গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে চীনের দ্রুতগতির রেলের ভূমিকা
২০১৫ সালে ব্রিটিশ সাংবাদিক টম চেসহিল চীন ভ্রমণে আসেন। বহু বিদেশি পর্যটকের মতো, চীনে তারও প্রথম গন্তব্য ছিল সি’আন। বেইজিং থেকে সি’আনের দূরত্ব ১১০০ কিলোমিটার। দ্রুতগতির রেলে এই দূরত্ব অতিক্রম করতে তার সময় লাগে মাত্র সাড়ে ৫ ঘণ্টা। সি’আন ঘুরে দেখার পর, তিনি উহান যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এবার দ্রুতগতির ট্রেনে তার সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। পরে তিনি উহান থেকে দ্রুতগতির ট্রেনে যান নানচিং; সময় লাগে ৪ ঘণ্টা। আর নানচিং থেকে তাকে শাংহাই পৌঁছে দিতে চীনের দ্রুতগতির ট্রেন সময় নেয় এক ঘণ্টা ৪০ মিনিট।
শাংহাইয়ে চেসহিল ট্রেন থেকে নামেন হোংছিয়াও রেলস্টেশনে। নেমেই তিনি দেখলেন, বিশাল স্টেশনের ওয়েটিং রুম যাত্রীদের ভিড়ে গমগম করছে। একসময় হোংছিয়াও রেলস্টেশন ছিল এশিয়ার সবচেয়ে বড় রেলস্টেশন। অথচ চেসহিল স্টেশনের বিশাল ওয়েটিং রুমে বসার কোনো জায়গা পেলেন না। বেইজিং থেকে সি’আন, সি’আন থেকে উহান, উহান থেকে নানচিং, এবং নানচিং থেকে শাংহাই—দ্রুতগতির ট্রেনে তার এই লম্বা সফরের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি হোংছিয়াও রেলস্টেশনে যাত্রীদের প্রচণ্ড ভিড়ের কারণ উপলব্ধি করলেন।
বিজ্ঞাপন
চীনের দ্রুতগতির ট্রেন যাত্রীদের আরামদায়ক ও দ্রুত ভ্রমণের নিশ্চয়তা দেয়। চীনে অনেক সময় প্লেনের চেয়েও ট্রেনে ভ্রমণে সময় কম লাগে। খরচও তুলনামূলকভাবে কম। সবচেয়ে বড় কথা, প্লেন নানান কারণে বিলম্ব হতে পারে, কিন্তু চীনের দ্রুতগতির ট্রেন সাধারণত সময়মতো ছাড়ে ও সময়মতো গন্তব্যে পৌঁছায়। প্রতিকূল আবহাওয়ায় যেখানে প্লেন আকাশে উড়তে পারে না, সেখানে দ্রুতগতির ট্রেন অনায়াসে ছুটে চলে গন্তব্যের পানে।
টম চেসহিল চীনে এসেছিলেন ২০১৫ সালে। ঠিক ওই সালেই চীনের দ্বিতীয় বৃহত্তম দ্বীপ হাইনানে দ্রুতগতির রেলপথের একটি ‘রিং’ বা বৃত্তের নির্মাণকাজ শেষ হয়। পৃথিবীতে কোনো একটা দ্বীপে এতো বড় বৃত্তাকার দ্রুতগতির রেলপথ আর নেই।
২০১৫ সালেই চীনের ৩১টি প্রদেশ, স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল ও করপোরেশনের ২৮টি এবং যেসব শহরের লোকসংখ্যা ৫ লাখের বেশি, সেসব শহরের সবকটি দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থার আওতায় আসে। টম চেসহিল যখন চীন ভ্রমণে আসেন, তখন চীনে দ্রুতগতির রেলপথের মোট দৈর্ঘ্য ছিল ১৮ হাজার কিলোমিটার, যা ২০১৪ সালের চেয়ে ১২৭৪ কিলোমিটার বেশি।
বিশ্বের দ্রুতগতির রেলপথের প্রায় ৬৯ শতাংশই আছে চীনে। ২০১৪ সালে জাপান, স্পেন ও ফ্রান্স ২৬৬৪ কিলোমিটার, ২৫১৫ কিলোমিটার ও ২০৩৬ কিলোমিটার দ্রুতগতির রেলপথ নিয়ে ছিল যথাক্রমে দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ স্থানে। আর ২০১৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে দ্রুতগতির রেলপথের দৈর্ঘ্য ছিল মাত্র ৩৬২ কিলোমিটার!
