যুবলীগ যে ধরনের রাজনীতি করে
‘কৃষি বিজ্ঞানীকে মারধর করলেন যুবলীগ নেতা, গবেষণা প্লট তছনছ’। আজ ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীর এই সময়টায় এমন খবর পত্রিকা ও অনলাইনে এসেছে এবং সামাজিক মাধ্যমে ঘুরপাক খাচ্ছে।
খবরের বিস্তারিত আর এখানে আনছি না, তবে এমন খবর হরহামেশা গণমাধ্যমে আসছে। ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর শেখ ফজলুল হক মনি কর্তৃক যখন বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। তখন বেশকিছু বড় আদর্শ ও লক্ষ্যের কথা বলা হয়েছিল।
বিজ্ঞাপন
ঘোষণাপত্রেই উল্লেখ ছিল—বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্র গণতন্ত্র, শোষণমুক্ত সমাজ অর্থাৎ সামাজিক ন্যায়বিচার, জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সব ধর্মের মানুষের নিজ নিজ ধর্ম স্বাধীনভাবে পালনের অধিকার তথা জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং যুব সমাজের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠাই যুবলীগের মূল লক্ষ্য।
কিন্তু ২০১৯ সালের ক্যাসিনোকাণ্ডসহ সারাদেশে যুবলীগের নামে সংগঠিত দুর্নীতি ও সহিংসতা, চাঁদাবাজি ও নৃশংসতার খবর প্রকাশের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন জেগেছে—যুবলীগ কোন রাজনীতি করে? সংগঠনের গঠনতন্ত্রে কী ধরনের রাজনীতির কথা বলা আছে সেটাও হয়তো অনেক যুবলীগ নেতাকর্মী বলতে পারবে না।
জাতীয় চার মূলনীতিকে সামনে রেখে বেকারত্ব দূরীকরণ, দারিদ্র্য দূরীকরণ, দারিদ্র্য বিমোচন, শিক্ষা সম্প্রসারণ, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপদান, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ ও আত্মনির্ভরশীল অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং যুব সমাজের অধিকারসমূহ প্রতিষ্ঠাই যুবলীগের মূল লক্ষ্য।
যুবকদের রাজনীতিমুখী করতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ মনি। তার মননে কিছুটা যে ভিন্নতা ছিল সেটা সংগঠনের কাঠামোতেই বোঝা যায়। এর কাঠামো আওয়ামী লীগের অন্যান্য সহযোগী সংগঠন থেকে আলাদা। এর প্রেসিডেন্ট নেই, আছে চেয়ারম্যান পদ। এর সম্মেলন হয় না, হয় কংগ্রেস।
ইতিবাচক, নেতিবাচক মিলিয়ে ছাত্রলীগের রাজনীতির একটা ধারণা জনমনে থাকলেও যুবলীগ সম্পর্কে সেই অর্থে কোনো স্বচ্ছ ধারণা রাজনীতি অঙ্গনে ছিল না। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর যে চিত্র উঠে এসেছে, তাতে যে যুবক আগামীর বাংলাদেশের জন্য বড় স্বপ্ন দেখে, সে এই সংগঠন করতে আগ্রহী হবে কি না সেটা সংগঠনের নেতৃত্ব ভেবে দেখতে পারেন।
যুবলীগ যুবকদের সংগঠন, অথচ এর সভাপতির বয়স ছিল ৭২ বা বাকি কেন্দ্রীয় নেতাদের একটি বড় অংশই ৭০ ছুঁই ছুঁই। ক্যাসিনোকাণ্ডের পর অবশ্য যুব বয়সীরাই এসেছে নেতৃত্বে।
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে শুদ্ধি অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে যুবলীগ থেকে বিতাড়িত হলেন সভাপতি ওমর ফারুক চৌধুরীসহ কয়েকজন। বলা হলো, এখন থেকে বয়স ৫৫ পেরোলেই কেউ আর যুবলীগ করতে পারবেন না। এমনকি নেতৃত্বেও আসতে পারবেন না কেউ। এর আগে যুবলীগে যোগদানের বয়সসীমা থাকলেও তা মানা হয়নি।
