অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম (১৯৩৪-২০২১) গত হয়েছেন। মৃত্যুকালে বয়স হয়েছিল সাতাশি বছর। সাধারণ অভিজ্ঞতা থেকে বলা যায়, তিনি অকালে মারা যাননি। কিন্তু তার মতো লব্ধপ্রতিষ্ঠ ব্যক্তি জনগোষ্ঠীর কাছে অভিভাবকত্বের ভরসা হয়ে ওঠেন। প্রতিষ্ঠা, অভিজ্ঞতা ও অবদানের ভিত্তিতে সামষ্টিক সিদ্ধান্তের কোনো কোনো মুহূর্তে তারা দিকনির্দেশনা দিতে পারেন। বহু মানুষের কাছে অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের সে অবস্থান ছিল। সেদিক থেকে তিনি শূন্যতা রেখে গেছেন।

কিন্তু এদিকটা বাদ দিলে বলা যায়, তিনি খুব সফল ও সার্থক জীবন কাটিয়েছেন। বুদ্ধিবৃত্তিক ও বিদ্যাগত অবদানের ভিত্তিতেই তার ওই সাফল্য অর্জিত হয়েছে। বলা যাবে, সময় ও ভাগ্য তার সহায় ছিল। তিনি নিজে প্রস্তুত ছিলেন। আর সময়ের পাটাতনে সাধ্যমতো আঁচড় কাটতে পেরেছিলেন।

বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদী জাগরণের দুই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলনের কিছু দুর্লভ ফটোগ্রাফ তিনি ধারণ করেছিলেন নিজের ক্যামেরায়। প্রত্যক্ষদর্শী ও অংশগ্রহণকারী হিসেবে তিনি একদিকে হয়ে উঠেছিলেন ভাষা-আন্দোলনের ইতিহাসের উৎস, অন্যদিকে তার তোলা আলোকচিত্রগুলো জাতীয় স্মৃতি-আর্কাইভের অনিবার্য অংশ হয়ে উঠেছিল।

একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে তিনি হানাদার বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ প্রতিপক্ষ হিসেবে সাব্যস্ত হয়েছিলেন। পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর বন্দিশিবিরে আটকে থাকা এবং নির্যাতিত হওয়া সে ইতিহাস প্রত্যক্ষ সাক্ষ্য হয়ে আছে।

বাংলাদেশের মানুষের জাতীয়তাবাদী জাগরণের দুই উত্তুঙ্গ মুহূর্তে অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। বায়ান্নের ভাষা-আন্দোলনে...

 

জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠার জন্য তার আরেকটি অনুকূল অবস্থান ছিল। বাংলা বিভাগের ছাত্র ও শিক্ষক হিসেবে তিনি ওই আবহের মধ্যেই ছিলেন, যেখানে জাতীয়তাবাদের সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক পাটাতন নির্মাণের নানা তৎপরতা চলছিল। ফলে ষাটের দশকের প্রতীকী তাৎপর্যমণ্ডিত নানা ঘটনা, যেমন, বাংলা বিভাগ আয়োজিত শিক্ষা সপ্তাহ, রবীন্দ্রচর্চা, বাংলা নববর্ষ পালনের উদ্যোগ, বাংলা ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তান সরকারের সাথে লড়াই ইত্যাদির সাথে তার প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ নানা সংযোগ ছিল।

বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র-শিক্ষক হিসেবে তিনি বিদ্যাজীবীর নানা ধরনের কাজ করেছেন। তার পক্ষে বাড়তি ভূমিকা রাখা সম্ভব হয়েছে ভাষাবিজ্ঞানের প্রশিক্ষণ ও গবেষণার মধ্য দিয়ে।

কর্নেল ইউনিভার্সিটিতে এমএ করা ছাড়াও বেশ কয়েকটি মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। এর প্রত্যক্ষ ফল হয়েছে ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে বাংলায় পাঠ্যপুস্তক রচনা। কিন্তু পড়াশোনা ও গবেষণার বাড়তি প্রত্যয় সারাজীবন ধরে তার আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে প্রতিফলিত হয়েছে।

বাংলা ভাষার প্রসার ও প্রচারে তিনি কাজ করেছেন আন্তরিকতার সাথে; অন্যদিকে সংস্কৃতের প্রভাবমুক্ত বাংলা ব্যাকরণের কথাও প্রচার করেছেন সারাজীবন। বাংলা একাডেমির উচ্চাভিলাষী প্রকল্প প্রমিত বাংলার ব্যাকরণ-প্রণয়নে সম্পাদক হিসেবে দায়িত্বপালন এক অর্থে তার ওই অবস্থানেরই ধারাবাহিক পরিণতি।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন। এর মধ্যে ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিহাস-প্রণয়নে তার ভূমিকা সম্ভবত আরও বহুদিন আমাদের কাজে লাগবে।

