করোনাভাইরাস নিয়ে যখন সামনের সারির যোদ্ধারা করোনা মোকাবিলায় নিজেদের জীবন বাজি রেখে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে চলেছেন তখন ঘরে অলস বসে নেই আর একজন। যেই একজন আমাদের নিরাপদ পানি পান করা, নিরাপদ স্যানিটেশন, বাল্যবিবাহ রোধ, নারী শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা শিখিয়েছিলেন; তিনি আবার আমাদের মাঝে সচেতনতার বার্তা নিয়ে সময়ের প্রয়োজনে ছুটে এসেছেন। তিনি আর কেউ নন। বাংলাদেশসহ আমাদের এই দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের বন্ধু। যিনি নিজে সচেতন হন, পরিবারকে সচেতন করেন, প্রতিবেশীদের সচেতন করেন, একসময় তার বন্ধুদের নিয়ে সদলবলে সচেতন করেন তার গোটা গ্রামকে। তারপর বদলে দেন গোটা দেশ।

শিশুদের সেই প্রিয় পরিচিত মুখ আর কেউ নয়। তার নাম ‘মীনা’। এক কল্পচরিত্র কীভাবে এই দক্ষিণ এশিয়ার সকল শিশুর বাস্তবের বন্ধু হয়ে উঠেছিল তা ভাবলে বড় হয়েও আমার বিস্ময় কাটে না।

আমার শৈশবের স্মৃতি জুড়ে এখনো গোলাপি রঙয়ের কামিজ পরে লাল ফিতে বাঁধা লম্বা বেনুনি দুলাতে দুলাতে ছুটে চলছে মীনা। 

সমাজে সমতার বার্তা, সচেতনতার বার্তা, আলোর বার্তা ছাড়ানোর প্রায় তিন দশকে পা রাখতে যাচ্ছে সেই মীনা…আমাদের শিশু কিশোরদের প্রিয় মীনা…

বাংলা কার্টুনের জগতের এক অপরূপ সৃষ্টি এই মীনা চরিত্র। সামাজিক নানা অসংগতিতে, এক সময়ের সোচ্চার কণ্ঠ ছিল কার্টুন চরিত্র মীনা। উল্লেখ্য ইউনিসেফের তৈরি দক্ষিণ এশিয়ান শিশুদের টেলিভিশন শো ‘মীনা কার্টুন’ ইংরেজি, বাংলা, হিন্দি, নেপালি এবং উর্দু ভাষায় সম্প্রচারিত হয়েছে।

মীনার সব গল্পই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবর্তনের পক্ষে। ১৯৯৩ সাল থেকেই মীনা কার্টুন বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

মীনা দক্ষিণ এশিয়ার শিশুদের লিঙ্গ, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক বৈষম্যের বিষয়ে তার গল্পের মাধ্যমে কমিক বই, অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র -মীনা কার্টুন এবং রেডিও সিরিজ (বিবিসির সাথে যুক্ত)এর মাধ্যমে সবাইকে শিক্ষিত করে।

তার গল্পের দ্বিতীয় চরিত্রের মধ্যে রয়েছে তার ভাই রাজু এবং তার পোষা তোতা মিঠু। তার অ্যাডভেঞ্চারের মধ্যে রয়েছে শিক্ষা লাভের চেষ্টা করা, রাজুর মতো খাবারের সমান অংশ পাওয়া এবং এইচআইভি সম্পর্কে শেখা, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সঠিক উপায় এবং মানুষকে সাহায্য করা।

মীনার সব গল্পই সামাজিক ও সাংস্কৃতিক চর্চার পরিবর্তনের পক্ষে। ১৯৯৩ সাল থেকেই মীনা কার্টুন বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। মীনা কার্টুনের মাধ্যমে শিশু ও তাদের পরিবারকে বিভিন্ন বিষয়ে সচেতন করার কাজ করে আসছে ইউনিসেফ। 
শিশু-কিশোরদের মাঝে একটি কল্প কার্টুন চরিত্র ‘মীনা’ এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার কারণ কী? শিশু-কিশোররা মীনাকে এমন আপন ভেবে নেওয়ার কারণ কী? সে প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে।

