তারুণ্য, মুক্তিযুদ্ধ ও দেশপ্রেম
তরুণ এবং তারুণ্যের ভাষা ভিন্ন। তারুণ্যের কোনো সীমাবদ্ধতা নেই, নেই বয়স। তরুণ বয়সে মানুষ সবচেয়ে বেশি সৃজনশীল, প্রগতিশীল এবং সচেতন থাকে। আমাদের ইতিহাসে তরুণরাই সবসময় সাম্যের গান গেয়ে এসেছে এবং তারুণ্যই প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে। তারপরও আমরা যেকোনো উত্থান-পতনে তারুণ্য নয়, তরুণদের দিকে দোষ চাপাতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি। অথচ সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্যের বিকল্প নেই।
তরুণদের দিকে আঙুল তুলবার আগে নিজেকে প্রশ্ন করে দেখুন তো, দেশ বা দশের জন্য কতখানি সচেতনতা আপনারা প্রজন্মের মাঝে বাহিত করতে পেরেছেন? রাষ্ট্র বা সমাজ কতটুকু সচেতন হয়ে কৃষ্টি, ঐতিহ্য বা ইতিহাস নিয়ে প্রজন্মের জন্য চর্চা করছে! তরুণদের নিয়ে কথা বলতে বলা হয়েছে আজ, তারুণ্য ব্যবচ্ছেদ নয়, তরুণের সাথে তারুণ্যে বিচ্ছেদের কথা বলব।
বিজ্ঞাপন
আজকাল অল্পবয়সী ছেলেমেয়েদের নিজের দেশ, একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন জেনোসাইডকে ‘তেমন কিছু নয়’ বা পাকিস্তানকে সমর্থন করাটাও ‘তেমন কিছু নয়’ বলে ভাবপ্রকাশ করতে দেখা যায়। এসব দেখে আমিও আজকাল আগের মতো খুব হতভম্ব হই না, আঙুল তুলে প্রজন্মের দোষ দিতে পারি না।
গত তিন টার্ম ধরে এবং এখনো চলমান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রক্ষমতায় বসে আছে। তাদের দল থেকেই সরকারের প্রতিনিধি তৈরি করা হয়েছে। অথচ এতগুলো বছর পার করার পরও তারা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানিদের বর্বরতা এবং অপরাধের গুরুত্ব মাথায় জোগান দেওয়ার মতো শিক্ষাব্যবস্থা তৈরি করতে পারেনি। এতগুলো বছর পার করার পরও সাদা আর কালোর মাঝে পার্থক্য খুঁজে নেওয়ার পন্থা বা পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারেনি।
আমাদের ইতিহাসে তরুণরাই সবসময় সাম্যের গান গেয়ে এসেছে এবং তারুণ্যই প্রতিবাদের ভাষা হয়েছে। সমাজ পরিবর্তনে তারুণ্যের বিকল্প নেই।
গত এক যুগেরও বেশি সময় ধরে একাত্তর, মুক্তিযুদ্ধ, দেশকে নিজেদের বক্তব্যের মাঝে ট্যাগলাইন হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। ত্রিশ লাখ শহীদের রক্তস্নাত গভীর চেতনাকে আগামীর কাছে হাস্যকর করে তুলেছে। দেশ থেকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছে তরুণেরা।
প্রজন্মের ইতিহাস, কৃষ্টি, ঐতিহ্য, দেশপ্রেম তাদের আর টানে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়া আওয়ামী লীগ এবং তাদের তৈরি সরকারকে গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন মনে করে না আর। তাদের এইসব উপেক্ষার দোষ শুধুই কি তরুণদের কাঁধে চাপানো যায়? স্মরণ করুন, একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধাদের বেশিরভাগই যেমন তরুণ বয়সের ছিল আবার রাজাকার, আলবদর, আলশামসের গাদ্দারেরাও কিন্তু তেমনই তরুণ বয়সী ছিল।
যে দেশে এখনো নিরক্ষর মানুষের হার ২৪ শতাংশ, সেই দেশ সম্পূর্ণ ডিজিটাল করার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছে গত একদশকের বেশি সময় ধরে। সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন, ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটক। যেদিকে তাকানো যায় সেদিকেই ছেয়ে থাকে মোবাইল ফোন কোম্পানির পোস্টার, বিলবোর্ড, বিজ্ঞাপন।
কে কত সস্তায় ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবে, তাই নিয়ে ভাবনা সবার। অথচ ফোনের চিহ্ন চেনার মতো জ্ঞানও নেই অনেকের। বায়োমেট্রিক পদ্ধতি, যা নিয়ে প্রাথমিক জ্ঞান প্রয়োজন।
হাতের ছাপে সিম তুলতে গেলে যারা একদমই পড়াশোনা জানেন না তেমন মানুষগুলো বেশিরভাগ সময় এজেন্টের প্রতারণার শিকার হন, হাতের ছাপ সঠিক হয়নি বলে একই ব্যক্তির তথ্য ব্যবহার করে তিন চারটি আলাদা সিম তুলে নেয়। এসব সিমগুলো এলাকার কিশোর গ্যাং বা তরুণদের কাছে বিক্রি করে এজেন্টরা। তরুণদের মাঝে , ঘৃণা, বিদ্বেষ ছড়ানো, অশ্লীল ভিডিও ধারণ এবং ভাইরাল করার প্রবণতা এই অবৈধ সিমগুলোর মাধ্যমেই সংঘটিত হচ্ছে।
সর্বক্ষেত্রে ডিজিটাল সুবিধা দেওয়ার আগে নিয়মনীতি মেনে কোনো সঠিক সিদ্ধান্ত বা পন্থা আজ পর্যন্ত নেওয়া হয়নি। ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার রূপকার বাংলাদেশ, অথচ তরুণদের ডিজিটাল দক্ষতায় তৈরি করার কারিকুলাম নেই শিক্ষাব্যবস্থায়। দক্ষতার অভাবে ডিজিটাল বাংলাদেশের তরুণেরা পণ্য হয়ে যাচ্ছে, বিদেশি তরুণ যারা ডিজিটালি দক্ষ তারা বিভিন্ন সংস্থায় চাকরি নিয়ে বসে আছে।
বেকারত্ব বাড়ছে দ্বিগুণ। অঢেল সময়ে ক্লান্ত খরচে বেকার তরুণেরা ঝুঁকে পড়ছে অসামাজিক কার্যকলাপে। অনলাইন আসক্তি বাড়েছে বহুগুণ। অসম অপকর্মে জড়িত হয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম। সব জেনে আমরা কী করছি?
