কপ-২৬ : জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে মতৈক্য প্রয়োজন
বিশ্বের নানা প্রান্তের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ—১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানসহ প্রায় ২০০ দেশের প্রতিনিধি, বিজ্ঞানী, নাগরিক গোষ্ঠীর প্রতিনিধি, সাংবাদিকরা মিলিত হয়েছে স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোর জলবায়ু সম্মেলনে (কপ–২৬)। সম্মেলন চলবে আগামী ১২ নভেম্বর পর্যন্ত। তবে সম্মেলনের বিষয়বস্তুগুলো নিয়ে বিভিন্ন দেশে আলোচনা অনেকদিন ধরেই চলছে।
সম্মেলন হওয়ার কথা ছিল ২০২০ সালে, যা বৈশ্বিক মহামারি করোনার কারণে সম্ভব হয়নি। পরিবেশে কার্বন নিঃসরণ কমাতে ২০৩০ সাল পর্যন্ত বিশ্বের ২০০টি দেশের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণেই স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে শুরু হয় এই জলবায়ু সম্মেলন (কপ–২৬)।
বিজ্ঞাপন
এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ ৪৮টি দেশ নিয়ে গঠিত জলবায়ু বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে। এই ৪৮টি দেশগুলো যারা বিশ্বের ১ শতাংশের মতো গ্রিনহাউজ গ্যাস নিঃসরণের জন্য দায়ী, অথচ নিঃসরণজনিত কারণে সৃষ্ট জলবায়ু সংকটের ক্ষতির শিকার সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাদের মুখপাত্র হিসেবে দীর্ঘদিন ধরে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।
COP-এর পূর্ণরূপ হলো Conference of the Parties। কপ-২৬ হচ্ছে United Nations Framework Convention on Climate Change (UNFCCC) বা জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলোর ২৬তম সম্মেলন।
UNFCCC-র কনভেনশনে স্বাক্ষর করা ১৯৭টি সদস্য দেশ বার্ষিক এই সম্মেলনে একসাথে যোগ দিয়ে বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় একে অপরের সাথে কীভাবে সমন্বিতভাবে কাজ করা যায় তা নিয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণের আলোচনা করে।
এই শীর্ষ সম্মেলনে বাংলাদেশও আন্তর্জাতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, বাংলাদেশ ৪৮টি দেশ নিয়ে গঠিত জলবায়ু বিষয়ক উচ্চ পর্যায়ের আন্তর্জাতিক ফোরাম সিভিএফ-এর সভাপতির দায়িত্ব পালন করছে।
এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা যেসব বিষয় নিয়ে সাধারণত আলোচনা করবে তা হচ্ছে—
•জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় সম্ভাব্য প্রশমন বা নিরসনের পন্থা (যেমন, গ্রিন হাউস গ্যাস নির্গমন হ্রাস যা মূলত বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য দায়ী)।
•জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পরিবেশের উপর যেসব অপরিবর্তনীয় প্রভাব সৃষ্টি হয়, তা কাটিয়ে উঠতে কী ধরনের অভিযোজন নীতি ও পদ্ধতি গ্রহণ করা যায়।
•উন্নয়নশীল দেশগুলো যাতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার থেকে বেরিয়ে আসতে পারে ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় যাতে তারা আরও সহনশীল ও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে সে লক্ষ্যে ধনী দেশগুলোর পক্ষ থেকে সম্ভাব্য আর্থিক সহায়তার বিষয়গুলো।
প্রথম জাতিসংঘ জলবায়ু সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় জার্মানির বার্লিন শহরে ১৯৯৫ সালে। ২০১৫ সালে অনুষ্ঠিত কপ-২১ সম্মেলনে অংশ নেওয়া দেশগুলো ঐতিহাসিক প্যারিস চুক্তি স্বাক্ষর করে। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক ও মাইলফলক চুক্তি। কেননা চুক্তিটির আন্তর্জাতিক আইনগত বাধ্যবাধকতা রয়েছে। যার মাধ্যমে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো সম্মত হয় যে, তারা তাদের দেশে গ্রিনহাউজ গ্যাসের উদ্গিরণ হ্রাস ও অভিযোজন পদক্ষেপ গ্রহণের ক্ষেত্রে নিজেদের প্রতিশ্রুতিগুলো অবহিত করবে। চুক্তিতে সম্মত দেশগুলো একমত হয় যে, সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে তারা চলতি শতকেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন বৃদ্ধির মাত্রা প্রাক-শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রির বেশি হতে দেবে না।
প্যারিস চুক্তির পর এবারের এই সম্মেলনটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক জলবায়ু সম্মেলন। এই সম্মেলনে প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে শক্তিশালী পদক্ষেপ গ্রহণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
কার্বন নির্গমন মাত্রার পরিমাপ ও সে বিষয়ে কীভাবে প্রতিবেদন তৈরি করা হবে তা নিয়ে সুস্পষ্ট নীতি নির্ধারণের পাশাপাশি আগামী দিনগুলোতে এই লক্ষ্যমাত্রা আরও কীভাবে বৃদ্ধি করা যায় সে বিষয়গুলো নিয়ে এই সম্মেলনে আলোচনা করবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
