গবেষণায় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পিছিয়ে কেন?
শিক্ষার মান ও শিক্ষকদের মানোন্নয়ন নিয়ে জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন আমার দৃষ্টি কেড়েছে। শিক্ষকদের মান ও কীভাবে সেটির মানোন্নয়ন করা যায় সে বিষয়ে আলোকপাত করতে গিয়ে জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মের্কেল (Angela Merkel)-এর একটি বক্তব্য প্রতিবেদনে তুলে ধরা হয়েছে। দেশটির বিচারক, চিকিৎসক ও প্রকৌশলীদের সে দেশের সর্বাধিক বেতনভোগী শিক্ষকদের সমপরিমাণ বেতনের প্রত্যাশার দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ম্যার্কেল বলেছিলেন, ‘যারা আপনাদের শিক্ষাদান করেছেন, তাদের সঙ্গে কীভাবে আপনাদের তুলনা করি?’ শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞান-সৃষ্টিতে তথা গবেষণায় অনেক উন্নত দেশের তুলনায় জার্মানি কিন্তু অনেক এগিয়ে। দেশটির অন্তত পাঁচটি বিশ্ববিদ্যালয় ২০২০ সালের কিউএস ওয়ার্ল্ড র্যাঙ্কিংয়ে বিশ্বের সেরা ১০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে আছে।
জার্মানির পর এবার আসি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রসঙ্গে। সেখানকার একজন অধ্যাপককে চাকরিতে টিকে থাকতে হলে প্রতি বছর বেশ কিছু গবেষণা প্রস্তাব লিখতে হয়। সরকারি ও বিভিন্ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানে সেগুলো জমা দিতে হয় অর্থ প্রাপ্তির জন্য। অর্থ প্রাপ্তি সাপেক্ষে গবেষণা কার্যক্রম শুরু হয় এবং গবেষণায় প্রাপ্ত উপাত্ত তথা ফলাফল জাতীয় নীতিনির্ধারণে কাজে লাগে।
বিজ্ঞাপন
২০১৭ সালের হিসাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশনের গবেষণার বার্ষিক বাজেট ছিল ৭.৪ মিলিয়ন ডলার। উন্নত বিশ্বে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো দ্বারা পরিচালিত গবেষণা সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে সহায়তা করে এবং সে অনুসারে নীতিও নির্ধারণ করা হয়। সরকারও সেসব তথ্য-উপাত্ত তথা গবেষণালব্ধ ফলাফল সানন্দে গ্রহণ করে। উন্নয়ন প্রকল্পের বিশেষজ্ঞ হিসেবেও যোগ্যতাসম্পন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ কাজ করে থাকেন।
এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বাস্তবতা একেবারেই ভিন্ন। শিক্ষক নিয়োগ থেকে পদোন্নতি পর্যন্ত প্রায় সকল ক্ষেত্রে গবেষণা উপেক্ষিত। কিছু পদে পদোন্নতির জন্য জার্নালে প্রকাশিত প্রবন্ধের দরকার হয়। আর যেখানে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, হংকংয়ের মতো দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাকরিতে টিকে থাকার জন্য গবেষণার বিকল্প থাকে না। সেসব দেশে শিক্ষাদানের পাশাপাশি গবেষণা প্রকল্প নিয়ে আসার যোগ্যতাকেও শিক্ষকতায় টিকে থাকার যোগ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে অনার্স, মাস্টার্স শেষে কোনো গবেষণা ছাড়াই প্রভাষক হিসেবে নিয়োগের বহু উদাহরণ পাওয়া যাবে।
প্রতি বছরই অনুষদভুক্ত বিভিন্ন বিভাগের অনেক শিক্ষকই গবেষণার জন্য গবেষণা প্রস্তাব জমা দেন। কিন্তু গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অধিকাংশ শিক্ষককেই দেওয়া সম্ভব হয় না।
বিশ্বাস করতে চাই, বাংলাদেশের অধিকাংশ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা নিজেদের যোগ্যতা অনুযায়ী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। কিন্তু বেতন কম থাকায় শুরু থেকেই ছুটতে হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে খণ্ডকালীন চাকরি কিংবা কনসালটেন্সিতে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের দিকে তাকালে দেখা যায়, সে দেশের আইআইটি’র একজন পূর্ণকালীন অধ্যাপকের মাসিক মূল বেতন বাড়ি ভাড়া বাদেই বাংলাদেশি টাকায় ৩ লক্ষ ৭০ হাজার টাকার কাছাকাছি। সেখানে বাংলাদেশে ২০১৫ সালের অষ্টম পে-স্কেল অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয়ের সিকেলশন গ্রেডের একজন অধ্যাপক (মোট অধ্যাপকের ২৫ শতাংশ) মূল বেতন পান ৭৮ হাজার টাকা যা ভারতের আইআইটি’র একজন অধ্যাপকের প্রাপ্ত মূল বেতনের মাত্র ২১ শতাংশের সমান। এ কারণে টাকা আয়ের পথ খুঁজতে গিয়ে অনেক শিক্ষকই যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও গবেষণায় ঠিকমতো সময় দিতে পারছেন না।
একদিকে কম বেতন, আবার অন্যদিকে গবেষণার জন্য অপ্রতুল বরাদ্দও শিক্ষকদের গবেষণা বিমুখ করে তুলছে। বাংলাদেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বাজেটের তুলনায় শিক্ষাখাতের বরাদ্দের পরিসংখ্যান দেখলেই বিষয়টি পরিষ্কার হয়ে ওঠে। চলতি অর্থবছরে ৪৯টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার জন্য ১০ হাজার ৩২ কোটি ৮১ লক্ষ টাকা বাজেট ধরা হলেও গবেষণা খাতে দেওয়া হয়েছে ১০০ কোটি ৭৪ লক্ষ টাকা যা বরাদ্দকৃত বাজেটের ১ শতাংশেরও কম।
গত বছরের তুলনায় এ বছরে গবেষণায় বরাদ্দের পরিমাণ ৩৪ কোটি টাকা বেশি হলেও প্রয়োজনের তুলনায় তা একেবারেই কম। যেমন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০২১-২০২২ অর্থবছরে গবেষণা খাতে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ১১ কোটি টাকা, যা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট বরাদ্দকৃত বাজেটের মাত্র ১ দশমিক ৩২ শতাংশ।
২০১৫ সালে মুম্বাই আইআইটির গবেষণাখাতে বাজেট বরাদ্দ ছিল বাংলাদেশি টাকায় ৩২০ কোটি টাকা। এমনকি ইসরাইলের মতো দেশে প্রতি বছর গবেষণা খাতে জিডিপির ৪.১ শতাংশ বরাদ্দ থাকে যেখানে বাংলাদেশের বাজেটে গবেষণা খাতে উল্লেখ করার মতো তেমন কোনো বাজেট বরাদ্দ থাকে না।
আমি আমার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের গবেষণার বরাদ্দের দিকে তাকালে দেখতে পাই, প্রতি বছরই অনুষদভুক্ত বিভিন্ন বিভাগের অনেক শিক্ষকই গবেষণার জন্য গবেষণা প্রস্তাব জমা দেন। কিন্তু গবেষণার জন্য বরাদ্দকৃত অর্থ অধিকাংশ শিক্ষককেই দেওয়া সম্ভব হয় না। আবার একটি গবেষণা করার জন্য একজন শিক্ষক পান ২ লক্ষ টাকা। একটি এমপেরিক্যাল স্টাডি/রিসার্চ করার জন্য এই বরাদ্দকে যথেষ্ট বলার কোনো কারণ অন্তত আমি দেখতে পাই না।
গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে গবেষণা পরিচালনা করা এবং গবেষণায় সহায়তাকারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া সবই এই বরাদ্দের মধ্যে থাকে। এ কারণে বড় ধরনের নমুনা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না। এছাড়াও গবেষণা শেষে যে পরিমাণ ভাউচার জমা দিতে হয়, তা একজন পেশাদার হিসাবরক্ষকের কাজকেও ছাড়িয়ে যায়। এতে করে অনেক শিক্ষকই গবেষণা প্রস্তাব জমা দিতে অনীহা প্রকাশ করেন।
