শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তন : বাস্তবতা ও চ্যালেঞ্জ
শিক্ষামন্ত্রী জানিয়েছেন, ২০২৩ সাল থেকে পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা থাকছে না। এইটা একটা অত্যন্ত ভালো সংবাদ যে, শেষ পর্যন্ত সরকার আমাদের কথা শুনেছেন।
একটি সময় ছিল যখন আমরা পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা উঠিয়ে দেওয়ার কথা বলেছি, তখন প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে দায়িত্বশীল কেউই আমাদের কথা শুনেনি, বিষয়টিকে গুরুত্ব দেননি। প্রথমত, পিইসি ও জেএসসি পরীক্ষা শুরুই করা ঠিক হয়নি। দ্বিতীয়ত, আরও আগেই সরকারের বোঝা উচিত ছিল যে এইটা কতটা আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত। যাই হোক, অবশেষে ভালো সিদ্ধান্ত এসেছে এইটাই বড় কিছু।
বিজ্ঞাপন
উপরের ভালো সিদ্ধান্তের সাথে আরও একটি ভালো সিদ্ধান্ত হলো, এসএসসি লেভেলে বিভাগ উঠিয়ে দেওয়া। কিন্তু সমস্যা হলো এটা যেই নতুন সিদ্ধান্ত দ্বারা প্রতিস্থাপিত করা হলো সেটা বরং বিদ্যমান নিয়ম থেকে আরও শতগুণ খারাপ।
সারা পৃথিবীতে নবম শ্রেণি থেকেই মৌলিক বিজ্ঞানের ৩টি বিষয় যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়।
ব্রিটিশ কারিকুলাম বা বাংলাদেশের বিদ্যমান ইংরেজি মাধ্যমেও নবম শ্রেণিতে শিক্ষার্থীদের ট্যাগ লাগিয়ে বিভিন্ন শ্রেণিতে বিভাজিত করা হয় না। তার মানে এই না যে, তারা ওই তিনটি মৌলিক বিষয় একটু কম পড়ে। তার মানে এই না, ওই তিনটি এক করে একটি বিষয় বানিয়ে সেখানে কারিগরি বিষয় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়।
সারা পৃথিবীতে নবম শ্রেণি থেকেই মৌলিক বিজ্ঞানের ৩টি বিষয় যেমন পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে পড়ানো হয়।
ব্রিটেনসহ অন্যান্য সভ্য দেশে কেবল এসএসসি নয় উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়েও কোনো বিভাজন রাখে না। সেখানে এসএসসি এবং এইচএসসি উভয় ক্ষেত্রেই সকল বিষয়ই ঐচ্ছিক। যার যেই বিষয় পড়তে ইচ্ছে হয় সে সেই বিষয় পড়বে।
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েই অনেকে বুঝে ফেলতে পারে সে গণিতে ভালো না বা গণিত তার পছন্দ না, কিংবা জীববিজ্ঞান অথবা পদার্থবিজ্ঞান পছন্দ না। তারা তখন তাদের অপছন্দের বিষয় বাদ দিয়ে পছন্দের বিষয় পড়তে পারে।
কেউ সংগীত বিদ্যা অথবা চারুকলার প্রতি বেশি আগ্রহী। সে তখন ঐসব বিষয় নির্বাচন করতে পারে। কেউ হয়তো ভবিষ্যতে বিজ্ঞান, কলা এবং বাণিজ্য এইগুলোর দুটোতে যাওয়ার দরজা খোলা রাখার জন্য পছন্দমতো বেশি বিষয় পড়তে পারে। অর্থাৎ কে কতগুলো বিষয় পড়বে এবং কী কী বিষয় পড়বে এইসব বিষয়েই স্বাধীনতা থাকতে হবে। আমরা কী করলাম? গলায় ফাঁস পড়িয়ে সবাইকেই কারিগরি পড়াতে বাধ্য করতে যাচ্ছি।
