রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহও হত্যাকাণ্ডের শিকার হতে পারেন, এমনটি কি কেউই ভাবেননি? না ভাবলে কেন ভাবেননি? রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘিরে কর্মরত বাংলাদেশের গোয়েন্দারাও কোনো কিছু টের পেলেন না কেন? তার একান্ত ঘনিষ্ঠজনও কেন কোনো বিপদের আশঙ্কা অনুমান করতে পারেননি?

বিশেষত ২০১৮ সাল শেষ হওয়ার আগেই আরিফ মাঝির হত্যাকাণ্ডের ঘটনার পরও কেন মুহিবুল্লাহ সতর্ক হলেন না? আরিফ মাঝিও তার মতো স্নাতক উত্তীর্ণ ছিলেন। রোহিঙ্গাদের মধ্যে তারও উল্লেখযোগ্য গ্রহণযোগ্যতা এবং প্রভাব ছিল। তিনিও ইংরেজি-বাংলায় যোগাযোগে সক্ষম ছিলেন। তিনিও চাইতেন রোহিঙ্গারা একদিন স্বদেশে, স্বভূমিতে, স্বমর্যাদায় ফিরবে। তিনিও রোহিঙ্গাদের উপর ঘটে যাওয়া নৃশংসতার বিচার চাইতেন।

আন্তর্জাতিক মহল মিয়ানমারের জান্তাসহ মানবাধিকার ধ্বংসকারীদের বিচার করুক, তিনিও চাইতেন। তিনিও তথ্য সংগ্রহসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন। কানাডা সরকারের বাংলাদেশ ও মিয়ানমার বিষয়ক বিশেষ দূত বব রে-এর সঙ্গে সরাসরি তথ্য ব্যবস্থাপনার কাজও করেছিলেন তিনি।

মুহিবুল্লাহও অনেকটা একই ধরনের কাজই শুরু করলেন। তবে তার সংগঠন আরাকান রোহিঙ্গা সোসাইটি ফর পিস অ্যান্ড হিউম্যান রাইটস যথেষ্ট গোছানো। ক্যাম্পে ক্যাম্পে শাখা তৈরি হয়েছিল। মিয়ানমারের মানবতা লঙ্ঘন ও সহিংস কর্মকাণ্ডের তথ্য নথিবদ্ধ করছিলেন তিনি। এসব তথ্য বেশ কাজে লাগত জাতিসংঘে।

মিয়ানমারের বিপক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত ও আন্তর্জাতিক বিচারালয়ে গণহত্যা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলা চলছে। মামলার বাদীপক্ষ গাম্বিয়া, কানাডা ও নেদারল্যান্ড পর্যাপ্ত তথ্যের অভাবের কথা জানাচ্ছিল। তার জড়ো করা তথ্য সে অভাবটি পূরণ করতে পারত। তাহলে এসব কর্মকাণ্ড কাদের পছন্দ হওয়ার কথা নয়? সাধারণ জ্ঞানে বলা চলে, এসবই মিয়ানমার সরকারের পছন্দনীয় হওয়ার কথা নয়। রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা মনে করত, এখনই স্বদেশে ফেরার সময় হয়নি বা স্বাধীনতার যুদ্ধ বা স্বায়ত্তশাসনের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম করে নিজ ভূমি উদ্ধার করার আগে বাংলাদেশ ছাড়া নয়, তাদেরও পছন্দনীয় হওয়ার কথা নয়।

মুহিবুল্লাহ এবং আরিফ মাঝি দু’জনই প্রত্যাবাসনের পক্ষের মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশেরও একই চাওয়া...

মুহিবুল্লাহ কি তাদের কাছ থেকে বাধা পাওয়ার বিপদের সম্ভাবনাও আঁচ করেননি? কক্সবাজারের একজন সাংবাদিকের বরাতে খবরে এসেছে যে, তিনি তার জীবনহানির আশঙ্কা বা আক্রান্ত হওয়ার কোনো ঝুঁকি আছে মনে করতেন না। এই মনে না করা কি বাস্তবসম্মত?