যুবলীগ কেমন রাজনীতি এতদিন করে এসেছে, সেটাও বোঝা গেল এই সিদ্ধান্ত থেকে। সংগঠনের নেতৃত্ব এত বছর ধরে নিজেদের একটা বয়সসীমা নির্ধারিত করতে পারেনি। সেটাও করে দিতে হয়েছে শেখ হাসিনাকেই।
আসলে তারা কোনো রাজনীতিই করেননি। সংগঠন করেছেন পদ-পদবি আর আধিপত্য স্থায়ী করার জন্য। দেখা যাক, এখনকার নেতৃত্ব দলের নেতা কর্মীদের ক্ষমতা চর্চা থেকে ফিরিয়ে এনে কতটা রাজনৈতিক চর্চা করাতে পারেন।
ছাত্রদের মধ্যে হানিকর দলীয় রাজনীতির পত্তন করা ও সেই উদ্দেশ্যে তাদের ব্যবহার করা যত সহজ, যুব সমাজের মাঝে সেটা করা ততটা নয়। যুবলীগ আসলে কখনো যুব সমাজের রাজনীতিটাই সংজ্ঞায়িত করতে পরেছে কি না সেটা একটা বড় প্রশ্ন। পারলে ক্যাসিনোকাণ্ড, চাঁদাবাজি, যেখানে সেখানে যাকে তাকে মারধর করার নেতা তৈরি হতো না।
সেই সংজ্ঞা নির্ধারণ করতে পারলে আর রাজনীতি ঠিকভাবে করলে, অপেক্ষাকৃত শিক্ষিত ও মেধাবী যুবসমাজ এই সংগঠনে আকৃষ্ট হতো, যাদের কেউ কেউ পরে দলের উচ্চতর নেতৃত্বে আসন পেতে পারত। ক্ষমতা আর আধিপত্যের যুব রাজনীতি করলে সৎ, নিষ্ঠাবান, পরিশ্রমী যুবকের কাছে সেই রাজনীতি পৌঁছাতে পারবে না।
সংগঠন ঠিক নেই, রাজনীতি নেই, আছে ব্যবসা, দখলবাজি, হানাহানি। এমন রাজনীতি যৌবনের স্বাভাবিক মানবিকতা ও সমাজবোধ ডুবিয়ে দেয় সহিংসতা আর বিদ্বেষের গহ্বরে।
যুবকদের রাজনীতিমুখী করতে চেয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক শেখ মনি। তার মননে কিছুটা যে ভিন্নতা ছিল সেটা সংগঠনের কাঠামোতেই বোঝা যায়।
এদেশে এত যুবক, জনসংখ্যার বড় অংশই তারা। কিন্তু তাদের একটা খুব ছোট অংশই রাজনীতিতে সক্রিয়। এর কারণ এই নয় যে, তারা রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত নয় বলে রাজনীতি সমর্থনও করে না বা তারা রাজনীতি সম্বন্ধে উদাসীন। এটুকুই বলা যায়, তারা দলাদলি হানাহানির বাইরে থাকতে চায়, সৎ থাকতে চায়।
যুবলীগ যুবকদের আকৃষ্ট করতে পারবে না প্রচলিত রাজনীতি বা সাংগঠনিক ধারায়। আমি মনে করি, এই প্রত্যাখ্যানের মধ্যেই লুকিয়ে আছে যুবলীগের ইতিবাচক সমাজ বোধের বীজ। দলীয় রাজনীতিতে অনভিজ্ঞ যুবসমাজ দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি বা জননিরাপত্তার মতো বিষয় নিয়ে পথে নামতে চায়।
আজকের আধুনিক যুবসমাজ রাজনীতিকে কেবল ক্ষমতা দখলের নিরিখে না দেখে সৎ ও নিরলসভাবে ক্রিটিক্যাল দৃষ্টিতে দেখতে চায়। যুবলীগকে সেই রাজনীতিটা বুঝতে হবে, করতে হবে।
কেমন হবে তবে সেই রাজনীতি? যুবলীগকে নিতে হবে প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক বোধের বিকাশমূলক কর্মসূচি। ক্যাসিনোকাণ্ড নিয়ে সমালোচনার ঝড় উঠছে। কিন্তু আমি এর মাঝেও ইতিবাচক কিছু দেখি। এই যে একটা আলোচনা সমালোচনা হলো, সেটাই ভরসার কথা।
অনাচার ও দুর্নীতির লীলাক্ষেত্র হওয়াই যে আমাদের রাজনীতির ভবিতব্য নয়, এ ধারণাটা অন্তত চিন্তার আওতায় এসেছে। শেষ অবধি কী হবে আমরা জানি না, কিন্তু রাজনীতির ধারায় অন্তত কিছু রূপান্তর ঘটবে হয়তো।
যারা যুবলীগের নতুন দায়িত্বে আছেন, তারা আগামী নেতৃত্ব নির্বাচনের সময় প্রত্যাশিত সেই রাজনীতি নিয়ে আসবেন বা প্রস্তাব করবেন এ দেশের যুব সমাজের জন্য, সেটাই প্রত্যাশা।
সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা ।। প্রধান সম্পাদক, জিটিভি