আই অ্যাম এ জিপিএ ফাইভ!

শিক্ষাখাতের বিখ্যাত এই ঠাট্টা এখন বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের গায়ে। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে আরও অনেক দল ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশ ক্রিকেট দল পুরো বিশ্বকাপ জুড়ে যে মানের ক্রিকেট খেলেছে, তাতে মনে হচ্ছে; ভুল শিক্ষা নিয়ে পাস করে ওপরের ক্লাসে উঠে আসা দল এটি!

দেশের মাটিতে অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ অভিনন্দনের বন্যায় ভেসে যায়। বিসিবি থেকে গলা ফাটিয়ে জানানো হয়, ‘এই জয় বিশ্বকাপে আমাদের দলের আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়াবে’। খোদ ক্রিকেটাররাও বিসিবির সঙ্গে সুর মেলান। 

তবে তারা ভুলে গেলেন, আত্মবিশ্বাস আর ‘মেকি আত্মবিশ্বাস’ দুটো ভিন্ন বিষয়। স্লো এবং লো বাউন্সের টার্নিং উইকেট বানিয়ে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে বাংলাদেশ হয়তো সিরিজ ঠিক জিতেছে। কিন্তু ‘প্রতারিত’ যে হয়েছে তারা নিজেই!

এমন উইকেটে খেলে বিশ্বকাপের প্রস্তুতি যে, কোনোমতেই হয় না, সেই তথ্য বিসিবি ও কারো অজানা নয়। কিন্তু বোর্ডে নির্বাচনের আগে ক’টা ভালো সিরিজ জেতা এবং টি-টোয়েন্টির র‌্যাংকিং বৃদ্ধির ‘সুখ খুঁজতে’ চেয়েছিল বিসিবি। 

অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের মতো দলের বিরুদ্ধে জেতা মানে বিসিবি দারুণ এবং দুর্দান্ত গতিতে চলছে—এমন কিছু প্রমাণ করা। আর বোর্ড নির্বাচনের আগে এমন আত্মতুষ্টির ভীষণ প্রয়োজনও ছিল বিসিবি কর্তাদের। 

বিশ্বকাপে পুরো বাংলাদেশ দলই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু খেলার ধরনে ন্যুব্জ মনোভাব এবং বাজে ফর্মের কারণে দুয়েকজন ক্রিকেটার অতিমাত্রায় সমালোচনার শিকার হয়েছেন...

এমন উইকেটে খেললে তা বিশ্বকাপের যে, কোনো কাজে আসবে না সেটা জানা কথা। কিন্তু সেই বাস্তবতা থেকে চোখ বুজে থাকা বিসিবি তখন অনেক দূরে। অস্ট্রেলিয়া এবং নিউজিল্যান্ড জানত, এটা বিশ্বকাপের প্রস্তুতির জন্য মোটেও আদর্শ কোনো উইকেট বা কন্ডিশন নয়; তাই তারা এই দুই সিরিজে মূল দলকেই পাঠায়নি। সেই সফরে আসা কিউইদের একজন ক্রিকেটারও বিশ্বকাপ দলের সদস্য ছিলেন না! অথচ বিশ্বকাপের আগে সেটাই ছিল তাদের শেষ আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি সিরিজ।

অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মতো টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারানোর সুখ পেল বাংলাদেশ ঠিকই কিন্তু বিশ্বকাপে এসে মুখ থুবড়ে পড়ল। আর বাংলাদেশের কাছে সিরিজ হারা অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড দুটি দলই বিশ্বকাপের ফাইনালে উঠে গেল।  

এই সমীকরণই জানাচ্ছে বিশ্বকাপের আগে ভুল অঙ্ক কষেছিল বাংলাদেশ। সঙ্গে নিয়ে যাওয়া ‘মেকি আত্মবিশ্বাস’ এবং স্কটল্যান্ডের কাছে হারের পর চারিধারের তুমুল সমালোচনায় বাংলাদেশ আরও নেতিয়ে পড়ল।

বাছাইপর্বে পরে অখ্যাত দুই দলের বিরুদ্ধে জিতে ‘টিম টাইগার’ ফের কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করলেও কুতর্ক জড়িয়ে ক্রিকেটাররা সেই সঞ্চয়ের বেশিরভাগ বিসর্জন দিয়ে এলেন স্বেচ্ছায়।

সামান্য যা কিছু বাকি ছিল তাও ধুয়ে-মুছে সাফ হয়ে গেল শ্রীলঙ্কার কাছে হেরে। টুর্নামেন্টের বাকি সময়টায় বাংলাদেশ আর মাঠে বা মাঠের বাইরে কোনো জায়গায় ক্রিকেট উপভোগ করতে পারেনি। ক্রিকেটারদের বউ, ভাই নেমে পড়েন ফেসবুকে তর্কের লড়াইয়ে জিততে।

বিশ্বকাপে প্রথম দুই ম্যাচে তো ভারতও হেরেছে। কিন্তু তাই বলে কি তাদের বোর্ডের কোনো শীর্ষকর্তা প্রকাশ্যে ক্রিকেটারদের ধুয়ে দিয়েছেন? অবশ্যই না।

