ই-কমার্স ব্যাপারটা একটা কেনাকাটাই মাত্র। আপনি চিঠি লিখে একজন প্রকাশককে বা পুস্তক বিক্রেতাকে বই পাঠাতে অনুরোধ করতে পারেন। বইয়ের দাম আপনি বই হাতে পাওয়ার পরে শোধ করবেন সেটাও হতে পারে।

ছোটবেলায় আমরা ভিপি ডাকযোগে বই কিনতাম। ঢাকার প্রকাশক আমাদের মফঃস্বলের ঠিকানায় বই পাঠিয়ে দিত আর আমরা পোস্ট অফিসে টাকা দিয়ে বই নিয়ে আসতাম। আবার এরকমও হতে পারে যে আপনি আগেই মূল্য পরিশোধ করে দিলেন, বই ডাকযোগে আপনার ঘরের দুয়ারে পৌঁছে যাবে।

এখন যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে, বই বা অন্য যেকোনো পণ্য কেনার জন্যে অর্ডারটা আপনি অনলাইনে করে দিলেন। টাকাটা পণ্য পাওয়ার পর শোধ করবেন অথবা এমন হতে পারে যে পণ্যের মূল্য আপনি আগেই শোধ করে দিলেন। মূল যে লেনদেন, সেটা কিন্তু আইনগতভাবে এবং চরিত্রগতভাবে একই—কেনাবেচা।

ব্যাপারটা যদি সহজ কেনাবেচাই হবে তাহলে এই নিয়ে এত কেলেঙ্কারি, বিশাল সব অংকের প্রতারণা, উদ্যোক্তাদেরকে ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া এইসব কেন হচ্ছে? আর এইসব কেলেঙ্কারির জন্যে লোকে ই-কমার্সকেই দোষারোপ করছে কেন? আর এইসব কেলেঙ্কারিকে বা মানুষজনের চট করে ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনা বা শঙ্কা সেটা বন্ধই বা করবেন কী করে? 

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুব জটিল কিছু না। ই-কমার্সই বলেন বা অন্য যেকোনো বাণিজ্যই বলেন, বাজার অর্থনীতি যতদিন থাকবে মানুষের লোকসান হওয়া বা ঠকে যাওয়ার সম্ভাবনাও ততদিন থেকেই যাবে।

কিছু সংখ্যক মানুষ অধিক মুনাফার জন্যে নানা কায়দা বের করবে, কখনো কখনো সেইসব কায়দা কাজ করবে না ফলে কিছু মানুষ ঠকে যাবে। কখনো কখনো ঐসব বুদ্ধিমান মানুষ ইচ্ছে করেই ঠকানোর জন্যে প্রকল্প তৈরি করবে। এইসব ঠেকানোর জন্যে দেশের বিচারব্যবস্থা ঠিকমতো কাজ করতে হয় আর দেশে গণতন্ত্র কার্যকর থাকতে হয়। তাহলে যেটা হয়, কোনোরকম কেলেঙ্কারি যদি কেউ ইচ্ছা করেও করতে চায়, ধরা পড়লে দ্রুত বিচার হয়ে শাস্তি হয়ে যায়, সকলে জানতে পারে, সকলে সতর্ক হয়।

ব্যাপারটা যদি সহজ কেনাবেচাই হবে তাহলে এই নিয়ে এত কেলেঙ্কারি, বিশাল সব অংকের প্রতারণা, উদ্যোক্তাদেরকে ধরে জেলে নিয়ে যাওয়া এইসব কেন হচ্ছে?

কিছু মানুষ ঠকলেও অল্পের উপর দিয়ে যায়। আর কার্যকর গণতন্ত্র থাকলে সংসদে আলোচনা হয়, নানা পর্যায়ে মুক্ত আলোচনা হতে থাকে। ফলে আইনের কাঠামোতে কোনো ফাঁকফোকর থাকলেও চট করে সেটা নিবারণের জন্যে বিধিবিধান তৈরি করা যায়।    

সম্প্রতি ঘটে যাওয়া ইভ্যালি উদাহরণটাই নেন। ইভ্যালির ব্যবসার মডেলটা কী ছিল? দৃশ্যত যেটা মনে হয়, ওরা শুরু করেছে ছোট ছোট পণ্য অনেক কম দামে বিক্রি করা দিয়ে। এইসব বিক্রি করা ওরা সম্ভবত ইচ্ছে করেই কিছু লোকসান দিয়েছে। সেইসাথে আগ্রাসী বিজ্ঞাপন ও বিপণন কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। উদ্দেশ্য ছিল অনেক মানুষকে ওদের ক্রেতার তালিকায় নিয়ে আসা। এই করে ওরা যদি বিশাল একটা ক্রেতার সংখ্যা তৈরি করতে পারে, তাহলে একেকটা পণ্যের বিপুল অর্ডার নিতে পারে একসাথে।

মনে করেন, একটা ব্র্যান্ডের মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল যারা বানায় ওদের কাছে গিয়ে যদি আপনি বলেন, আমি একসাথে পঁচিশ হাজার মোটর সাইকেল নিতে চাই, তাহলে ওরা আপনাকে অনেক কম দামে সরবরাহ করবে। ফলে আপনি চাইলেই একজন খুচরা মোটরসাইকেল বিক্রেতার চেয়ে কম দামে অর্ডার নিতে পারেন। ইভ্যালি তাই করেছে। বাজার মূল্যের চেয়ে অবিশ্বাস্য কম মূল্যে পণ্যের অর্ডার নিয়েছে। কিছু কিছু সরবরাহও করেছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সামলাতে পারেনি। এর মধ্যে মানুষজন হাজার কোটি টাকার পণ্যের অর্ডার দিয়ে বসে আছে। খুচরা ব্যবসায়ীরাও অর্ডার করেছে, অনেকে ব্যক্তিগতভাবে বিক্রি করবে বলেও অর্ডার দিয়েছে।

ধরুন, যে পণ্যের দাম এক হাজার টাকা, ইভ্যালি অফার করেছে সেটা পাঁচশ টাকায়। একজন উদ্যোগী যুবক হয়তো ভাবীর কাছ থেকে বা খালার কাছ থেকে বা মায়ের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেই পণ্য বিশটা অর্ডার করে বসে আছে, হাতে পেলে সেগুলো হাজার না হোক সাতশ বা আটশ টাকায় বেঁচে দিতে পারলেও তো বেশ লাভ থাকে।

ইভ্যালি এদিকে আটকে গেছে, ওরা না পারছে যাদের কাছ থেকে পণ্য নিবে ওদেরকে টাকা দিতে, না পারছে পণ্য সরবরাহ করতে, না পারছে ওদেরকে টাকা ফেরত দিতে। 

এখন তো দেখা যাচ্ছে যে, ইভ্যালির নিজের কাছেও টাকা নেই, কেবল দায় আর দায়- হাজার কোটি টাকার দায়। ইভ্যালির উদ্যোক্তারা কি একদম প্রতারণার করার মতলবেই প্রথম থেকে এই ব্যবসায় নেমেছে? হতে পারে, তবে এই সম্ভাবনা কম।

ইভ্যালির উদ্যোক্তারা কি একদম প্রতারণার করার মতলবেই প্রথম থেকে এই ব্যবসায় নেমেছে? হতে পারে, তবে এই সম্ভাবনা কম।

অনুমান করছি, ওরা কিছুটা ঘাটতি দিয়ে হলেও বাজারে নিজেদের নামটা প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিল যাতে করে পরে বড় উদ্যোক্তা বা কোনো অর্থ লগ্নিকারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে পুঁজি নিতে পারে। এইটা খুব অভিনব কোনো ঘটনা নয়।

অনেক সময়ই প্রাথমিক উদ্যোক্তারা নতুন আইডিয়াটা নিয়ে মাঠে নামে, একটু ফল দেখাতে পারলে বড় উদ্যোক্তারা ওদের কাছ থেকে পুরো ব্যবসাটা বা আংশিক শেয়ার কিনে নেয়। ইভ্যালির উদ্যোক্তারা ব্যাপারটা সামলাতে পারেনি। মানুষের টাকা নিয়ে নিজেরা খেয়ে ফেলেছে, লোকজনকে মোটা বেতন দিয়েছে, আগ্রাসী বিজ্ঞাপন কার্যক্রম চালিয়েছে, এখন টাকা পয়সা শেষ- পুরা প্রক্রিয়া আটকে গেছে। ওদেরকে মেরে ফেলেন বা কেটে ফেলেন, টাকা আর ফেরত আসবে না। 

আমাদের এখানে বিচারব্যবস্থা যদি কার্যকর হতো, আর দেশে যদি গণতন্ত্র কার্যকর থাকতো, তাহলে ইভ্যালির এই কেলেঙ্কারি হয়তো ঠেকানো যেত, কিন্তু মানুষের যে লোকসান হয়েছে সেটা হয়তো শতকোটি বা হাজার কোটি টাকার ঘরে যাওয়ার আগেই এটা বন্ধ করা যেত। কীভাবে?
ধরুন, আজ থেকে তিন বছর আগে, ২০১৮ সালে যখন প্রথম এইটা নিয়ে একটা বা দুইটা খবরের কাগজে লেখা হচ্ছিল তখন যদি ওদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি বা দেওয়ানি কোনো মামলা হতো, আর সেইসব মামলায় যদি ছয় মাস বা নয় মাসের মধ্যে রায় হয়ে যেত তাহলে মানুষ ঠকানোর কায়দাটা তখনই থেমে যেত।

পাঁচ হাজার টাকার দায় শোধ করতে না পারলেই একুশ দিনের নোটিশ দিয়ে একজন পাওনাদার কোম্পানির অবসায়ন চাইতে পারে। কিন্তু আমাদের এখানে ব্যবসায়ীরা জানে যে মানুষ কোর্টে যাবে না কারণ কোর্টে বিচার পেতে অস্বাভাবিক বিলম্ব হয়। ওইরকম নোটিশ পেলেও ওরা পাত্তা দেয় না।

অথবা ধরুন, দুই হাজার আঠারো সালে যদি পার্লামেন্টে একদল এমপি হৈচৈ শুরু করে দিত যে, এটা কী হচ্ছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেখুন, বাণিজ্যমন্ত্রী দেখুন, জবাব দিন। তাহলে কী হতো? স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা বাণিজ্যমন্ত্রী পার্লামেন্টে একটা স্টেটমেন্ট দেওয়ার জন্যে তদন্ত করতেন, খোঁজখবর নিতেন—তাহলেই তো ঘটনা বের হয়ে যেত। 

এখন তো না আছে পার্লামেন্টে কোনো জবাবদিহিতা, না আছে সঠিক সময়ে সঠিক গতিতে যথাযথ বিচারের ব্যবস্থা। তাহলে যারা এইসব মানুষ ঠকানোর কৌশল নিয়ে মাঠে নামে, সেগুলো ধরতে না ধরতেই লোকসানের পরিমাণ গিয়ে ঠেকে হাজার কোটি টাকায়। 

ইমতিয়াজ মাহমুদ ।। আইনজীবী, সুপ্রিম কোর্ট