নেতার আদর্শ ধারণ করে রাজনীতি করেন কর্মীরা। নেতার নির্দেশ মেনে তারা ছুটে যান তৃণমূলে মানুষের কাছে। দেন ভবিষ্যৎ পরিবর্তনের বার্তা। বিনিময়ে কর্মীরা পান দলের সাংগঠনিক দায়িত্ব। কেউ পান রাষ্ট্রের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ। কিন্তু অনেকে আছেন যারা নিজের লাভের জন্য নয়, নেতার আদর্শ ধারণ করে সারাজীবন মানুষের জন্য কাজ করেন। শুধু রাজনৈতিক দর্শনই তাদের একমাত্র অবলম্বন।

জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শুধু আওয়ামী লীগের নেতা নন। বাংলাদেশের সব মানুষের, বিশ্ব বাঙালির নেতা। অবিসংবাদিত নেতা যেমন আমাদের জন্য স্বাধীন ভূখণ্ড দিয়েছেন, তেমনি বাঙালিদের মাথা উঁচু করে বাঁচার পথও দেখিয়েছেন। জাতির জনকের দেখানো পথে এখনো হেঁটে চলেছেন বহুজন। তাদের অনেকে সরাসরি আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নন। তবুও বঙ্গবন্ধুর আলোর পথে চলেছেন। শত বাধাতেও সেই পথ থেকে তারা বিচ্যুত হননি। তাদেরই একজন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়।

যদিও পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ জানেন অভিনেতা হিসেবে। তার অভিনয় জীবনের পর্ব দুটি। একটি একাত্তর পূর্ববর্তী, অপরটি একাত্তর পরবর্তী। প্রথম পর্বে শুধুই শৌখিন থিয়েটারকর্মী।

রাজবাড়ী আর ফরিদপুরে সেই পর্বের সবকিছু। পাকিস্তান আমলে নাট্যকার কল্যাণ মিত্রের নাটকে অভিনয় করতেন। সেসময় নাটক চলাকালে মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীকে লক্ষ্য করে ডিম-টমেটো ইত্যাদি ছুঁড়ে মারার এক হাস্যকর খেলায় মেতে উঠত কিছু দুষ্ট লোক। এসবের পেছনে থাকতো দাঙ্গাবাজ ছাত্র সংগঠন ন্যাশনাল স্টুডেন ফেডারেশন (এন. এস. এফ.)। সেই বাধাতে দমে যাননি তারা। বরং ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের জোয়ারে ‘এন. এস. এফ.’ ভেসে গিয়েছিল।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়কে মানুষ জানেন অভিনেতা হিসেবে। তার অভিনয় জীবনের পর্ব দুটি। একটি একাত্তর পূর্ববর্তী, অপরটি একাত্তর পরবর্তী।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম টিভি নাটক ‘বিশ্বাস ঘাতকের মা’। তবে তাকে বেশি জনপ্রিয় করেছিল ‘সকাল সন্ধ্যা’ নাটকটি। আশির দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত ‘সকাল সন্ধ্যা’ ধারাবাহিক নাটকে ‘শাহেদ’ চরিত্রের আড়ালে একসময় হারিয়ে গিয়েছিল তার আসল নাম।

‘সকাল সন্ধ্যা’র অভাবনীয় দর্শকপ্রিয়তার কারণে বিটিভি’তে পরে আরও অনেক ফ্যামিলি সোপ প্রচারিত হয়েছিল। শিল্পী-নাট্যকার-কুশলীরা প্রচুর জনপ্রিয়তাও পেয়েছেন। কিন্তু কোনটাই ‘সকাল সন্ধ্যা’কে ছাড়িয়ে যায়নি। বিটিভির এই জনপ্রিয় প্রথম সিরিয়ালটির একটি পর্বও কর্তৃপক্ষের কাছে জমা নেই। সব নষ্ট করে ফেলা হয়েছে।

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রথম অভিনীত স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘আগামী’। নাসির উদ্দিন ইউসুফ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র ‘একাত্তরের যীশু’ ছবিতে তিনি অনবদ্য অভিনয় করেন। এছাড়া ‘আমার বন্ধু রাশেদ’, ‘গেরিলা’, ‘উত্তরের খেপ’, ‘কিত্তনখোলা’, ‘মেঘলা আকাশ’, ‘আধিয়ার’, ‘আমার আছে জল’, ‘মৃত্তিকা মায়া’, ‘আমি শুধু চেয়েছি তোমায়’, ‘বুনো হাঁস’ ছবিতে অভিনয় করে দর্শকের প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

তার প্রথম বাণিজ্যিক ছবি ‘মহামিলন’। সহ-অভিনেত্রী ছিলেন ববিতা। কক্সবাজারে ছবির শুটিং-এর প্রথম দিনে ছিল সমুদ্র পাড়ে গানের দৃশ্য ধারণ। একটি দৃশ্যে ববিতাকে জড়িয়ে ধরে উঁচু করে তুলতে গিয়ে কোমরে ব্যথা পেয়েছিলেন তিনি।

অভিনেতার চেয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় পরিচয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাদের নাস্তানাবুদ করেছেন। ছাত্রলীগের কাজ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেন।

স্বাধীনতার পর যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের কাজে অংশগ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধুর সফর সঙ্গী হিসেবে ঘুরে বেরিয়েছেন দেশের প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে। পঁচাত্তরে জাতির পিতাকে হারায় বাংলাদেশ। নেমে এলো ঘোর অন্ধকার, তবুও থামেননি পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়। জনমত গঠনে পত্রিকায় লিখলেন, বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার কথা। বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করে গড়ে তুললেন সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং বাংলাদেশ গ্রাম থিয়েটার।