পাকিস্তান ও নিউজিল্যান্ডের কাছে হারের পর মূলত ভারতের বিশ্বকাপ সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। কিন্তু তারপরও তাদের বোর্ড এবং সমর্থকরা ক্রিকেটারদের সমর্থন দিয়ে গেছে। এককভাবে কোনো খেলোয়াড়ের সমালোচনা না করে বরং সবাই সমালোচনা করেছে আইপিএলের।

কিন্তু বাংলাদেশ দলকে ঘিরে দেখলাম আমরা ভিন্ন চিত্র। খোদ বিসিবি সভাপতি যে ভাষায় এবং বাচনভঙ্গিতে নাম ধরে দলের ক্রিকেটারদের সমালোচনায় নামলেন, সেটা দলকে আরও ডোবাল। ম্যাচ হারলে সমালোচনা হবে, এটা সত্য। কিন্তু টুর্নামেন্ট চলাকালেই খোদ বোর্ডকর্তাই যখন অতিকথন আর সমালোচনায় মেতে উঠবেন তখন ক্রিকেটাররা কার কাছে আশ্রয় খুঁজবে?

বিসিবির এই ‘চোখ রাঙানি মার্কা’ উত্তেজিত মালিকানা মনোভাব দেখে মনে হলো, তাদের কাছে এই ক্রিকেটাররা নেহাত ভাড়াটে শ্রমিক।

ক্রিকেটারদের উজ্জীবিত করার পরিবর্তে ‘শাসনের চাবুক’ কষার বিসিবির সামন্তবাদী চিন্তাচেতনা ভুল বার্তা ছড়াল। বিসিবির এই ‘চোখ রাঙানি মার্কা’ উত্তেজিত মালিকানা মনোভাব দেখে মনে হলো, তাদের কাছে এই ক্রিকেটাররা নেহাত ভাড়াটে শ্রমিক। এমন পরিস্থিতিতে আকস্মিকভাবে অভিভাবকহীন হয়ে পড়া ক্রিকেটারদের মধ্যে এক ধরনের আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। 
ফলাফল?

হাতে আসা সহজ ক্যাচ মাটিতে পড়তে শুরু করল। ব্যাটিংয়ের বেসিক যেন ভুলে গেলেন ব্যাটসম্যানরা। দল অলআউট ৮৪ ও ৭৩ রানে। নামিবিয়ার চেয়েও বাজে পারফরম্যান্স বাংলাদেশের! 

বিশ্বকাপে পুরো বাংলাদেশ দলই ব্যর্থ হয়েছে। কিন্তু খেলার ধরনে ন্যুব্জ মনোভাব এবং বাজে ফর্মের কারণে দুয়েকজন ক্রিকেটার অতিমাত্রায় সমালোচনার শিকার হয়েছেন। সুযোগটা নিয়েছে সাম্প্রদায়িকতার অসুখে আক্রান্ত কিছু সমালোচক। তারা পুরো বিষয়কে ধর্মীয় ব্র্যাকেটে আটকে কুৎসিত একটা সুখ খোঁজার অপচেষ্টায় মেতে উঠে।

ভারতেও তাই হয়েছে। পাকিস্তানের হারের কারণ হিসেবে ধর্মীয় উন্মাদকরা ভারতীয় পেসার মোহাম্মদ শামিকে টার্গেট করে। স্বস্তির বিষয় হলো, এসব শকুনি আঁচড় যাতে ক্রিকেটারদের গায়ে না লাগে সেজন্য সেসব ক্রিকেট বোর্ড যথাযথ ব্যবস্থা নিচ্ছে।

টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এটাই কিন্তু বাংলাদেশের প্রথম ব্যর্থতা নয়। পেছনের ১৪ বছরে বাংলাদেশ এই ফরমেটের বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোনো ম্যাচ জিততে পারেনি। কেন পারেনি? কেন এই টানা ব্যর্থতা, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজাও ভীষণ প্রয়োজন।

বছর খানেকেরও কম সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ পরের বিশ্বকাপ খেলতে নামবে। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সেই বিশ্বকাপের পরিকল্পনা নেওয়ার সময় এখনই। যে দল নিয়ে পেছনের ১৪ বছরে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূলপর্বে কোনো সাফল্য পায়নি বাংলাদেশ, সামনের সময়েও যে পাবে—সেই আস্থা নেই। 

তাহলে উপায় কী? সিদ্ধান্ত কী? একটা বিষয় পরিষ্কার, এই দল এই ফরমেটের ক্রিকেট আর শিখবে না। পারবেও না। নতুন সাহসী তরুণদের দলে জায়গা দিতে হবে। যারা অন্তত হারার ভয়ে মাঠে নেমেই শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে থাকবে না। তরুণরাও হয়তো এখন হারবে। কিন্তু পরে তো জিততে পারে। 
ওটাই আলোর রেখা।

এম. এম. কায়সার ।। ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক, রাইজিংবিডি ডটকম ও ক্রিকেট বিশ্লেষক