অনুমান করা যায়, মুহিবুল্লাহ মানবতা-লঙ্ঘনের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের জন্য খানিকটা আন্তর্জাতিক অর্থ সহায়তাও হয়তো পেয়ে আসছিলেন। এই অনুমানের ভিত্তি ২০১৯ সালে তার নেতৃত্বে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কয়েক লক্ষ মানুষের সুসংগঠিত জমায়েত। সেই আয়োজনে রোহিঙ্গাদের সসম্মানে স্বদেশে ফেরাসহ ছয়টি দাবি ছিল।

মিয়ানমারে পরিবেশ তৈরি করার আগে তাড়াহুড়োর প্রত্যাবাসন চেষ্টার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানও ছিল। সেই অবস্থানটি আশ্রয়দাতা দেশ বাংলাদেশের কাছে এক ধরনের অস্বস্তিকর ও অযাচিত চাপ প্রয়োগের মতো ঠেকেছিল। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের রোহিঙ্গা প্রশাসন বিষয়টি ভালোভাবে নেয়নি। বাংলাদেশ মহলের ক্ষোভ গিয়ে পড়েছিল দাতা সংস্থা ও এনজিওদের ওপর।

ঘটনার অব্যবহিত পরেই বিভিন্ন ক্যাম্পে দেশি অস্ত্রশস্ত্রের সন্ধান মেলে। মুহিবুল্লাহ জোর গলায় কোনোরকম সশস্ত্রীকরণে তার সংগঠনের সম্পৃক্ততা অস্বীকার করেন। গণমাধ্যমে কিছু নির্ভরযোগ্য-অনির্ভরযোগ্য তথ্য আসে যে, অস্ত্রশস্ত্র একাধিক সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর। এইসব তথ্য বিবেচনায় নিলে স্পষ্ট যে, ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ বৃত্তি ও সন্ত্রাস তখনই সংগঠিত হতে শুরু করেছিল। 

মুহিবুল্লাহ এবং আরিফ মাঝি দু’জনই প্রত্যাবাসনের পক্ষের মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশেরও একই চাওয়া। তাদের হত্যাকারীদের সম্পর্কে জানা গেল যে, তারা প্রত্যাবাসন বিরোধী। কেন তারা প্রত্যাবাসন বিরোধী? প্রত্যাবাসন বিরোধিতার একটিই অর্থ হতে পারে প্রত্যাবাসন না হলেই তাদের বেশি লাভ। কিন্তু কী সেই লাভ? কারা চায় না নিজ ভূমিতে ফিরতে? কেন চায় না?

এক, মিয়ানমার সরকার চায় না প্রত্যাবাসন কার্যকর হোক। হতে পারে কোনো কোনো দল মিয়ানমার সরকারের চর অথবা স্বার্থরক্ষক। হতে পারে অর্থের লোভে নিজেদের বেচে দেওয়া বিশ্বাসঘাতক দল।

টেকনাফ-কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই মনে করেন, ওপার হতে অস্ত্র তৈরির কারিগর ও প্রশিক্ষকেরা এপারে চলে এসেছে। দিনের বেলা পাহাড়ে অস্ত্র নির্মাণ চলে। রাতে সেগুলোর পরীক্ষা ও প্রয়োগ হয়।

দুই, অপরাধ দারুণ অর্থকরী। যেমন ইয়াবা, আইস, ক্রিস্টাল মেথসহ নানারকম মাদকের বেচাকেনা ও পাচারের মাধ্যমে কাঁচা টাকায় কোঁচা ভর্তি করার লোভ। গত সপ্তাহে দুই দফায় ‘আইস’ বা ‘ক্রিস্টাল মেথ’ নামের ভয়াবহ বিধ্বংসী মাদকের দুইটি চালান ধরা পড়েছে। সেগুলোর বাজার মূল্যমান পাঁচ কোটি টাকারও বেশি। ইয়াবা ধরা পড়েছে কয়েক লাখ। ধরা পড়েনি এমন চালানে মাদকের পরিমাণ যে কত সেই ভাবনাটিও মাথায় রাখা দরকার। 

একটি অপরাধ কর্ম অসংখ্য অপরাধ কর্মের জন্ম দেয়। মাদক বিক্রির স্পটের নিয়ন্ত্রণ নিতে গেলে ভীতির জন্ম দিতে হয়। ফলে স্থানীয় বাজারঘাট ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অঞ্চলভিত্তিক চাঁদাবাজিও নির্যাতন চর্চা অনিয়ন্ত্রিতভাবে বাড়ছে। মাদক-বাণিজ্যের অপরিহার্য অনুষঙ্গ আগ্নেয়াস্ত্র। আগ্নেয়াস্ত্র সজ্জিত হতে হলে কেনাকাটা করতে হয়, অথবা অস্ত্র বানাতে হয়।