১৯৯০ থেকে ২০০০ সাল ছিল মেয়ে শিশুর দশক। একটি অ্যানিমেটেড চলচ্চিত্র সিরিজ তৈরি করে তার মাধ্যমে দক্ষিণ এশিয়ায় মেয়ে, তাদের পরিবার ও কমিউনিটিকে আনন্দ দেওয়া ও উৎসাহিত করার মধ্য দিয়ে এই দশক উদযাপন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল ইউনিসেফ।

মীনা সিরিজের কেন্দ্রীয় চরিত্র উপযোগী নাম ও চেহারা ঠিক করতে অনেকগুলো গবেষণা করা হয়েছিল। আমরা আজকে যে মীনাকে চিনি, তার এই চেহারা ঠিক করার আগে চার দেশের শিল্পীরা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মেয়েদের চেহারা উপজীব্য করে কয়েক ডজন ছবি এঁকেছিলেন। প্রথম দিকের পর্বগুলো নির্মাণের সময় মীনার পোশাক এবং তার জীবনাচরণ কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে ১০ হাজারেরও বেশি শিশুর মতামত নিয়েছিল ইউনিসেফ। 

মীনা যেন একেবারে সাদামাটা মনের বুদ্ধিমতী সরল কিশোরী, যাকে শিশুরা নিজেদের একজন ভেবে নিতে পেরেছে অবলীলায়।

কেবল বাংলাদেশের শিশু-কিশোরদের কাছে নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া জুড়েই মীনা নামটি খুব পরিচিত। মীনা চরিত্রে কোনো কল্পনার আতিশয্য নেই। মীনা যেন একেবারে সাদামাটা মনের বুদ্ধিমতী সরল কিশোরী, যাকে শিশুরা নিজেদের একজন ভেবে নিতে পেরেছে অবলীলায়।

টেলিভিশন সেটের সামনে বসে একসময় মীনা কার্টুন দেখার জন্য ভিড় করতেন ছেলে-বুড়ো সবাই। কারণ পরিবারের আদরের মীনা কেবল কার্টুন চরিত্র নয়, সামাজিক যেকোনো সংকট মোকাবিলায় এক টুকরো আশার আলোও ছিল সে।

ছেলে শিশু আর মেয়ে শিশুর মাঝে যে বৈষম্য তার বিরুদ্ধে আমরা সমাজের মুখে যে করাঘাত করতে পারিনি সমাজের সেই মুখে কষে আঘাত করেছে মীনা। খাবারের থালার অর্ধেক আর পুরো ডিমের রূপকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে নারী আর পুরুষের সমান কাজের শক্তির জন্য সমান পুষ্টি দরকার।

এক ছোট্ট বালিকা যেন প্রথা ভেঙ্গে আমাদের বড় মানুষদের শিখিয়ে দিয়ে গেল—নারীর ঘরের কাজের মূল্যায়ন করা, কন্যা শিশুর স্বাধীনতা দেওয়া, নারী শিক্ষার সুযোগ দেওয়া, নারীকে ঘরে সিদ্ধান্ত গ্রহণে যুক্ত করা, ইভটিজিং-এর প্রতিবাদ, বাল্যবিবাহ বন্ধ করা… আরও কত কী! কেবল নারী পুরুষ বৈষম্য দূর করা নয়, মীনা দূর করেছে সমাজের কুসংস্কারও। এইচআইভি সম্পর্কে শেখানো, বাচ্চা জন্ম দেওয়ার সঠিক উপায় এবং সুস্বাস্থ্যের বার্তা পৌঁছে দিয়েছেন সকলের মাঝে। 

