ট্যানারির বর্জ্য : বুড়িগঙ্গার পর দূষণে ধলেশ্বরী
বর্জ্যের বিষাক্ত প্রভাব থেকে ঢাকার প্রাণ বুড়িগঙ্গা নদীকে বাঁচাতে ট্যানারি শিল্পকে সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। প্রায় অর্ধেক ট্যানারি কারখানা সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এরই মধ্যে পরিকল্পনা ও প্রস্তুতির অভাবে বুড়িগঙ্গার মতো পরিণতি হতে যাচ্ছে সাভার সংলগ্ন ধলেশ্বরী নদীর।
ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদী, নদী সংলগ্ন হাজারীবাগ এলাকা দূষণমুক্ত করা এবং চামড়াশিল্পের পরিবেশ উন্নত করার লক্ষ্যে ২০০৩ সালে ১ হাজার ৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে সাভারের হেমায়েতপুরে ধলেশ্বরী নদীর তীরে ১৯৯ একর জমিতে চামড়াশিল্প নগর প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়।
বিজ্ঞাপন
এদিকে নতুন নির্মিত শিল্প অঞ্চলে সিইটিপি পুরোদমে কার্যকরী না হওয়ায় চালু হওয়া কারখানাগুলোর সরাসরি ও আংশিক পরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে করে ট্যানারির কঠিন ও তরল বর্জ্যের প্রভাবে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীও মরতে বসেছে।
চামড়াশিল্প নগরীর বর্জ্যে আশপাশের ছয় নদীর পানি মারাত্মক দূষিত হয়ে পড়ছে এবং দুর্বিষহ হয়ে উঠেছে ছয় নদীর আশেপাশের মানুষের জীবন। কিছুদিন আগেও যেখানে পরিবেশ স্বাভাবিক ছিল, এখন সেখানে পচা দুর্গন্ধে টেকা দায়।
জমিতে ফসল ফলছে না, মরে ভেসে উঠছে নদীর মাছও। চামড়াশিল্প নগরীর বর্জ্যে বংশী, ধলেশ্বরী, কালীগঙ্গা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ নদ ও বালু নদীর পানি দূষিত হচ্ছে। এর মধ্যে বংশী ও ধলেশ্বরীর পানি সবচেয়ে বেশি দূষিত হচ্ছে। এ দুই নদীর সঙ্গে অন্য চার নদীর সংযোগ থাকায় সেগুলোর পানিও দূষিত হচ্ছে। এসব নদীতে মাছ নেই বললেই চলে এবং জলজ উদ্ভিদের অস্তিত্বও বিপন্ন।
নির্মিত শিল্প অঞ্চলে সিইটিপি পুরোদমে কার্যকরী না হওয়ায় চালু হওয়া কারখানাগুলোর সরাসরি ও আংশিক পরিশোধিত বর্জ্য নদীতে ফেলা হচ্ছে। এতে করে ট্যানারির কঠিন ও তরল বর্জ্যের প্রভাবে বুড়িগঙ্গার মতো ধলেশ্বরী নদীও মরতে বসেছে।
নদী পাড়ের স্বল্প আয়ের মানুষের জীবিকা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। বাতাসে বর্জ্যের দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়েছে। দূষিত পানি ব্যবহার করে অনেকে চর্মরোগ ও শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হচ্ছেন।
মানুষ এবং বন্য জীবজন্তু উভয়ের জন্যই নদীর পানি, পানীয় জলের একটি গুরুত্বপূর্ণ উৎস। তেমনি নদীর পানি, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ কার্যক্রমে প্রয়োজনীয় জল সরবরাহ করে।
ট্যানারি বর্জ্যের কারণে নদীর দূষণ মানুষ, পশু বা কৃষিকাজে ব্যবহারের পানিকে অনুপযোগী করে তোলে। এই দূষিত পানিতে উপস্থিত অণুজীব, রোগ বিস্তারকে সহায়তা করে। রোগ বিস্তারকারী জীবাণু এবং বিষাক্ত বর্জ্যের উপস্থিতির কারণে নদীগুলো স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে। তদুপরি নদী দূষণ নদীর প্রাকৃতিক মূল্য নষ্ট করে।
নদী এক সময় ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প, সাহিত্য এবং পর্যটনের একটি অন্যতম জায়গা ছিল যেটি এখন নষ্ট হতে চলেছে। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন থাকার কথা সাড়ে ৪ থেকে ৮ মাত্রায়, গত শীতে ধলেশ্বরীতে ট্যানারির আশপাশে পাওয়া গেছে শূন্য মাত্রা। সবচেয়ে বিপজ্জনক যে উপাদানটি পাওয়া গেছে তা হচ্ছে, মাত্রাতিরিক্ত ক্রোমিয়ামের উপস্থিতি।
ক্রোমিয়াম পানিতে বেশি থাকলে তা ক্যানসারসহ নানা ধরনের রোগ সৃষ্টি করতে পারে। এছাড়া লবণ (সোডিয়াম ক্লোরাইড) সহনশীল মাত্রার কয়েক গুণ বেশি পাওয়া গেছে।
পরিবেশ সংরক্ষণে পানির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে যদি পানি দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে যায় তার ব্যাপক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়তে বাধ্য।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ট্যানারি বর্জ্যের কারণে ঢাকার আশপাশের নদীর পানির ক্ষতি হচ্ছে ৪০ কোটি টাকার বেশি। গত ৩০ বছরে ক্ষতি হয়েছে আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি। এত কেবল পানির হিসাব। এছাড়া জনস্বাস্থ্যর যে ক্ষতি হয়েছে তা তো সীমাহীন।
হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি শিল্প কারখানা সাভারে স্থানান্তর করার ফলে ইতিবাচক কোনো পরিবর্তন হয়নি বরং ক্ষতি হয়েছে অনেক বেশি।
এখানে ট্যানারি শিল্প কারখানাগুলো পুরোদমে চালু হলে ১০-১২ বছরের মধ্যে বুড়িগঙ্গার মতো অবস্থা হবে ধলেশ্বরী নদীর। তখন হয়তো ধলেশ্বরীর পাড় থেকে সরিয়ে ট্যানারি শিল্প স্থানান্তরে করা হবে পদ্মা, মেঘনা, অথবা যমুনার মতো কোনো নদীর পাড়ে। এভাবে জোড়াতালি দিয়ে চালালে হবে না। এর থেকে উত্তরণ অত্যাবশ্যক। এজন্য পরিবেশ অধিদপ্তর, পরিবেশ গবেষক, জনপ্রতিনিধি এবং সরকারের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের সবাইকে একত্রিত হয়ে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দেখাতে হবে।
বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশের কোথায়, কোন এলাকায়, কখন পরিবেশ দূষণ বা পরিবেশের সাথে সাংঘর্ষিক শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে সেদিকে নজর দিতে হবে।
পরিবেশ সংরক্ষণে পানির কোনো বিকল্প নেই। আমাদের মতো নদীমাতৃক দেশে যদি পানি দূষিত বা বিষাক্ত হয়ে যায় তার ব্যাপক ও বিরূপ প্রতিক্রিয়া সর্বত্র পড়তে বাধ্য। সে বিবেচনায় নদ-নদী বাঁচাতে হবে। এখন শিল্প বর্জ্য যাতে কোনো অবস্থাতেই নদ-নদীর পানিতে মিশতে না পারে সেজন্য প্রয়োজনীয় কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
অধ্যাপক ড. কবিরুল বাশার ।। প্রাণিবিদ্যা বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়