ক্লাস ফাইভ থেকে আমার পূর্ণাঙ্গ স্কুল জীবনের শুরু। আমার স্কুল খুলনার সেন্ট জোসেফ। আমাদের হেডমাস্টার ছিলেন খ্রিষ্টান। ক্লাস জুড়ে ছিল হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান আর মুসলিম বন্ধুরা। এদের বিরাট একটা অংশ এখনো এই ৫৪ বছর বয়সে আমার বন্ধু তালিকা জুড়ে আছে। এখনো এদের কাছ থেকে কোনোকিছুর জন্য একটা ফোন যথেষ্ট, কোনো প্রশ্ন না করে সাধ্যের ভেতরে থাকলে তা নির্দ্বিধায় করে দেওয়া আমি আমার দায়িত্ব মনে করি। আবার এরাও ঠিক তাই, আমার কাছ থেকে একটা অনুরোধই যথেষ্ট।

বড়দিনে খ্রিষ্টান বন্ধুদের বাসায় আড্ডা আর কেক অপরিহার্য ছিল, যেমন ছিল পূজায় হিন্দু বন্ধুদের বাসার লুচি-লাবড়া আর পূজার আনন্দে শামিল হওয়া।

আমাদের বাসায়ও তেমন ঈদের দিন সবার জন্য খোলা, একপাল বন্ধু নিয়ে দেদার খাওয়াদাওয়া চলতো। আমি চার্চে যেতে ভালোবাসতাম, কারণ মানুষ বিশালতার কাছে গেলে বিহ্বল হয়, যেমন সমুদ্রের বিশালতা আমাদের আবেগাপ্লুত করে। পরে বুঝেছি চার্চের উচ্চতা এই বিহ্বলতার কারণ। আমি জানি যেসব দিনের কথা আমি বলছি, তখনকার সবার মানসিক চিন্তাধারা আমার সাথে মিলে যাবে।

এই এত বছর পাড়ি দিয়ে এসে এখন পর্যন্ত একবারও ভাবিনি কে হিন্দু, কে বৌদ্ধ আর কেই বা খ্রিষ্টান। এখনো আমার প্রিয় বন্ধুর তালিকায় সব ধর্মের মানুষ সমানভাবে বিরাজ করছে।

বড়দিনে খ্রিষ্টান বন্ধুদের বাসায় আড্ডা আর কেক অপরিহার্য ছিল, যেমন ছিল পূজায় হিন্দু বন্ধুদের বাসার লুচি-লাবড়া আর পূজার আনন্দে শামিল হওয়া।

গান গাওয়া শুরু করার পর হিন্দু বাড়ির অনুষ্ঠান আবার চার্চে বাজানো কোনটাই বাদ যায়নি। বিভাজনে আমি বিশ্বাস করি না। করি না বলেই গত ১০/১৫ বছরে অভাবনীয়ভাবে এই দেশটা যেভাবে পাল্টে গেছে তা আমি মেনে নিতে পারি না।

ভার্চুয়াল জগতে তীব্র গালাগাল আর অপমান করা বোধকরি ট্রেন্ড এখন। যার জন্য অভিনেতা চঞ্চল চৌধুরীর মায়ের সিঁথিতে সিঁদুর দেওয়া ছবি পোষ্ট করলে গালাগালের ঝড় বয়ে যায়।

আমি যেকোনো অন্যায়ের প্রতিবাদ করার চেষ্টা করেছি সবসময়, আমার মতো করে। তাতে হয়তো আমার ভাগেও কোথাও না কোথাও প্রচুর অপমান আর গালাগাল ভাগ হয়েছে, হোক। আমার নীতি থেকে আমি সরে আসবো না কখনো।

এই ৫৪ বছরে আমাকে কেউ কখনো অন্য ধর্মে রূপান্তরিত করবার চেষ্টা করেনি। এই দেশে একটা সময় যে যার ধর্ম তার মতো করে পালন করেছে। তাতে কারো ক্ষতি বা অসম্মান হয়নি কখনো। অথচ এখন ফতোয়া দেওয়া হয় গান-বাজনা করা হারাম। একজন শিল্পী হিসেবে এসব কুমন্ত্র শোনার পরও শিল্পীরা একজোট হয়ে প্রতিবাদ করেনি। দিনের পর দিন এদের কিছু না বলে শুধু মাথায় তোলা ছাড়া আর কোনো কাজ করা হয়নি।

দেশে সাংস্কৃতিক ভবন, লাইব্রেরি, খেলাধূলার মাঠ বা সিনেমা হল তৈরি করা হয় না, অথচ দেশ জুড়ে মসজিদ-মাদ্রাসার সংখ্যা বাড়ানো হয়েছে বছরের পর বছর।

বিভাজনে আমি বিশ্বাস করি না। করি না বলেই গত ১০/১৫ বছরে অভাবনীয়ভাবে এই দেশটা যেভাবে পাল্টে গেছে তা আমি মেনে নিতে পারি না।

কারা এরা, যারা সুচারু পরিকল্পনা করে একটা বিশেষ গোষ্ঠীর ওপর হামলা করেই যাচ্ছে? শিল্প সংস্কৃতিকে অস্বীকার করে যাচ্ছে? সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য এবার দুর্গাপূজায় যে পরিমাণ হামলা, ভাঙচুর, আগুন লাগানো আর লুটতরাজ হয়েছে তার পরিণতি আঁধারময়।

লজ্জায় মাথা নিচু হয়ে আসছে আমার হিন্দু বন্ধুবান্ধব আর চেনা মানুষদের সামনে। সরকার বলছে কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। অথচ একবারও বলছে না, এমন ঘটনা আর কখনো হবে না। এই ছাড় দেওয়া হবে না, কথাটার মানে আমার বোধগম্য নয়।

এই ধরনের ধ্বংসাত্মক একটা অঘটন ঘটবার পরই তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়ে যাওয়ার কথা থাকে। তার তো কোনো লক্ষণ আজ পর্যন্ত দেখিনি। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষর পক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ কখনোই লক্ষণীয় হয়নি তেমন, আজ পর্যন্ত।

মুক্তিযোদ্ধাদের হেয় করার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, জাতির পিতার ভাস্কর্য ভেঙে দেওয়ার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, হিন্দু বা বৌদ্ধ স্থাপনা ভাঙার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, সাঁওতাল আদিবাসীদের উচ্ছেদ করার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, অসাম্প্রদায়িক হওয়ার জন্য নাস্তিক উপাধি দেওয়ার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, বাউলের চুল কেটে দেওয়ার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, শিক্ষককে কান ধরে উঠবস করার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, নববর্ষ উদযাপন সীমিত করবার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে, পূজা-পার্বণের সময় ভাঙচুর করার প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে। এত প্রশ্রয় আপনারা কোন দুর্বলতা থেকে দিয়ে থাকেন? এত কীসের ভয় আপনাদের?

আমি একজন শিল্পী হিসেবে, একজন মানুষ হিসেবে, বাংলাদেশের একজন স্বাধীন নাগরিক হিসেবে আজ প্রতিবাদ জানাই—এদেশ সকল ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণির সাম্যতায় আমাদের সবার বাংলাদেশ। এখানে উগ্র মৌলবাদের কোনো স্থান নেই।

সাইদ হাসান টিপু ।। সংগীতশিল্পী