জেলহত্যা দিবস : ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়
ইতিহাসে কিছু কিছু দিন কালিমায় ঢেকে থাকে। ঝাপসা আর অস্পষ্ট সেইসব দিনগুলো পার করে তারপরও এগিয়ে যেতে হয়, আগামীর পথে। শেষটায় কী হলো জানতে গিয়ে মন ব্যথায় ভার হয়, তারপরও ইতিহাসের শুরুটাকে মনে রেখে শক্তি অর্জন করতে থাকে দেশ।
১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটভূমিতে জাতির পিতার পর সবচেয়ে শক্তিশালী রাজনৈতিক নেতাদের ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কারাগারে জাতীয় চার নেতা তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও এএইচএম কামারুজ্জামানকে পরিকল্পিতভাবে ঠাণ্ডা মাথায় খুন করা হয়।
বিজ্ঞাপন
জাতীয় চার নেতা ছিলেন দেশের নীতি নির্ধারক, রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী এবং আগামীর পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ধারাবাহিকতার আড়াই মাসের মাথায় তাদের হত্যা করা হয়।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর খুনি মোশতাক ও তার সহযোগীরা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে। ক্ষমতা দখলের পর মোশতাকের দল তাদের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থান হওয়ার আভাস পেয়েছিল।
তৎকালীন চারজন বয়োজ্যেষ্ঠ নেতাসহ অনেকেই তখন কারাগারে ছিলেন। অনেকে আবার আত্মগোপনে ছিলেন। অন্যান্যরা প্রকাশ্যে কিংবা অপ্রকাশ্যে নতুন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদের সাথে সমঝোতা করে নিজেদের গুছিয়ে নেন। সেই সময় বহু রাজনীতিবিদ রাজনীতি থেকে সরে দাঁড়ান।
জাতীয় চার নেতা ছিলেন দেশের নীতি নির্ধারক, রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবী এবং আগামীর পথপ্রদর্শক। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার ধারাবাহিকতার আড়াই মাসের মাথায় তাদের হত্যা করা হয়।
কিন্তু সেই সময়ে সেনাবাহিনীর মধ্যে এক ধরনের বিশৃঙ্খল এবং অস্পষ্ট পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল। উচ্চপদস্থ সেনা কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিল ক্ষমতা নিয়ে কাড়াকাড়ি। তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ছিল মতানৈক্য এবং ক্ষমতার দ্বন্দ্ব। একদিকে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং অন্যদিকে মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ।
ক্ষমতাসীন মোশতাক বা তার সমর্থকরা চায়নি তাদের বিরোধী আরেকটি শক্তি, শাসন ক্ষমতায় পুনর্বহাল হোক। তাদের বিরুদ্ধে শক্তিশালী সরকার কখনো যদি তৈরি হয়, তাহলে জেলে থাকা চার নেতাই ছিলেন সম্ভাব্য আগামীর নেতৃত্ব। নিজেদের রাজনৈতিক অবস্থান পাকাপোক্ত করার ভাবনা থেকেই তাই চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়।
মোশতাকের দল বিশ্বাস করতেন যদি এই চার নেতাকে হত্যা করা হয় তাহলে পাল্টা সামরিক অভ্যুত্থান হলেও বাংলাদেশে তাদের সমকক্ষ আর কোনো রাজনৈতিক নেতা জীবিত থাকবে না।
ক্ষমতায় থাকার নোংরা এবং কুৎসিত পরিকল্পনা থেকেই মোশতাকের দল পরবর্তীতে চার নেতাকে হত্যা করার নীল নকশা তৈরি করে। রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে এই হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার জন্য ৫ জনের একটি ঘাতক দল গঠন করে খুনিরা।
কারাগারে নিশ্ছিদ্র প্রহরায় থাকা চার নেতাকে আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে কারাগারের ভেতরে তাদের কক্ষে ঢুকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। খুনিরা শুধু ব্রাশফায়ার করে ক্ষান্ত হয়নি, তারা বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চার নেতার মৃত্যু নিশ্চিত হওয়ার পর বীরদর্পে কারাগার থেকে বের হয়ে যায়।
পৃথিবীর ইতিহাসে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় থাকা কারাগারের ভেতর এমন নির্মম হত্যাকাণ্ডের উদাহরণ বিরল। জেলখানায় প্রতিদিন ২৪ ঘণ্টা পরপর পরিবেশ এবং স্থিতিশীলতা নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করে জমা দিতে হয়। জেলহত্যার পর তৎকালীন জেলার মো. আমিনুর রহমান একটি প্রতিবেদন তৈরি করে আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামান হওলাদারকে দেন। পাশাপাশি ৪ নভেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ লালবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। তৎকালীন শাসকরা কোনো না কোনো ভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন।
মামলায় রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নাম উল্লেখ করে বলা হয়, তার নেতৃত্বে চার-পাঁচ সেনা সদস্য কারাগারে ঢুকে চার নেতাকে হত্যা করে। প্রথমে গুলি করে, পরে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করে ঘাতকরা।
মামলা দায়েরের পরদিন (৫ নভেম্বর) আইজি (প্রিজন) নুরুজ্জামান হাওলাদার জেলহত্যার প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র সচিবের কাছে জমা দেন। ৬ নভেম্বর বিচারপতি আহসানউদ্দিন চৌধুরী, বিচারপতি কে এম সোবহান ও বিচারপতি মোহম্মদ হোসেনের সমন্বয়ে ৩ সদস্য বিশিষ্ট একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৭৫ এর ৭ নভেম্বরের প্রেক্ষাপটে জেনারেল জিয়াউর রহমান দেশের সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলে তিনি এই তদন্ত কমিটির কার্যক্রম স্থগিত ঘোষণা করেন। অন্যদিকে জেলহত্যার তদন্ত প্রতিবেদনটি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে রহস্যজনকভাবে গায়েব করা হয়। এই হত্যাকাণ্ডের বিচার কার্যক্রম বন্ধই শুধু নয়, হত্যাকারীদের পুরস্কৃত করা হয়েছিল তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন দেশে চাকরি দিয়ে।
বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের কোনো বিচার হয়নি। তৎকালীন শাসকরা কোনো না কোনো ভাবে বিষয়টি এড়িয়ে গেছেন। তবে হত্যাকাণ্ডের ২৩ বছর পর আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এসে মামলাটি সচল করে এবং ১৯৯৮ সালের ১৫ অক্টোবর ২৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগ পত্র দেওয়া হয়।
২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত এ মামলার রায়ে তিনজন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।
২০১৩ সালের ১৫ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের দেওয়া তিন জনের মৃত্যুদণ্ড এবং ১২ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রাখে।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সগৌরবে বদলে যাওয়ার সময়ের শুরু অস্পষ্ট, ঝাপসা এবং শেষটা আমাদের জন্য কখনোই ভালো কিছু বয়ে আনেনি। তাই আমিও তাদের মনে রাখতে চাই শুরু হিসেবেই। শেষের সমাপ্তি ঝাপসা করে টানতে চাই না কখনোই। আগামীর পথ শক্তিশালী করি শোক বুকে নিয়ে।
শাওন মাহমুদ ।। শহীদ আলতাফ মাহমুদের কন্যা