টেকনাফ-কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই মনে করেন, ওপার হতে অস্ত্র তৈরির কারিগর ও প্রশিক্ষকেরা এপারে চলে এসেছে। দিনের বেলা পাহাড়ে অস্ত্র নির্মাণ চলে। রাতে সেগুলোর পরীক্ষা ও প্রয়োগ হয়। খবর হয়েছে এখন প্রায় রাতেই রোহিঙ্গা ক্যাম্পে গোলাগুলির শব্দ মেলে। অস্ত্র কিনতে অর্থের প্রয়োজনে ডাকাতি, গুম, অপহরণ, মুক্তিপণ আদায়, প্রতিপক্ষকে হত্যা, খুনের জন্য ভাড়ায় খাটা ইত্যাদি বেড়েছে। চৌদ্দটি বা তারও বেশি দল-উপদল রয়েছে।

স্থানীয় সন্ত্রাসীদের বাটনা না দিয়ে তাদের পক্ষে মাদক ব্যবসা বা পাচারের কাজ চালিয়ে নেওয়া অসম্ভব। অর্থাৎ স্থানীয় ও রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী ও অপরাধীদের আঁতাত চক্রও তৈরি হয়েছে। নারী পাচার এবং মানব পাচারের খবরাখবরও মিলছে। কাগজে-কলমে সংখ্যা যা-ই হোক, স্থানীয়দের ভাষ্য, গত চার বছরে প্রায় তিনশটির কাছাকাছি হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে।

বিচ্ছিন্নতাবাদী আরাকান আর্মি এই মুহূর্তে মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সঙ্গে সংঘাতরত। তারা শক্তি সঞ্চয় ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ডে যে বাংলাদেশের ভূমিকেই ব্যবহার করছে না তার নিশ্চয়তা কী? অনেকে মুহিবুল্লাহর খুনি সন্ত্রাসী গোষ্ঠীটিকে আরাকান রোহিঙ্গা সলিডারিটি আর্মি বা আরসা হিসেবে দেখেন।

ক্যাম্পগুলোতে আল-ইয়াকিন নামে পরিচিত বাহিনীটিকে আরসারই প্রশাখা মনে করেন। দুই সংগঠনের যোগসাজশও বোঝাপড়ায় অপরাধ কর্ম চালানোও অসম্ভব কিছু নয়। আরসা হলে সেটি হবে মিয়ানমারের তুরুপের তাস। আরসা মিয়ানমারে ফাঁড়িতে আক্রমণ করে কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করেছে, এই অভিযোগের ভিত্তিতেই ২০১৭ সালের ভয়াবহ রোহিঙ্গা উচ্ছেদের ঘটনাটি ঘটানো হয়। এখনো আরসার নামটিই প্রকাশিত করা গেলে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের ফেরত না নেওয়ার শক্ততম যুক্তিটিই পেয়ে যাবে।  

টেকনাফ-কক্সবাজার এলাকার রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে অপরাধ এবং সন্ত্রাস বাড়লে আসলে কাদের লাভ সেই বিষয়টিতে বেশি নজর দেওয়া দরকার। নিঃসন্দেহে প্রথম লাভ মিয়ানমার সরকারের।

রোহিঙ্গাদের যত বেশি দলে-উপদলে ভাগ করে রাখা যায়, মিয়ানমারের ততই লাভ। সন্ত্রাসী গোষ্ঠী দ্বারা ভীতি সঞ্চার করা এবং স্থানীয়দের সঙ্গে যুদ্ধমান রাখা গেলে প্রত্যাবাসন সুদূর পরাহত হবে। প্রত্যাবাসনের জন্য আন্তর্জাতিক চাপের মুখেও মিয়ানমার অজুহাত খাড়া করতে পারবে যে, খুনি, ডাকাত, জঙ্গি, দাগি অপরাধী এবং মাদক ও অস্ত্রের কারবারি রোহিঙ্গাদের দেশটি ফেরত নেবে না। এদিকে অপরাধগুলো এবং অপরাধীদের শক্ত হাতে দমন না করা গেলে স্থানীয় বাসিন্দাদের বেড়ে চলা রোহিঙ্গা-বিদ্বেষ অগ্নিস্ফুলিঙ্গ হয়ে ওঠতে পারে। এই সময়ে প্রশাসনের সতর্ক ও দৃঢ়তম ভূমিকা পালন করার বিকল্প নেই।  

ড. হেলাল মহিউদ্দীন ।। অধ্যাপক, রাজনীতিবিজ্ঞান ও সমাজবিজ্ঞান, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়