ বিএনপিকে আঘাত করতে চায়। এগুলো সবই রাজনৈতিকভাবে। কিন্তু তা বলে ব্যক্তিগতভাবে যে রুচিহীন ও অসংসদীয় ভাষায় আক্রমণ তথ্য প্রতিমন্ত্রীর দিক থেকে এলো তার স্থান রাজনীতির কোনো স্তরেই থাকার কথা নয়। এখন নানা ভিডিও বের হচ্ছে, প্রকাশিত হচ্ছে তার উগ্র আচরণ।

আগেই বলেছি, এই আক্রমণ কোনো অচেনা ঘটনা অবশ্য নয় রাজনীতিতে। আজ ডাক্তার মুরাদের কথা নিয়ে হইচই হচ্ছে। আগেও অনেকেরটা নিয়ে হয়েছে। সমস্যাটা হলো, বারবার সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েও কু-কথার স্রোত থামতে চায় না রাজনীতিতে। এটা দুর্ভাগ্যজনক।

আজ ডাক্তার মুরাদের কথা নিয়ে হইচই হচ্ছে। আগেও অনেকেরটা নিয়ে হয়েছে। সমস্যাটা হলো, বারবার সমালোচিত এবং নিন্দিত হয়েও কু-কথার স্রোত থামতে চায় না রাজনীতিতে।

রাজনৈতিক সংস্কৃতি বলে কিছু নেই আর। রাজনৈতিক শিক্ষার অভাব বাড়ছে বলেই যে এইসব অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে তা বুঝতে হবে। রাজনৈতিক শিক্ষা যাদের নেই, দায়িত্বশীল ভূমিকাগুলো থেকে তাদের দূরে রাখতে হবে। না হলে এই রাজনৈতিক অপসংস্কৃতি থামার নয়।

বাংলাদেশের রাজনীতির পরিসরে সৌজন্য অতি স্বাভাবিক এবং সুলভ—এমন কথা আমরা বলতে পারছি না অনেকদিন থেকেই। নির্বাচনী মৌসুম এলে আসর মাতাতে কত কথাই হয়। কিন্তু সাধারণ পরিস্থিতিতে অনেক সময়েই রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা আচরণগত অসৌজন্যে পর্যবসিত হয়ে থাকে।

অথচ গণতন্ত্র রাজনৈতিক বিরোধিতা প্রকাশের স্বীকৃত ও অবাধ মঞ্চ সরবরাহ করে। আর সেজন্যই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনীতিকদের সামাজিক আচরণে পারস্পরিক সৌজন্য প্রকাশের যুক্তি ও অবকাশ দুই-ই গুরুত্বপূর্ণ।

রাজনীতির পরিসর থেকে সহজ সৌজন্য ক্রমশ অন্তর্হিত হচ্ছে বলেই হয়তো অনেকেই এমন বক্তব্যকে আবার নানা যুক্তি দিয়ে সমর্থনও করছে। বলার চেষ্টা হচ্ছে, অতীতে অমুকে অমুকটা বলেছিল, তখন কেন এত কথা হয়নি? এই প্রশ্ন করাটাও আরেক অপসংস্কৃতির প্রকাশ।

রাজনৈতিক সৌজন্য এখানকার সংস্কৃতি থেকে অন্তর্হিত। এর সূচনা কবে, সেই তর্কে আর না যাই। তবে বিপক্ষের রাজনীতিকদের সম্পর্কে নানাবিধ অসৌজন্যমূলক উক্তি, এমনকি তাদের শারীরিক অসামর্থ্য নিয়ে ব্যঙ্গবিদ্রূপের ঐতিহ্যও বহুদিনের। এই অসৌজন্য রাজনীতিকদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে বলতে হবে। প্রায় সবাই কোনো না কোনো সময় এসব মন্তব্য করেছেন এবং করেন।

বিপক্ষের নেতাকে গালি দেওয়া, খুনের হুমকিতে আস্ফালন নতুন নয়। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী, শাহ মোয়াজ্জেমরা না থাকলেও দেশ যেন আবার অশোভন আচরণের পুরাতন বৃত্তে ফিরেছে। শুধু রাজনীতিক নয়, একজন চলচ্চিত্র নায়িকাকে উদ্দেশ্য করে এমন উচ্চারণ আমাদের জানিয়ে দেয় এদেশের রাজনীতি কোথায় চলেছে।

রাজনীতিকরাই সমাজকে ঠিক ঠিক চেনেন, জানেন, তাই তারাই নিজেদের আচরণকেও সেই পর্দায় বেঁধে নেন। রুচিশীল সংস্কৃতিমান রাজনীতিতে ফিরবে কি না বলতে পারছি না।

বাংলাদেশের রাজনীতি থেকে কৌতুক, তির্যকতা এবং খানিক দুষ্টুমি বিদায় নিয়েছে। তার স্থলে এসেছে অশ্লীলতা। নীতির প্রশ্ন ছেড়ে, রাজনৈতিক বিরোধের গণ্ডি অতিক্রম করে ব্যক্তিকে আক্রমণ করার কারণ রাজনীতি আদর্শ থেকে সরে গিয়ে স্তরে স্তরে ব্যক্তি কেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে। তারা প্রমাণ করে ছেড়েছে রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য, দল নয়। রাজনীতি মানে সেই ব্যক্তিদের কাছে প্রশ্নহীন আনুগত্য।

সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি