ওমিক্রন প্রতিরোধে আমরা কি প্রস্তুত?
সম্প্রতি দক্ষিণ আফ্রিকায় করোনাভাইরাসের নতুন একটি ভ্যারিয়েন্ট আবিষ্কৃত হয়েছে, যার নাম দেওয়া হয়েছে ‘ওমিক্রন’। ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে এর সংক্রমণ ক্ষমতা ও ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে। বিশ্বের কয়েকটি দেশে এই ‘ওমিক্রন’ নিয়ে গবেষণাও শুরু হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ইতিমধ্যেই এই ভ্যারিয়েন্টকে ‘উদ্বেগজনক’ হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
ইতিপূর্বে করোনাভাইরাসের আরও চারটি ভ্যারিয়েন্ট (আলফা, বিটা, গামা, ডেল্টা)-কে উদ্বেগজনক হিসেবে উল্লেখ করেছিল সংস্থাটি। নিকট অতীতে আমরা বিশ্বজুড়ে ‘ডেল্টা’ ও ‘ডেল্টা প্লাস’ ভ্যারিয়েন্টের ভয়াবহতা লক্ষ্য করেছি। যদিও ‘ওমিক্রন (Omicron)’ এর সংক্রমণ ক্ষমতা ও ক্ষতিকর প্রভাব নিয়ে এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি, তথাপি এর বিস্তার রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ও সতর্কতা একান্ত কাম্য।
বিজ্ঞাপন
সর্বশেষ প্রাপ্ত তথ্য মতে, ‘ওমিক্রন’ বিশ্বের ৩৮টি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতেও ৩২ বার রূপ বদলকারী এই ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত হয়েছে। ‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ ক্ষমতা এবং ক্ষতিকর প্রভাব অন্যান্য ভ্যারিয়েন্ট যেমন ‘ডেল্টা’ বা ‘ডেল্টা প্লাস’ এর তুলনায় মারাত্মক কি না তা পরিষ্কারভাবে জানা না গেলেও এর বিস্তার যে দ্রুতগতিতে ঘটছে তা নিয়ে সন্দেহের কোনো কারণ নেই। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞগণ এ কারণেই উৎকণ্ঠিত।
ইতিপূর্বে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে ভারতের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করেছি। ভারতে সংক্রমণের পরপরই বাংলাদেশেও করোনার ঢেউ আঘাত হানে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়ে যায় বিধ্বস্ত। আক্রান্ত দেশসমূহ থেকে আগত যাত্রীদের যথাযথভাবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে না পারা, কন্টাক্ট ট্রেসিং এবং টেস্টের সীমাবদ্ধতা ছিল এই বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ।
দীর্ঘ প্রায় দেড় বছর পর দেশের পরিস্থিতি এখন স্বাভাবিক হতে শুরু করেছে। করোনা সংক্রমণের হার এখন শতকরা ২ ভাগের নিচে। বিপুলসংখ্যক মানুষকে টিকার আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে ইতিমধ্যে। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন পরে সম্প্রতি খুলে দেওয়া হয়েছে।
ইতিপূর্বে ডেল্টা ভ্যারিয়েন্টের তাণ্ডবে ভারতের বিপর্যস্ত পরিস্থিতি আমরা লক্ষ্য করেছি। ভারতে সংক্রমণের পরপরই বাংলাদেশেও করোনার ঢেউ আঘাত হানে। স্বাস্থ্যব্যবস্থা হয়ে যায় বিধ্বস্ত...