টম চেসহিল যদি ২০২১ সালে চীন ভ্রমণে আসতেন, তবে দেখতেন চীনের দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা আরও বিস্তৃত হয়েছে, উন্নততর হয়েছে। এখন চীনের দ্রুতগতির রেলের দৈর্ঘ্য ৩৮ হাজার কিলোমিটার ছাড়িয়েছে। ২০৩৫ সালের মধ্যে চীন তার দ্রুতগতির রেলপথের দৈর্ঘ্য ৭০ হাজার কিলোমিটারে উন্নীত করতে চায়। এখন পর্যন্ত দ্রুতগতির রেলপথে বিনিয়োগের পুরোটাই করেছে চীনের সরকার।
বর্তমানে বেসরকারি বিনিয়োগও পাচ্ছে এই খাত। চীনে প্রথম সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বে (পিপিপি) দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ। দেশটির পূর্বাঞ্চলের প্রদেশ চ্যচিয়াংয়ের কয়েকটি শহরকে সংযুক্ত করতে যাচ্ছে এই রেলপথ। ২৬৬.৯ কিলোমিটার দীর্ঘ এই হাংচৌ-শাওসিং-থাইচৌ আন্তঃনগর দ্রুতগতির রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে প্রায় ৪৪৯০ কোটি ইউয়ান। এই পথে ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটার বেগে ট্রেন চলবে। এ লাইন ২০২১ সালের শেষ দিকে উদ্বোধন হবে এবং এটি যুক্ত হবে চীনের দ্রুতগতির রেল-নেটওয়ার্কের সঙ্গে।
চীনের দ্রুতগতির ট্রেনগুলোর গতিও আগের চেয়ে বেড়েছে এবং এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে তুলনামূলকভাবে সময়ও কম লাগছে। বেইজিং-শাংহাই রেলপথের কথা ধরা যাক। ২০১৫ সালে এই রুটে যে গতিতে ট্রেন চলাচল করত, ২০১৭ সালেই তা ২০ শতাংশ বেড়ে দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৩৫০ কিলোমিটারে! সে বছরের সেপ্টেম্বরে বেইজিং দক্ষিণ স্টেশন থেকে বর্ধিত গতির ট্রেনটি রওয়ানা দেয় শাংহাইয়ের উদ্দেশ্যে। দশ মিনিট পরেই ট্রেনের গতি দাঁড়ায় ঘণ্টায় ৩৫২ কিলোমিটার। বর্ধিত গতির কারণে এরপর থেকে বেইজিং থেকে শাংহাই যেতে যাত্রীদের এক ঘণ্টা সময় কম লাগছে।
বেইজিং-শাংহাই দ্রুতগতির রেলপথ হচ্ছে এ খাতে চীনের প্রতীক। ২০১১ সালে এই পথে দ্রুতগতির ট্রেন চলাচল শুরু হয়। এরপর থেকে গড়ে প্রতিবছর এই রেলপথে যাত্রী যাতায়াত করেছে দশ কোটি করে।
২০১৪ সালের ১ জুলাই সরকারি ঘোষণায় জানানো হয়, বেইজিং-শাংহাই রুট থেকে মুনাফা আসতে শুরু করেছে। পৃথিবীতে এর আগে এত অল্প সময়ে কোনো দ্রুতগতির রেল রুট থেকে মুনাফা অর্জিত হয়নি। ২০১৬ সালে বেইজিং-শাংহাই দ্রুতগতির রেল থেকে মুনাফা হয় ১০০ কোটি মার্কিন ডলার সমপরিমাণ অর্থ, যা ছিল তখনকার জন্য একটি বিশ্বরেকর্ড!
