ইন্দিরা গান্ধী : বাংলাদেশের অকৃত্রিম প্রিয়দর্শিনী
কাগজে-কলমে বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্ক এখন অনন্য উচ্চতায়। দুই পক্ষই নিজেদের স্বার্থ বুঝে নেওয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু বাংলাদেশ গত একযুগে ভারতকে যতটা নিশ্চিতি দিয়েছে, বিনিময়ে পায়নি ন্যায্য অনেক পাওনাও। বিএনপি-জামায়াত আমলের কথা মনে করলে ভারত তার নিশ্চিতির মূল্য বুঝবে। তখন বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করে ভারতে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাত, আওয়ামী লীগ আমলে সেটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে। কিন্তু তার বিনিময়ে খোলেনি তিস্তার পানির সময়োপযোগী প্রবাহ।
বন্ধু বদলানো যায়, প্রতিবেশী বদলানো যায় না। আর বাংলাদেশের অবস্থান ভারতের একদম পেটের মধ্যে। তাই বৃহত্তম প্রতিবেশীর সাথে ভালো সম্পর্ক রাখাটা বাংলাদেশের জন্য খুব দরকার। কিন্তু একতরফা কোনো বন্ধুত্বই টেকে না। স্বার্থটা যখন দুই পক্ষের, তখনই সম্পর্ক টেকসই হয়। তবে সম্পর্ক এগিয়ে নিতে বাংলাদেশের যতটা তাগিদ, ততটা ফেরত পাওয়া যায় না।
বিজ্ঞাপন
বাংলাদেশ-ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে অনন্য উচ্চতায় থাকলেও মাঠের বাস্তবতা ভিন্ন। তিন দশক আগেও ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ হলে বাংলাদেশ বিভক্ত হয়ে যেত। ভারতের পক্ষে গলা ফাটানো লোকের সংখ্যাই ছিল বেশি, পাকিস্তান ছিল এক নিষিদ্ধ নাম। বিশ্ব ক্রিকেটে বাংলাদেশের আবির্ভাবের আগে সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, শচীন টেন্ডুলকার, সৌরভ গাঙ্গুলীরাই ছিলেন বাংলাদেশের তারকা। কিন্তু হঠাৎ করেই পাল্টে গেছে দৃশ্যপট। বাংলাদেশে এখন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের সমর্থন শূন্যের ঘরে। বিরাট কোহলির মতো অসাধারণ পারফরমারের ফ্যান বেজ তো নেইই, বরং তার হেটার্স গ্রুপ বিশাল। চোখের সামনে এমন আকাশ-পাতাল ব্যবধান রীতিমতো অবিশ্বাস্য।
একাত্তর সালে ভারত আমাদের পাশে ছিল, ভারতের সহায়তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি আমাদের বিজয় আসত না; এটা সত্যি, এর জন্য আমাদের চির কৃতজ্ঞতা।
গত দুই দশকে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতার বিস্তার, পাকিস্তানপন্থীদের উত্থান, কৌশলে পাকিস্তানের মতো ভারতকেও শত্রুর তালিকায় তুলে আনার কারণে হয়তো এত দ্রুত পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। তবে দায় নিতে হবে ভারতকেও। তাদের ক্রমাগত দাদাগিরি পরিস্থিতিকে ত্বরান্বিত করেছে। আয়তনে যাই হোক, বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র; এটা ভারতের অনেকে ভুলে যান। আমরা যতই তাদের এলডার ব্রাদার হিসেবে সম্মান করতে চাই, তারা ততই বিগ ব্রাদার হিসেবে থাকতে চায়।
এবার শারদীয় দুর্গোৎসবে কুমিল্লায় কোরআন অবমাননার ঘটনায় দেশের বিভিন্নস্থানে সাম্প্রদায়িক তাণ্ডব ঘটেছে। কিন্তু বাংলাদেশের বিবেকবান মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়েছে। এ ঘটনায় ভারতেও প্রতিবাদ হয়েছে। অনেকে বলছেন, এটা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়, ভারতের নাক গলানোর কিছু নেই। বছর দুই আগে ভারত যখন নানা কৌশলে বাঙালি মুসলমানদের বাংলাদেশে পাঠানোর চেষ্টা করছিল, তখন বাংলাদেশের উদ্বেগ দেখে ভারত বলেছিল, এটা ভারতের অভ্যন্তরীণ বিষয়, বাংলাদেশের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু আমি এই ‘অভ্যন্তরীণ বিষয়’ তত্ত্বে বিশ্বাসী নই। পৃথিবীর যেখানেই নির্যাতন হবে, অন্যায় হবে; পৃথিবীর সব মানুষের তার প্রতিবাদ করা উচিত।
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদও ভারত শুধু নয় সব দেশেই হতে পারে। তবে এবারের ঘটনা দিয়ে বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র হিসেবে চিত্রিত করার সুযোগ নেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়াই আমাদের লক্ষ্য। পথ যত বন্ধুরই হোক, সেই লক্ষ্যেই যাবে বাংলাদেশ। আর এই দেশটা হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান সবার; সব মানুষের।