স্কুল কলেজগুলোতে নিয়মিত পাঠদানও শুরু হয়েছে। এইচএসসি পরীক্ষা শুরু হয়েছে, শেষ হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো। সব মিলিয়ে জনসাধারণ অনেকটাই স্বস্তিতে। কিন্তু স্বস্তিদায়ক এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে দ্রুত বিস্তার লাভকারী এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে। বিজ্ঞানীরা ওমিক্রনের বিভিন্ন পয়েন্টে মিউটেশন বিশ্লেষণ করে এর প্রভাব সম্পর্কে তাত্ত্বিক ধারণা দিয়েছেন।
প্রাথমিক ধারণামতে, অন্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এর পুনরায় সংক্রমণ ক্ষমতা বেশি এবং শরীরের প্রতিরোধ ব্যবস্থা ফাঁকি দিতে সক্ষম। এছাড়াও মিউটেশনের কারণে এটি টিকার কার্যকারিতা হ্রাস অথবা অকার্যকর করে দিতে পারে। তবে এ সমস্ত তথ্যের পক্ষে পর্যাপ্ত প্রমাণাদি এখনো পাওয়া যায়নি।
অন্য ভ্যারিয়েন্টের তুলনায় এটির প্রভাব বেশি হোক বা কম আমাদেরকে এখন থেকে সর্তকতামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। প্রথমত, বিমানবন্দরগুলোতে করোনা পরীক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আক্রান্ত দেশসমূহ থেকে আগত যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।
আক্রান্ত দেশসমূহ থেকে আগত যাত্রীদের কারও সংক্রমণ ধরা পড়লে তার সংস্পর্শে আসা ব্যক্তিদের কন্টাক্ট ট্রেসিং এর মাধ্যমে টেস্টের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। আক্রান্ত ব্যক্তিদের আইসোলেশনে রেখে যথাযথ চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
দ্বিতীয়ত, অফিস আদালত ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বিপণিবিতান ও অন্যান্য জনসমাগম স্থলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে ও মাস্ক পরিধানে বাধ্য করতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। যেহেতু জনগণের মধ্যে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার প্রবণতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে, সেহেতু প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার, প্রচারণা চালিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে পুনরায় জনসাধারণকে সতর্ক করতে হবে।
শেষ হয়েছে এসএসসি ও সমমানের পরীক্ষাগুলো। সব মিলিয়ে জনসাধারণ অনেকটাই স্বস্তিতে। কিন্তু স্বস্তিদায়ক এই পরিস্থিতি বদলে যেতে পারে দ্রুত বিস্তার লাভকারী এই নতুন ভ্যারিয়েন্টের সংক্রমণে।
তৃতীয়ত, দেশে চলমান টিকা কার্যক্রম আরও বেগবান করতে হবে। কারণ টিকার মাধ্যমে করোনার সংক্রমণ হার এবং হাসপাতালে ভর্তির হার নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।
সর্বোপরি ওমিক্রন নিয়ন্ত্রণ ও প্রতিরোধ কল্পে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা কর্তৃক জারীকৃত সতর্কতা সমূহ মেনে চলতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখা কর্তৃক নির্দেশিত পদক্ষেপসমূহ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করার পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পরিশেষে, সরকারের পক্ষ থেকে ওমিক্রনের সম্ভাব্য ভয়াবহতা সম্পর্কে প্রতিনিয়ত সতর্কবাণী প্রচার করতে হবে যাতে করে জনসাধারণ প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধিগুলো মেনে চলে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে দ্রুত প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। করোনা অতিমারির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ যুদ্ধে জনসাধারণকে সচেতনভাবে এগিয়ে আসতে হবে। সরকারের বিধিনিষেধগুলো মেনে যথাযথ স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে চলাচল করতে হবে।
দেশের নাগরিক হিসেবে আমরা চাই না আবার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমূহ বন্ধ হোক। আমরা চাই না আবার অফিস-আদালত, ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হোক। আবারও লকডাউনের মতো কোনো পরিস্থিতির উদ্ভব হোক আমরা তা চাই না। আসুন সবাই সচতেন হই, ওমিক্রন প্রতিরোধ করি।
অধ্যাপক ড. ফিরোজ আহমেদ ।। চেয়ারম্যান, ফার্মেসি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়