এবার আসি মূল কথায়। গত মাসে, মানে অক্টোবরে নেচার ক্লাইমেট চেঞ্জ (Nature Climate Change) নামক জার্নালে একটি গবেষণার ফল প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি করেছেন সিঙ্গাপুর, হংকং ও চীনের মূল ভূ-ভাগের গবেষকরা। গবেষণায় প্রাপ্ত ফল অনুসারে, চীনের দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা গ্রিনহাউজ গ্যাস (জিএইচজি) নিঃসরণ কমাতে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। কীভাবে? ধরা যাক, যদি চীনে দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা না থাকতো, তবে সড়কপথে যাত্রী ও মালামাল পরিবহন স্বাভাবিকভাবেই অনেক বেড়ে যেত। আর যাত্রী ও মালামাল বৃদ্ধি মানে, সড়কপথে যানবাহন বৃদ্ধি। এতে ১ কোটি ১২ লাখ মেট্রিক টন কার্বন ডাই অক্সাইড সমমানের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ বেশি হতো। অন্যভাবে বললে, চীনের দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা ১ কোটি ১২ লাখ মেট্রিক টন সমমানের গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়ে দিয়েছে, যা চীনের পরিবহন ব্যবস্থা থেকে উৎপন্ন মোট গ্রিনহাউজ গ্যাসের ১.৩৩ শতাংশ। এর মধ্যে বেইজিং-শাংহাই দ্রুতগতির রেলপথে চলাচলকারী ট্রেনগুলো বছরে গড়ে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমিয়েছে প্রায় ২৪ লাখ টন কার্বন ডাই অক্সাইডের সমমানের। বলা বাহুল্য, এই রুটটি চীনের সবচেয়ে ব্যস্ত ট্রেন রুট।
গবেষকদের আরও পর্যবেক্ষণ, বিদ্যুৎচালিত দ্রুতগতির ট্রেনের জনপ্রিয়তার কারণে, বিদ্যুৎচালিত সাধারণ গতির ট্রেনের যাত্রীসংখ্যা অনেক কমেছে। ফলে, সাধারণ গতির ট্রেনগুলো বেশি মালামাল বহন করতে পারছে। ২০১৯ সালে চীনের দ্রুতগতির রেলপথে গড়ে দৈনিক যাত্রী চলাচল করেছে ৬৫ লাখ, যে সংখ্যা ২০০৮ সালে ছিল মাত্র সাড়ে তিন লাখ। আর ২০২০ সালে চীনের রেলপথ পরিবহন করেছে ৩৫৮ কোটি টন মালামাল, যা ২০১৬ সালের চেয়ে ৯২ কোটি টন বেশি।
জাতিসংঘের উপাত্ত অনুসারে, বিশ্বে পরিবহন খাত সবচেয়ে বেশি বায়ুদূষণ ঘটায় এবং সবচেয়ে বেশি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী।
বিশ্বে প্রতিবছর ব্যবহৃত তেলের ৬৪ শতাংশও ব্যয় হয় পরিবহন খাতে। আর অন্যান্য জ্বালানির ২৭ শতাংশও ব্যয় হয় পরিবহন খাতে। যেহেতু চীনের সব দ্রুতগতির ট্রেন ও সাধারণ গতির ট্রেনের ৭৫ শতাংশই বিদ্যুৎচালিত, সেহেতু দেশে পরিবহন খাতে তেলের ব্যবহার অনেক কমেছে। ১৯৮৫ সালে যেখানে চীনের পরিবহন খাতে তেলের ব্যবহার ছিল ৫৮ লাখ ৩০ হাজার টন, সেখানে বর্তমানে তা কমে দাঁড়িয়েছে ২৩ লাখ ১০ হাজার টনে।