ইন্দিরা গান্ধী সীমান্ত খুলে দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন।
বিশ্বের সব মানুষের মতো ভারতেরও বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার প্রতিবাদ করার অধিকার আছে। কিন্তু ভারতের অতি প্রতিক্রিয়াও ছিল অনাকাঙ্ক্ষিত। ভারতের এক নেতা শুরুই করলেন, ‘যে বাংলাদেশকে আমরা স্বাধীনতা এনে দিয়েছিলাম’ বলে। মূল সমস্যাটা এখানেই। ভারতের অনেকে মনে করেন, তারাই বাংলাদেশকে স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। একাত্তর সালে ভারত আমাদের পাশে ছিল, ভারতের সহায়তা ছাড়া এত তাড়াতাড়ি আমাদের বিজয় আসত না; এটা সত্যি, এর জন্য আমাদের চির কৃতজ্ঞতা। কিন্তু ‘ভারত স্বাধীনতা এনে দিয়েছে’ এটা বললে আমাদের ২৩ বছরের মুক্তিসংগ্রাম, ৯ মাসের মুক্তিযুদ্ধ, ৩০ লাখ শহীদ আর মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বকে খাটো করা হয়।
যিনি এই দাবিটি করলেন, তাতে অল্প হলেও সত্যের মিশেল থাকতে পারত; তিনি কখনো এমন দাবি করেননি, তিনিই বাংলাদেশের সত্যিকারের বন্ধু। তিনি প্রিয়দর্শিনী ইন্দিরা গান্ধী। আজ আসলে এই প্রিয় বন্ধুর কথাই বলতে এসেছি। আর ভাবছি, ভারত-বাংলাদেশের সম্পর্কের ভেতরকার বিদ্বেষ, তিক্ততা দেখলে তিনি কী করতেন?
আমি জীবনে প্রথম ভারত গেছি ২০১৭ সালে, ৪৮ বছর বয়সে। ভারতে পা রাখার প্রথম দিনেই গিয়েছিলাম ১ সফদরজং রোডে ইন্দিরা গান্ধী স্মৃতি জাদুঘরে। কিন্তু সময় পেরিয়ে গিয়েছিল বলে সেবার দেখা হয়নি। পরে তৃতীয় সফরে যেতে পেরেছিলাম সেখানে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। এখন পর্যন্ত ভারতের একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী। দুই দফায় ১৫ বছর ভারত শাসন করেছেন ইন্দিরা, তার পিতা ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহারলাল নেহেরুর পর যা দীর্ঘতম। জরুরি অবস্থা জারিসহ নানা কারণে বিতর্ক থাকলে ইন্দিরা গান্ধী দেশ চালিয়েছেন কঠোর হাতে। কিন্তু ভারতকে তিনি রেখেছিলেন ভারতের মতোই, যে অসাম্প্রদায়িক চেতনায় দেশটি স্বাধীন হয়েছিল ১৯৪৭ সালে, যার ভিত গড়ে দিয়েছিলেন তার পিতা। আজকের ভারতের সাম্প্রদায়িক চরিত্র দেখলেও নিশ্চয়ই ইন্দিরার মন খারাপ হয়ে যেত।
তবে আমি কিন্তু ভারতের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী বা দাপুটে প্রধানমন্ত্রীর স্মৃতি দেখতে সফদরজং রোডে যাইনি। গিয়েছিলাম বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধুর স্মৃতি দেখতে। বঙ্গবন্ধু কৌশলে বাংলাদেশকে স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিলেন, আর ইন্দিরা তার যৌক্তিক পরিণতি দিতে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন অকৃপণভাবে।
অনেকে বলেন, ৭ মার্চ কেন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন না। সেদিন বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে, বাংলাদেশ অত তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পেত না। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চিহ্নিত হতো বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন হিসেবে। শুধু গায়ের জোরে যুদ্ধ জেতা যায় না, কৌশল লাগে। ইন্দিরা গান্ধীও বাংলাদেশের পক্ষে কৌশলী ছিলেন।
অনেকে বলেন, ভারত মার্চ বা এপ্রিলেই বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করল না কেন? প্রথম কথা হলো, তেমনটি হলে সেটি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ হতো, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নয়। ইন্দিরা গান্ধী সীমান্ত খুলে দিয়েছেন, মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থ-অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছেন, খাবার দিয়েছেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন ছিল ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জন্মদিনের উপহার চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার। ইন্দিরা গান্ধী কথা দিয়েছিলেন এবং রেখেছিলেন।