ধর্ষণ ঊর্ধ্বগামী হলে পর্নসাইট বন্ধ, নারী পাচার বেড়ে গেলে টিকটক বন্ধ করার উদ্যোগ নিচ্ছি। শেকড় নয় ডালের পাতা উপড়ে ফেলতে চাচ্ছি। সেই বাগধারার কথা মনে হয় বারবার, ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গেল।গত দুই-তিন দশকে সব থেকে ভয়াবহ স্খলন ঘটেছে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে। নির্দিষ্ট কিছু মানুষের কাছে সংস্কৃতি বর্গা দিয়ে চলছে। উন্নয়ন সকলেই চায়। অথচ উন্নয়নের কাঠামো তৈরিতে প্রচুর বাজেট থাকলেও ভিত তৈরিতে কার্পণ্য।
বেকারত্ব বাড়ছে দ্বিগুণ। অঢেল সময়ে ক্লান্ত খরচে বেকার তরুণেরা ঝুঁকে পড়ছে অসামাজিক কার্যকলাপে। অনলাইন আসক্তি বাড়েছে বহুগুণ। অসম অপকর্মে জড়িত হয়ে যাচ্ছে প্রজন্ম। সব জেনে আমরা কী করছি?
একটা মেট্রোরেলের লেন তৈরি করার যা খরচ তার সামান্য দিয়েই দেশজুড়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড বাড়ানো যেতে পারত, এলাকাভিত্তিক লাইব্রেরি গড়ে তোলা যেত, শিশুদের খেলার মাঠ তৈরি করা যেত, হাতে-কলমে কাজ শেখানোর জন্য টেকনিক্যাল স্কুল খোলা যেত, তৃণমূলে অল্প শিক্ষিতের মাঝে মৌলিক অবক্ষয় রোধে কাজ করার জন্য শিক্ষক ব্রিগেড গড়ে তোলা যেত, শিক্ষাব্যবস্থায় মুক্তিযুদ্ধ, ভাষা আন্দোলনের বই ছাপানো এবং পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা যেত।
অথচ ওই যে বসে থাকা বর্গা নেওয়া মানুষগুলো, নিজেদের তল্পিতল্পা গোছাতেই ব্যস্ত, বুদ্ধিবৃত্তি বা মনন চর্চায় প্রজন্মের হাত ধরে ছিটেফোঁটা চর্চা তাদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে অক্ষম হয়েছেন। তারা শিশুকিশোরের জন্য কোনো সংগীত একাডেমি গড়ে তোলেনি, নাট্যদল তৈরি করেনি, ছবি আঁকার স্কুল গঠন করেনি। তরুণদের মাঝে সাংস্কৃতিক চেতনা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজটি তারা করে যাচ্ছে না। জোর কণ্ঠে দাবি তোলেননি আগামীর জন্য পার্থিব আধুনিকতার উন্নতি থেকে মানসিকভাবে সাংস্কৃতিক উন্নয়ন বৃদ্ধি করায় মনোযোগী হওয়াটা কতটা জরুরি!
পরিবার, শিক্ষা, সমাজ, সরকার, জনগণের সঠিক চাওয়া পাওয়ার স্বচ্ছ আয়নায় তারুণ্য জাগ্রত হয়। তরুণেরা আগুনের মতো। তাদের সত্য পথ দেখালে পাহাড়ের চূড়া জয় করতে একটুও দ্বিধা করে না। আবার অসত্য পথে হোলি আর্টিজান হামলার মতো জঘন্য অপকর্ম করতেও বাঁধ সাধে না।
এক ঝাঁক অলৌকিক তরুণের চেতনায়, মননে এবং কর্মে তৈরি হয়েছিল বর্ণ, ধর্ম, শ্রেণি ভেদাভেদের ঊর্ধ্বে, এক অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের মানচিত্র। যে দেশে উগ্রবাদ, ধর্মভিত্তিক রাজনীতি, স্বৈরাচার, অসম অধিকার, মুক্তবাক রুদ্ধতার দেখা মিলবে না। অথচ বাংলাদেশ সেইসব কথা মনে রাখেনি। ওই সব তরুণের কথা চর্চা করেনি। তাদের সাংস্কৃতিক মনোভাবনার কথা ছড়িয়ে দেওয়া প্রয়োজন মনে করেনি।
বেঁচে যাওয়া স্বাধীনতা বিরোধীরা আজ সরবে উগ্র মৌলবাদের সংস্কৃতি চর্চা করছে। পিছিয়ে পড়েছি আমরা। থমকে গেছে প্রগতিশীলতা। থমকে গেছে তারুণ্য। থমকে যাচ্ছে জনতা।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা