ফেসবুক : তথ্যের বিকৃতি ও বিক্রিত তথ্য
সম্প্রতি ফেসবুক নিয়ে সর্বত্র আলোচনা হচ্ছে। অবশ্য আলোচনাটি নতুন নয়। গত এক দশক ধরেই ফেসবুকসহ বেশ কয়েকটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিরুদ্ধে ব্যবহারকারীর তথ্য চুরি, গুজব নির্ভর ও বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ছড়াতে সহায়তা প্রদান এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রের নির্বাচন ও সামরিক বিষয়েও হস্তক্ষেপ করার অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে।
এগুলো যে কেবল অভিযোগ তা-ই নয়, সুনির্দিষ্ট প্রমাণ সমেত এগুলো একাধিকবার উঠে এসেছে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক নানা গণমাধ্যমে ও বিভিন্ন একাডেমিক গবেষণাতে। কিন্তু সুরাহা সেভাবে হয়নি। কিছু জরিমানার বিধান হয়েছে, দু-একটি রাষ্ট্র চোখ রাঙিয়েছে কিন্তু সার্বিক সমাধানের যে কার্যক্রম, সেটা সুসম্পন্ন করা যায়নি।
বিজ্ঞাপন
তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি আসলে প্রযুক্তির, যেখানে অস্ত্র হলো কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য।
ক্যামব্রিজ অ্যানালিটিকার কেলেঙ্কারির কথাটিই যদি ধরি, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার করে ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচন এবং ব্রেক্সিট গণভোটকে প্রভাবিত করার যে কেলেঙ্কারি ফাঁস হয়েছিল সে সময়, তার সমাধানই বা কতটুকু হয়েছে? বিশ্ব আজ গণতন্ত্রের কাগুজে বাঘে পরিণত হয়েছে এই সোশ্যাল মিডিয়ার বদৌলতে।
গণতন্ত্রে জনসাধারণের অংশগ্রহণের যে কথা এতদিন পাশ্চাত্য আমাদের শুনিয়েছে বা আমরাও গণতন্ত্রের যে বটিকা সেবন করেছি, সেই হাতের পাঁচটাও আজকে ডিজিটাল দুনিয়ার মারপ্যাঁচে পটল তুলতে বসেছে। এখন ব্যক্তির চেয়ে ব্যক্তির ব্যক্তিগত তথ্য জরুরি এবং তার বাজার মূল্যও বেশ চড়া।
ব্যবহারকারীর আচরণ, পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তাধারা বা রাজনৈতিক দর্শনের কানাকড়িও এখন বেহাত হয়ে গেছে। ব্যক্তিগত তথ্যের নিরাপত্তা এখন কেবলই কথার কথা— কী জাতীয়, কী আন্তর্জাতিক মাধ্যমের কাছে।
কিন্তু এখানেও কথা আছে। রাষ্ট্র আর ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান এক জিনিস নয়। রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্ব রক্ষা বা নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য তথ্য প্রযুক্তির নানা ব্যবহার করে থাকে (সেটাও তাকে আইন মেনেই করতে হয়, যদিও সকল রাষ্ট্র সে আইন ঠিক মতো মানে না)। কিন্তু আজ বিশ্ব বাজারে যে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, তারা কোন এখতিয়ারে বা আইনে ব্যবহারকারীর তথ্য বিক্রি করে? সাংবিধানিকভাবে রাষ্ট্রের যে দায়বদ্ধতা আছে এই প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর তো সেটা নেই। এমনকি তারা কোনো নির্দিষ্ট সরকারের কাছে দায়বদ্ধও থাকে না। অনেকক্ষেত্রেই তারা অর্থের কারণেই রাষ্ট্রের চেয়েও বড় হয়ে ওঠে।
সমস্যাটি যে কেবল বাংলাদেশ বা পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্রের তা নয়; খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই এখন এই প্রতিষ্ঠানগুলোর নানা অপকর্ম নিয়ন্ত্রণ করতে হিমশিম খাচ্ছে। বোধ করি এ কারণেই বলা হয়, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধটি আসলে প্রযুক্তির, যেখানে অস্ত্র হলো কোটি কোটি মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য। এই তথ্যের কেনা-বেচাতেই গড়িয়ে চলছে পৃথিবীর রাজনীতি, অর্থনীতি ও আজকের সমাজব্যবস্থা।
গত ৬ অক্টোবর প্রাইভেসি অ্যাফেয়ার্সের একটি প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে দৈনিক সমকাল জানিয়েছে, প্রায় ১৫০ কোটি ফেসবুক ব্যবহারকারীর তথ্য হ্যাকারদের কাছে বিক্রি করা হয়েছে, যার মূল্য ৭ লাখ ৫০ হাজার ডলার বা ৬৫ কোটি টাকা। এ সংক্রান্ত প্রমাণাদিও প্রাইভেসি অ্যাফেয়ার্স তাদের ওয়েবসাইটে তুলে ধরেছে। এই কদিন আগেও গুপ্তচরবৃত্তির জন্য প্যাগাসাস স্পাইওয়্যারের কথা আমরা জেনেছি।
অধিকাংশ নেতিবাচক, হত্যার হুমকি প্রদান বা হিংসাত্মক মন্তব্যগুলো ভুয়া আইডি থেকে করা হয়। যদি প্রতিটি গণমাধ্যম তাদের ফেসবুক পেজের মন্তব্যকারীর এই আইডিগুলো শনাক্ত করে এবং আলাদাভাবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানায়, তবে তাদের একটি পেশাগত দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।
সাদা চোখে গবেষণা বা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তার দোহাই দিয়ে এগুলো ব্যবহার করা হলেও এর শিকড় অনেক গভীরে। কারণ যে তথ্যগুলো হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে, সেগুলো যে কেবল বিভিন্ন রাষ্ট্র বা তাদের সরকারের কাছেই থাকে তা তো নয়, যে ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বা গুপ্তচরবৃত্তির মাধ্যমে তথ্যগুলো সংগ্রহ করছে, তাদের কাছেও এগুলো থেকে যায়। ফলে পরবর্তীতে তারা এগুলো নানা প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তির কাছে বিক্রি করে।
ফেসবুক সংক্রান্ত সবচেয়ে বড় ঘটনাটি জানা গেল, মার্কিন সিনেটে প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ডেটা বিজ্ঞানী ফ্রান্সেস হাউগেনের দেওয়া সাক্ষ্য থেকে। এই সাক্ষ্যের সিংহভাগই পাওয়া যায় ওয়ালস্ট্রিট জার্নালের অনুসন্ধানী প্রতিবেদন আর সিবিএসকে দেওয়া হাউগেনের সাক্ষাৎকারে।
হাউগেনের উত্থাপিত নথিপত্র ও সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়, ফেসবুক সংবাদ বা বক্তব্যের সত্যতার ওপর নয় বরং মিনিংফুল সোশ্যাল ইন্টারেকশনের (এমএসআই) ভিত্তিতে পোস্টের ট্রাফিকিং ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে। অর্থাৎ সংবাদ যা-ই হোক, তার লাইক-কমেন্ট-শেয়ার বেশি হলেই সেটার ট্রাফিক বেশি হয়। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, যেখানে আবার বাংলাসহ আরও বেশকিছু ভাষার সম্ভাবনা এখনো প্রসারিত হয়নি। এ কারণেই আমরা দেখছি, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি আগে নানা ছবি-ভিডিওর মাধ্যমে বিভ্রান্তি ও মিথ্যাচার ছড়ালেও এখন তারা ব্যবহার করছে টেক্সট, অর্থাৎ লেখা এবং সেটা বাংলায়। যেহেতু বাংলা ভাষার ক্ষেত্রে ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজ প্রসেসিং (এনএলপি) এখনো কার্যকর সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি, তাই তাদের বিষয়ে কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের প্রয়োগ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে নির্ভুলভাবে চালানো যায় না।
তাহলে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়, মুক্তচিন্তা বা মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাস ভিত্তিক বা সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী স্ট্যাটাসে ফেসবুক তাদের কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের খড়গ চালায় কেন? এর একটি অন্যতম কারণ সম্ভবত এমএসআই। লাইক, শেয়ার বা কমেন্ট দিয়ে ফেসবুক যেমন একটি পোস্টের যথার্থতা যাচাই করে, তেমনি কোনো পোস্টের বৈধতা বা অবৈধতা নির্ণীত হয় তার বিরুদ্ধে কতগুলো রিপোর্ট হলো, সে বিষয়ে।
গত প্রায় এক দশক ধরেই আমরা দেখেছি, স্বাধীনতাবিরোধী অপশক্তি সংঘবদ্ধভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহার করছে। এটা যেমন বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেইজে শেয়ারকৃত নিউজের কমেন্টে, তেমনি কোনো একটি বিশেষ পোস্ট রিপোর্ট করার বিষয়ে। তারা যখন রিপোর্ট করে, তখন সংঘবদ্ধভাবে একটি নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে রিপোর্ট করে এবং সেটা দ্রুততম সময়ে ফেসবুকের দৃষ্টিগোচর হয় এবং তারা তথাকথিত কমিউনিটি স্ট্যান্ডার্ডের দোহাই দিয়ে উল্লিখিত লেখা, ছবি বা ভিডিও সরিয়ে ফেলে।
এক্ষেত্রে আমাদের করণীয় যতটা যৌথ ও পদ্ধতিগতভাবে হবে, ততটাই সফল হওয়া সম্ভব। সর্বপ্রথম ফেসবুকের ক্ষেত্রে একটি প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা সৃষ্টির বিষয়ে রাষ্ট্রের উদ্যোগী হওয়া জরুরি। এটা কেবল একটি মন্ত্রণালয়ের কাজ বলে আমি মনে করি না; বরং বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, সাইবার বিশেষজ্ঞ এবং অ্যাকাডেমিশিয়ানদের নিয়ে কাজটি করতে হবে। বাংলাদেশে ফেসবুকের বাজার নেহায়েত ছোট নয়, সুতরাং তার উপর চাইলে রাষ্ট্র চাপ প্রয়োগ করতেই পারে, যেমন অন্য যেকোনো বিদেশি কোম্পানির ওপর পারে যদি তারা দেশের স্বার্থ না দেখে।
দ্বিতীয় কাজটি গণমাধ্যমের দায়িত্ব নিয়ে করা উচিত বলে মনে করি। বিভিন্ন গণমাধ্যমের ফেসবুক পেইজে যে মন্তব্যগুলো আসে, একটু তলিয়ে দেখলে বোঝা যায়— অধিকাংশ নেতিবাচক, হত্যার হুমকি প্রদান বা হিংসাত্মক মন্তব্যগুলো ভুয়া আইডি থেকে করা হয়। যদি প্রতিটি গণমাধ্যম তাদের ফেসবুক পেইজের মন্তব্যকারীর এই আইডিগুলো শনাক্ত করে এবং আলাদাভাবে ফেসবুক কর্তৃপক্ষকে জানায়, তবে তাদের একটি পেশাগত দায়বদ্ধতা তৈরি হবে।
আমি বারবার এই প্রসঙ্গে কথা বলছি তার একটিই কারণ— সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের বিষয়ে আমরা যদি এখনই সচেতন না হই, তবে ভবিষ্যতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ফাঁকফোকরেই আমাদের অনেক সম্ভাবনার বিনাশ ঘটবে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিশ্চয়ই জরুরি, কিন্তু সেখানে কার নিয়ন্ত্রণ কীভাবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে, সেটা দেখার দায়িত্বও আছে। সেই দায়িত্ব যেমন রাষ্ট্রের, তেমনি ব্যক্তিরও। মানুষ এখনই বাইনারি নাম্বারে রূপান্তরিত হয়ে গেছে, ভবিষ্যতে এর পরিণতি আরও ভয়াবহ হবে।
মারুফ রসূল ।। ঔপন্যাসিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও ব্লগার