মীনার ‘আমি স্কুল ভালবাসি’ পর্বটি বড়বেলার আমাকে একজন শিক্ষক হিসেবে ভাবিয়েছে। এক ছোট্ট মেয়ে কী চমৎকারভাবে একটি দেশের শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া জরুরি তা দিক নির্দেশ করেছে। যেখানে উপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করার জন্য একটি বন্ধুত্বপূর্ণ শ্রেণিকক্ষ পরিবেশের প্রয়োজনীয়তার উপর আলোকপাত করা হয়েছে। পাশাপাশি তত্ত্বীয় শিক্ষার পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষা পদ্ধতির গুরুত্বকেও তুলে ধরা হয়েছে। সেই পর্বে মীনা তার শিক্ষককে অনেক অভিজ্ঞতা থেকে সংগৃহীত জ্ঞানের মাধ্যমে একটি মজার ক্লাসরুম তৈরি করতে সাহায্য করে। কী দারুণ শিক্ষক-শিক্ষার্থী সম্পর্ক! কী দারুণ শিক্ষার পরিবেশ! 

মীনা কিন্তু থেমে নেই। করোনা মহামারির সময়ে সামাজিক সচেতনতার বার্তা নিয়ে আবার হাজির হয়েছে আমাদের শিশু-কিশোরদের মাঝে। সবাই মিলে, কীভাবে জীবাণুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয়, আর কীভাবেইবা জয়ী হতে হয়, তা খুব সহজেই তুলে ধরেছে মীনা।
ঘরে থাকি নিরাপদে থাকি, সামাজিক দূরত্ব মানে, শারীরিক দূরত্ব এই দুইটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দিয়েছে মীনা। আমরা যখন জাতিকে কঠিন পরিভাষা হোম কোয়ারেন্টাইন বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছি তখন মীনা চার শব্দে কী সহজ করে বুঝিয়ে দিল- ‘ঘরে থাকি নিরাপদে থাকি’!
আমরা যখন জাতিকে সামাজিক দূরত্ব বোঝতে হিমশিম খাচ্ছি তখন মীনা এলো বোঝাতে-‘সামাজিক দূরত্ব মানে শারীরিক দূরত্ব’। পাশাপাশি করোনার সময় মীনা রাজুসহ তার সকল শিশু-কিশোর বন্ধুদের শিখিয়েছে অনলাইনে ক্লাস কিংবা ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাওয়া-বিপদের সময় ইন্টারনেটই হতে পারে আমাদের সবচেয়ে বড় বন্ধু। কিন্তু সামান্য অসাবধানতায় এই ইন্টারনেটেই হতে পারে বড় কোনো বিপদ।

ইউনিসেফ বাংলাদেশ করোনা পরিস্থিতি মাথায় রেখেই তৈরি করা হয়েছিল মীনা কার্টুনের এই পর্ব। চলতি বছরের মার্চ মাসে মীনা কার্টুনের এই নতুন পর্বটি সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেয় ইউনিসেফ। ‘ইউনিসেফ বাংলাদেশ’ নামক ফেসবুক পেজে উন্মুক্ত করা হয় ভিডিওটি। ভিডিওটির সাথে ক্যাপশনে লিখে দেওয়া হয় ‘দুষ্টু ভাইরাস রাজার বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামলো মীনা! কে জিতবে সেই লড়াইয়ে?’ নতুন পর্বটি বের হওয়ার পরপরই প্রশংসা পেয়েছে দর্শকদের। মহামারি করোনার সময় ইউনিসেফের এমন কার্যক্রমকে স্বাগত জানিয়ে ভিডিওটি শেয়ারও করছেন অনেকে।

প্রায় তিন দশক পরে এসেও পুরনো হয়ে যায়নি মীনা চরিত্র। যুগের তালে তালে নিজেকে খাপ খাইয়ে নিয়ে এগিয়ে চলছে মীনা। আমরা বিশ্বাস করি, আগামী দশকগুলোতেও মীনার অগ্রযাত্রা থেমে থাকবে না। মীনা নিশ্চয়ই সময়ের প্রয়োজনে আবার আমাদের মাঝে নতুন কোনো বার্তা নিয়ে হাজির হবে। আমরা সে অপেক্ষায় রইলাম। সেই সাথে ‘মীনা দিবস’-এ মীনার জন্য ভালবাসার বার্তা পাঠিয়ে রাখলাম।


শান্তা তাওহিদা ।।  চেয়ারপারসন, কমিউনিকেশন ডিজঅর্ডারস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়