১৯৮৫ সালে তিনি এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নামলেন। গঠন করলেন বাংলাদেশ যুব ঐক্য। প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হয়ে শুরু করলেন স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন। ১৯৯১ এর সাধারণ নির্বাচনে ফিরল না গণতন্ত্র। দৈনিক লালসবুজ পত্রিকায় সম্পাদক হয়ে কলম ধরলেন অনিয়মের বিরুদ্ধে।

অভিনেতার চেয়ে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বড় পরিচয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। রণাঙ্গনে অস্ত্র হাতে পাকিস্তানি সেনাদের নাস্তানাবুদ করেছেন। ছাত্রলীগের কাজ করতে গিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সাহচর্য লাভ করেন।

একসময় বিবিসি বাংলায় খবর পাঠও করেছেন। হায়েনাদের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে অভিনয় করেছেন ‘পলাশী থেকে ধানমন্ডি’ নাটকে বঙ্গবন্ধুর চরিত্রে। কিন্তু এজন্য কম ঝুঁকি নিতে হয়নি তাকে। চেষ্টা হয়েছে তার প্রাণনাশের। বাড়ি থেকে পালিয়ে আত্মগোপনে থাকতে হয়েছে তাকে।

বাঙালি জাতীয়তার ইতিহাস চিরায়ত অসাম্প্রদায়িকতার। ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতার সেখানে স্থান নেই, স্থান নেই একাত্তরের পরাজিত শক্তির। ধর্মের দোহাই দিয়ে যারা মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ জলাঞ্জলি দিতে চায়, তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায় গড়ে তুলেছেন ‘সম্প্রীতি বাংলাদেশ’ নামের সামাজিক সংগঠন। ধর্ম যার যার, বাংলাদেশ আমার- এই বোধ আজ নতুন করে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সবার মাঝে। ৭১ বছর বয়সেও বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের বার্তা নিয়ে ছুটে চলেছেন সর্বত্র।

লিখেছেন গল্প, উপন্যাস, নাটক, কবিতা, ছড়া। সম্পাদনাসহ ১৬টি বই রয়েছে তার। ছোটগল্প অসাধারণ। পাঠকের জন্য ছোটগল্প ‘শান্তির পাখিটা বেঁচে ছিল’ কিছু অংশ তুলে ধরছি—

‘খুব ভোরে সবুজ হয়ে ওঠা পাখিটাকে দুই হাতের তালুতে আদর করতে করতে ভস্মীভূত পাল বাড়ির ভিটায় গিয়ে দাঁড়ায় শফিক। চারিদিকে সবকিছু কেমন খা খা করছে। কুয়াশা খুব ঘন ও নিচু হয়ে ঢেকে রেখেছে পালগাঁওয়ের সমস্ত ভূখণ্ড। সুখেন কাকার উদোম ভিটায়, একা একা কী যেন খুঁজে চলেছে একটা কালো কুকুর। দুই হাতের তালুতে উচ্চস্বরে ডেকে হঠাৎ ছটফট করে পাখা ঝাপটায় সদ্য সবল হয়ে ওঠা পাখিটা। শফিক হাতের তালু ঢিলা করে পাখিটাকে উড়ে যেতে বলে। পাখিটা ওড়ে না। শফিকের বাহু বেয়ে সে কাঁধে উঠে আসে। তারপর গলার স্বর খুব গাঢ়, গম্ভীর ও মিষ্টি করে শফিকের কানের কাছে অনবরত বলতে থাকে- শান্তি, শান্তি। শফিকের বুকের ভেতর তখন হু হু করে ওঠে। অসংখ্য ও অজস্র শাদা পিংপং বল এই সময় পাল বাড়ির বিরান উঠানে খুব দ্রুত ড্রপ খেতে খেতে পরস্পরে ঠোকাঠুকি খায়।’

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৫০ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর, ফরিদপুর শহরে। ৭১ পূর্ণ করেছেন তিনি। যে একাত্তরে দেশ জেগেছিল, যে একাত্তর আদর্শের মেরুদণ্ড সোজা রাখে। সেই একাত্তর বয়সে এখনো তরুণ তিনি। ছুটে চলেছেন দেশের আনাচে-কানাচে।

ছোটবেলায় তাকে নিয়ে খুব ভয়ে ছিলেন তার মা। কারণ একজন সন্ন্যাসী মাঝেমাঝেই ভিক্ষা করতে এসে মাকে বলতেন ‘এ ছেলেকে তুই ঘরে রাখতে পারবি না, ও সন্ন্যাসী হবেই।’ এরপর থেকে মা সারাক্ষণ আগলে রাখতেন। কে জানে, ছেলে যদি সন্ন্যাসী ও গৃহত্যাগী হয়ে সত্যি সত্যি দূরে চলে যায়। কারণ তার ভেতরে যে একটা উড়নচণ্ডী বাউণ্ডুলে সত্তা ছিল তা টের পেয়েছিলেন মা। তবে সেই বাউণ্ডুলে ছেলেটিই বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করে জীবন উৎসর্গ করেছেন দেশের জন্য, মানুষের কল্যাণে। তার মা আজ বেঁচে থাকলে সবচেয়ে বেশি খুশি হতেন। শুভ জন্মদিন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, মাকেও প্রণাম।

বিপ্লব কুমার পাল ।।  গণমাধ্যমকর্মী

biplobkumarpaul@gmail.com