তবে লেখালেখি, পাণ্ডিত্য, গবেষণা ইত্যাদির ক্ষেত্রে তার কৃতিত্বের প্রধান এলাকা কাজী নজরুল ইসলাম। বিদ্যাচর্চার এ এলাকায় তার আবেগ ও শ্রম এক কাতারে এসে মিলেছিল। বিচিত্র ধরনের কাজ করেছেন তিনি।

নজরুল-জীবনী প্রণয়নে তার ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। নজরুল-জীবনের জটিল পর্বগুলোতে তিনি তথ্য-উপাত্তের সাহায্যে প্রায়ই নতুন আলো ফেলতে পেরেছেন। সবসময় যে তার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে এমন নয়। কিন্তু সিদ্ধান্ত গ্রহণের পদ্ধতি এবং গৃহীত সিদ্ধান্তের বলিষ্ঠতার কারণে তার গবেষণা এ বিষয়ে অন্যতম আকরগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বিচিত্র বিষয়ে লিখেছেন। এর মধ্যে ভাষা-আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নানা দিক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইত্যাদি ক্ষেত্রে ইতিহাস-প্রণয়নে তার ভূমিকা সম্ভবত আরও বহুদিন আমাদের কাজে লাগবে।

জীবনীর বাইরে নজরুল প্রসঙ্গে তার অন্য কাজও প্রচুর। বস্তুত নজরুল সাহিত্যের প্রায় সব প্রান্ত নিয়েই তিনি মূল্যবান আলোচনা করেছেন। নজরুলের জীবন ও সমসাময়িক ঘটনাবলি সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারণা থাকায় বহু কবিতা এবং অন্য রচনা সম্পর্কে তিনি এমন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পেরেছেন, যা অন্যদের পক্ষে খুব সহজ ছিল না।

কবিতাসহ অন্য বহু নজরুল রচনার বিস্তারিত আলোচনা ও বিশ্লেষণ তার প্রণীত গ্রন্থগুলোকে নজরুল চর্চার আকর গ্রন্থের মর্যাদা দিয়েছে। কিন্তু আসলে এটুকু বললেও অধ্যাপক রফিকুল ইসলামের নজরুল-গবেষণা ও নজরুল-লিপ্ততার মর্ম ঠিকমতো বোঝা যাবে না।

বলা উচিত, বাংলাদেশে যে দু-চারজন ‘বিষয়’ হিসেবে নজরুলকে প্রতিষ্ঠা দিয়েছেন, তিনি তার মধ্যে প্রধান। এ বিষয়ে তার পাণ্ডিত্যের প্রদর্শনী বাংলাদেশের টিভি-দর্শক ও বক্তৃতার শ্রোতাদের জন্য বহু দশক ধরে ছিল এক আনন্দময় অভিজ্ঞতা।

তিনি নজরুলের কবিতা-গান ও অন্য লেখালেখি সম্পর্কে স্মৃতি থেকেই ঈর্ষণীয় পরিমাণের তথ্য-উপাত্ত উদ্ধৃত করতে পারতেন। জুতমতো সেগুলো ব্যবহার করতে পারতেন। তার এ সক্ষমতা সামগ্রিকভাবে নজরুল চর্চার একটা অন্য মাত্রা তৈরি করেছিল। নজরুল-রচনাবলীর নতুন সম্পাদনায় তার এ বিশেষজ্ঞতা প্রত্যক্ষ ভূমিকা রেখেছিল। একই কারণে নজরুল-বিশেষজ্ঞ হিসেবে দেশে-বিদেশে তার নির্ভেজাল স্বীকৃতিও মিলেছে।

রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক স্বীকৃতি তিনি প্রথম থেকেই পেয়ে আসছিলেন। একজন বিদ্যাজীবীর জন্য আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্র যত ধরনের স্বীকৃতির বন্দোবস্ত রেখেছে, তিনি বস্তুত তার প্রায় সবই পেয়েছেন। কাজ করেছেন বিদ্যা-প্রতিষ্ঠানের প্রচলিত বড় পদগুলোতেও। সেদিক থেকে বলা যায়, একজন বিদ্যাজীবী হিসেবে ইহজীবনে তিনি একজন সফল মানুষ। কিন্তু অন্তত তিনটি ক্ষেত্রে মৃত্যুর পরেও সফল থাকার বন্দোবস্ত তিনি করে গেছেন: জাতীয়তাবাদী ইতিহাস, জাতীয়তাবাদী ইতিহাসের বয়ান-নির্মাণ এবং নজরুল-গবেষণা।

ড. মোহাম্মদ আজম ।। অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়