আগের সম্মেলনগুলোতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়ন কীভাবে হবে তার নিয়মকানুন নিয়ে একটি রুলবুক বা নীতির প্রথম খসড়া তৈরি করা হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, কোনো দেশই গুরুত্বপূর্ণ এই ইস্যুতে এখনো কোনো ঐক্যমতে পৌঁছাতে পারেনি। এবারের কপ-২৬ সম্মেলনে এই বিষয়গুলো নিয়ে আরও শক্তভাবে সিদ্ধান্ত হওয়ার উপরেই প্যারিস চুক্তির সার্থকতা আসবে বলে মনে করেন অনেকেই।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিবাসীর অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে।
এই সম্মেলনে সদস্য দেশগুলোর প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের নিজ নিজ জলবায়ু প্রতিশ্রুতি ও বাস্তবায়ন আরও কীভাবে বাড়াতে পারে সে বিষয়ে বিস্তারিত জানাবেন। দেশগুলোর নিজ নিজ Nationally Determined Contribution (NDC)-এ উল্লেখিত প্রতিশ্রুতিসহ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় তাদের চলমান পদক্ষেপ ও ভবিষ্যৎ যে প্রতিশ্রুতি রয়েছে সেগুলো আরও শক্তিশালী করার বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখবে।
যুক্তরাজ্য, চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ফ্রান্স ইতিমধ্যে নির্গমন মাত্রা কমিয়ে এনে কার্বন নিরপেক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে তাদের সময়সীমা ঘোষণা করেছে। এতে বোঝা যায়, এখন থেকে তারা শোষণ করার সক্ষমতা থেকে আরও কম গ্যাস নির্গমন করবে। আশা করা হচ্ছে, বিশ্বের শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলো এবারের সম্মেলনে জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে শুদ্ধ জ্বালানি ব্যবহারের ক্ষেত্রে নিজেদের পরিকল্পনা ঘোষণা করবে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ এশিয়া। আশঙ্কার বিষয় হলো দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ শহর ও বৃহৎ নগর কেন্দ্রগুলো গড়ে উঠেছে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতির আশঙ্কায় থাকা উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে। আর এ কারণে এসব এলাকায় অভিবাসীদের আগমনের হার বাড়তেই থাকবে। তাই সম্ভাব্য জলবায়ু অভিবাসীদের বিষয়টিকে মাথায় রেখে অবিলম্বে নীতিনির্ধারকদের কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার।
বিশ্বব্যাংকের এক সমীক্ষা প্রতিবেদন বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় জলবায়ু অভিবাসীর অর্ধেকই হবে বাংলাদেশ থেকে। জরুরি উদ্যোগ এবং কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বন্যা ও ফসলের উৎপাদন নষ্ট হয়ে ২০৫০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের প্রায় দুই কোটি মানুষ অভিবাসী হওয়ার ঝুঁকিতে যাবে।
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশে প্রতি সাতজনে একজন বাস্তুচ্যুত হবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। ২০৫০ সাল নাগাদ দেশে বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা হবে প্রায় এক কোটি ৩০ লাখ। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এই দুর্যোগকে আরও বাড়িয়ে দেবে। ২০৮০ সালের মধ্যে তলিয়ে যেতে পারে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের ১৩ শতাংশ ভূমি।
আগামী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই পৃথিবী রেখে যেতে কপ-২৬ সম্মেলনেই দ্রুত কার্বন নির্গমন কমাতে পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করাসহ সার্বিক বিষয়ে বিশ্বনেতাদের একমত হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন ও ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলায় জলবায়ু বিষয়ক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে বিশ্ব নেতাদের মতৈক্য অত্যন্ত প্রয়োজন।
চলতি বছরের ২২ এপ্রিল জলবায়ু বিষয়ক ‘লিডারস সামিটের’ উদ্বোধনী সেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলার ফান্ড নিশ্চিত ও পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির দিকে অধিক মনোযোগী হওয়াসহ চারটি পরামর্শ দিয়েছিলেন। এই সম্মেলনেও সেগুলো আবার আলোচনা হবে। এবারের জলবায়ু সম্মেলনে দক্ষিণ এশিয়ার নেতৃবৃন্দ তাদের নিজেদের জলবায়ু প্রতিশ্রুতি উপস্থাপন করার পাশাপাশি ধনী দেশগুলোকে জবাবদিহিতায় আনার জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে।
বিশ্বব্যাপী কার্বন নিঃসরণ কমানো এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে বিশ্ব নেতাদের একমত করাতে হবে।
ড. কবিরুল বাশার ।। অধ্যাপক, প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়