অস্বীকার করার উপায় নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অতি রাজনীতি সচেতনতা, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের প্রতি দায়বদ্ধতার ঘাটতি, গবেষণায় গুরুত্ব কম দেওয়া এবং একজন শিক্ষক কী পরিমাণ গবেষণা প্রকল্প পরিচালনা করছেন বা কী পরিমাণ গবেষণা প্রবন্ধ প্রকাশ করছেন, তার জন্য তেমন কোনো প্রণোদনা না থাকাও গবেষণার অপ্রতুলতার কারণ। তবে, গবেষণা করার ব্যাপারে অনেক শিক্ষকের উদ্যোগের অভাবকেও অস্বীকার করা যায় না।
গবেষণার জন্য তথ্য সংগ্রহ থেকে শুরু করে গবেষণা পরিচালনা করা এবং গবেষণায় সহায়তাকারীদের বেতন-ভাতা দেওয়া সবই এই বরাদ্দের মধ্যে থাকে। এ কারণে বড় ধরনের নমুনা নিয়ে গবেষণা করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
একজন শিক্ষক হিসেবে এটি অস্বীকার করার তেমন সুযোগ আমার নেই। তবে, শিক্ষক নিয়োগ ব্যবস্থা থেকে শুরু করে শিক্ষকদের পদোন্নতি পাওয়াসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি দায়বদ্ধতা বৃদ্ধি করা এবং গবেষণায় বরাদ্দ বৃদ্ধি করা না গেলে এ অবস্থা থেকে উত্তরণের কোনো সুযোগ আছে বলে মনে হয় না। এছাড়াও একজন শিক্ষকের মানোন্নয়ন তথা তাকে জ্ঞানসমৃদ্ধ, কুশলী ও দক্ষ রূপে গড়ে তোলার জন্য শিক্ষকতা জীবনের শুরু থেকেই প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ও গবেষণাকর্মের সুযোগ দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এক্ষেত্রে দক্ষ শিক্ষক নিয়োগেরও বিকল্প নেই।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে একজন সম্পাদকের প্রশ্নের জবাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের গবেষণার প্রতি উদাসীনতার বিষয়টি নিয়ে আক্ষেপ করেছেন। প্রধানমন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার গুরুত্ব তুলে ধরে কেন শিক্ষকেরা গবেষণায় উৎসাহী হচ্ছেন না তা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন।
এটা তো ঠিক যে, বাংলাদেশ এখন অনেক দিক থেকেই উন্নয়নের রোল মডেল। আন্তর্জাতিক পরিসরে যার স্বীকৃতিও মিলেছে। কিন্তু আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে। টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনকে ত্বরান্বিত করতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণার বিকল্প নেই। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান গবেষণা বাড়ানোর বিষয়ে বারবার তাগিদ দিচ্ছেন। শিক্ষকদের গবেষণা বিমুখ হওয়ার কারণ তারা খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিচ্ছেন এবং সেগুলো থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টাও করে যাচ্ছেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নের গতিধারাকে যদি এগিয়ে নিতে হয়, ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে যদি উন্নত দেশের কাতারে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখতে হয় কিংবা বাংলাদেশকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় পরিণত করতে হয়, সেক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা বাড়ানোর দিকে নজর দেওয়ার কোনো বিকল্প নেই।
ড. প্রদীপ কুমার পাণ্ডে ।। অধ্যাপক, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়