চীনের পরিবহন খাতে তেলের ব্যবহার ব্যাপকভাবে কমেছে, গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণও কমেছে। এক্ষেত্রে, যেমনটি আগেই উল্লেখ করেছি, দ্রুতগতির ট্রেন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে, এটাও সত্যি যে, দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য যে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, তার বেশিরভাগের উৎসই কয়লা। চীন এই কয়লার ব্যবহারই নাটকীয়ভাবে কমিয়ে আনতে চায়। যদি দ্রুতগতির ট্রেনের জন্য প্রয়োজনীয় বিদ্যুতের উৎস হয় পারমাণবিক শক্তি, বায়ু শক্তি বা সৌরশক্তি, তবে গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাতে এই খাত আরও বড় ভূমিকা রাখতে পারবে। আর এই কাজটা চীন করবে ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।
চীনের প্রেসিডেন্ট সি চিন পিং ইতিমধ্যেই ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের লক্ষ্যমাত্রা ঘোষণা করেছেন। এই লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের জন্য প্রয়োজনীয় কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করা হয়েছে। পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে, ২০৬০ সাল নাগাদ চীনে গড়ে উঠবে একটি সবুজ, নিম্নকার্বন, পরিষ্কার, নিরাপদ ও কার্যকর জ্বালানি ব্যবস্থা; জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে চীনের দক্ষতা পৌঁছাবে অগ্রসর আন্তর্জাতিক মানে; কয়লার মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার কমবে ৮০ শতাংশের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চীনের ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’-র লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে পরিবহন খাত। বলাবাহুল্য, চীনের পরিবহন খাতের মধ্যে দ্রুতগতির ট্রেন হচ্ছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরের বিজনেস স্কুলের সহযোগী অধ্যাপক ছিন ইয়ু বলেছেন, চীন যদি ফ্রান্স, কানাডা বা ডেনমার্কের মতো ‘সবুজ বিদ্যুতের কাঠামো’ গড়ে তুলতে পারে, তবে চীনের দ্রুতগতির রেল ব্যবস্থা গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণ কমাবে বর্তমানের চেয়ে দ্বিগুণের বেশি।
বস্তুত, চীনে ২০৬০ সালের মধ্যে ‘কার্বন নিরপেক্ষতা’ অর্জনের লক্ষ্য পূরণে কাজ শুরু হয়েছে। ২০৩০ সালের পর থেকে কার্বন নিঃসরণ কোনো অবস্থাতেই আর না বাড়ানোর ব্যাপারে চীন প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এসব প্রতিশ্রুতি পূরণে ও লক্ষ্য বাস্তবায়নে, যেমনটা আগেই বলেছি, চীনে সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। তেমনি একটি উদ্যোগের অংশ হিসেবে সিয়ং’আন ও বেইজিং ফ্যংথাই রেলস্টেশনে সৌরশক্তি উত্পাদন ব্যবস্থা গড়ে তোলা হয়েছে। এর ফলে ব্যয় যেমন কমেছে, তেমনি কার্বন ডাই অক্সাইড নিঃসরণও কমেছে। গোটা চীন জুড়েই এমন বহু উদ্যোগ বাস্তবায়নের কাজ চলছে। আশা করা যায়, চীন তার লক্ষ্যে পৌঁছাতে সক্ষম হবে।
[বিশেষ দ্রষ্টব্য : চীনের দ্রুতগতির রেলব্যবস্থার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ নিয়ে বিস্তারিত জানতে আগ্রহীরা অপেক্ষা করুন ‘নয়াচীনের সাফল্যের মুকুটে সাতটি পালক’ শীর্ষক গ্রন্থটির বাজারে আসার। এটি খুব শিগগিরই ঢাকা থেকে প্রকাশিত হতে যাচ্ছে।-লেখক]
আলিমুল হক ।। বার্তা সম্পাদক, চায়না মিডিয়া গ্রুপ (সিএমজি)