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার পরিচালিত হয়েছে ভারতের মাটি থেকে। তবে ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় যে কাজটি করেছেন, তাহলো আন্তর্জাতিক মহলের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের যৌক্তিকতা তুলে ধরা, পাকিস্তানের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরা আর শরণার্থীদের দুর্দশার ছবি তুলে ধরা। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে যে সমর্থন ও সহানুভূতি আদায় করেছিলেন ইন্দিরা, তার অবদানও কম নয়। তখন জাতিসংঘে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র আর চীনের একাধিক ষড়যন্ত্র ইন্দিরা গান্ধী রুখে দিয়েছিলেন রাশিয়ার সহায়তায়।
অনেকে বলেন, পাকিস্তানকে ভাঙ্গতেই ভারত বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়েছিল। হতে পারে, ভারত তার স্বার্থটাই দেখবে। তবে তাতে বাংলাদেশের মর্যাদা কিছু কমেনি। তবে ইন্দিরা গান্ধী যে সত্যি বাংলাদেশের বন্ধু, পরেও তার প্রমাণ রেখেছেন।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি দেশে ফেরার পর বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিন ছিল ১৭ মার্চ। বঙ্গবন্ধু ইন্দিরা গান্ধীর কাছে জন্মদিনের উপহার চেয়েছিলেন, বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার। ইন্দিরা গান্ধী কথা দিয়েছিলেন এবং রেখেছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর প্রথম জন্মদিনের আগেই ভারতের সব সৈন্য চলে গিয়েছিল, যা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর তার বেঁচে যাওয়া দুই কন্যাকে নয়াদিল্লিতে আশ্রয় দিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
সব মিলিয়ে বাংলাদেশের প্রতি ইন্দিরা গান্ধীর ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। শুরুতে যে জাদুঘরের কথা বলছিলাম, সেখানে গেলে যে কেউ ভারতের দাপুটে প্রধানমন্ত্রীর অতি সাধারণ জীবন-যাপন দেখতে পাবেন; একজন মা, একজন দিদা, একজন শাশুড়ির দেখা পাবেন।
দেখা পাবেন একজন পড়ুয়া ইন্দিরার ছবি। তবে আমার স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে একটি ফোন। নীচতলার স্টাডি রুমে বসে ইন্দিরা টুকটাক কাজ করতেন, পড়াশোনা করতেন। সেই টেবিলে রাখা টেলিফোনেই তিনি প্রথম খবর পান, বাংলাদেশ বিজয় অর্জন করেছে এবং প্রতাপশালী পাকিস্তানি সেনারা খোলা আকাশের নিচে আত্মসমর্পণ করেছে। ইন্দিরা গান্ধী আন্তরিকতা দিয়ে, ভালোবাসা দিয়ে, মর্যাদা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষের হৃদয় জয় করেছিলেন।
আজ ৩১ অক্টোবর বাংলাদেশের সেই অকৃত্রিম বন্ধুর মৃত্যুর দিন। ৩৭ বছর আগের সেই মৃত্যুও মানবতার জয়গান গেয়েছে। স্বর্ণ মন্দিরে সেনা অভিযানের নির্দেশের পর শিখরা তার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল, আশঙ্কা ছিল হামলারও। তার নিরাপত্তা বাহিনী থেকে শিখ সদস্যদের সরিয়ে নেওয়ার প্রস্তাবও এসেছিল তার টেবিলে। ‘আমরা কি ধর্মনিরপেক্ষ নই’ এ কথা বলে সে প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। তার মানে ধর্মনিরপেক্ষ ভারত তিনি শুধু মুখে বলতেন না, অন্তরে বিশ্বাস করতেন। মানুষের ওপর রাখা সেই বিশ্বাসের মূল্য তিনি দিয়েছেন জীবনের বিনিময়ে।
মৃত্যুর আগের দিন মানে ৩০ অক্টোবর ১৯৮৪, উড়িষ্যার এক জনসভায় জীবনের শেষ লিখিত ভাষণের বাইরে গিয়ে ইন্দিরা বলেছিলেন, ‘আজ আমি এখানে রয়েছি, কাল নাও থাকতে পারি।... যেদিন মরে যাব, রক্তের প্রতিটি ফোঁটা ভারতকে আরও মজবুত করার কাজে লাগবে।’ সেটা হয়তো লাগেনি, তবে ৩১ অক্টোবর সকালে ১ সফদরজং রোড থেকে হেঁটে পাশে ১ আকবর রোডের অফিসে যাওয়ার পথে দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিলেন ইন্দিরা গান্ধী।
দীর্ঘদিনের স্মৃতি বিজড়িত সেই বাড়ির লনের ঘাস সেদিন লাল হয়ে গিয়েছিল তার রক্তে, যার চিহ্ন এখনো আছে জাদুঘরে বদলে যাওয়া সেই বাড়িতে। বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু প্রিয়দর্শিনীর জন্য ভালোবাসা।
প্রভাষ আমিন ।। বার্তা প্রধান, এটিএন নিউজ