আমরা কী করলাম? পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন এবং জীববিজ্ঞানকে একত্রিত করে একটি বিষয় বানানো হয়েছে যেখানে এক চিমটি পদার্থবিজ্ঞান, এক চিমটি রসায়ন এবং এক চিমটি জীববিজ্ঞান থাকবে। যার অর্থ হলো আগে যতটুকু পদার্থবিজ্ঞান পড়তো তার তিন ভাগের এক ভাগ পড়বে, তিন ভাগের একভাগ রসায়ন এবং তিন ভাগের একভাগ জীববিজ্ঞান পড়বে। খালি হওয়া জায়গায় কারিগরি বিষয় ঢুকানো হবে। অর্থাৎ মৌলিক বিজ্ঞান কম পড়ে, কম শিখে অল্প বয়সেই সবাইকে কারিগরি বিষয়ে জ্ঞান দেওয়া হবে। এটা ভয়ানক আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত।
বিজ্ঞানকে যদি কারিগরি বিষয় দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা টেকনিশিয়ান হবে কারণ কারিগরি বা প্রযুক্তির জ্ঞানের আগে মৌলিক জ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও রসায়নে জ্ঞান অবশ্যই লাগবে।
এই জন্যই যারা প্রকৌশল বিষয়ে পড়ে তাদের প্রথম দুই বছর বেশি করে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও রসায়ন পড়ানো হয়। তারপর বিশেষায়িত বিষয় পড়ানো হয়। হঠাৎ করে কেন কারিগরি বিষয় পড়ানো নিয়ে এত মাতামাতি? আমরা কি কেবল মধ্যপ্রাচ্য আর দেশের পোশাক শিল্পের জন্য শ্রমিক আর দর্জি বানাব? বিষয়টা গুরুত্বের সাথে ভাবা দরকার।
বিজ্ঞানকে যদি কারিগরি বিষয় দিয়ে প্রতিস্থাপিত করা হয় তাহলে শিক্ষার্থীরা টেকনিশিয়ান হবে কারণ কারিগরি বা প্রযুক্তির জ্ঞানের আগে মৌলিক জ্ঞান বিশেষ করে পদার্থবিজ্ঞান, গণিত ও রসায়নে জ্ঞান অবশ্যই লাগবে।
আরেকটি সিদ্ধান্ত হলো যে, এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফল নির্ধারিত হবে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণির প্রতি বর্ষ শেষে একটি ন্যাশনাল পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে। এটিও মোটের উপর একটি ভালো সিদ্ধান্ত কিন্তু বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে কতটা ভালো হবে সেটা বিবেচনার দাবি রাখে।
প্রতিবছর একটি করে এইরকম ন্যাশনাল পরীক্ষা নেওয়ার মতো ইনফ্রাস্ট্রাকচার বা ক্ষমতা আমাদের আছে কি না তা নিয়ে আমার সন্দেহ আছে। এছাড়া এর সাথে আরেকটি খারাপ সিদ্ধান্ত ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো, এই পর্যায়ে ৩০% মূল্যায়ন হবে সংশ্লিষ্ট কলেজে। ফলে শিক্ষকদের উপর স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রভাব বাড়বে। বেশি নম্বরের চাপ থাকবে। এর আগে ল্যাবের নম্বরগুলো নিজ নিজ কলেজে শিক্ষকদের হাতেই ছিল আর ওটা যে কেমন ছিল তা আমরা সবাই জানি।
নম্বর দেওয়া নিয়ে টাকা পয়সার লেনদেন থেকে শুরু করে অনেক কিছুই আছে যা অনৈতিকতাকে উৎসাহিত করে। এখন এর সাথে যোগ হলো প্রতি বিষয়ের ৩০% নম্বর। এইবারের চাপ আমাদের শিক্ষকরা সামলাতে পারবে বলে আমি মনে করি না। এতে অনৈতিকতার চর্চা আরও অনেক বেড়ে যাবে।
এসএসসিতে বিভাগ উঠিয়ে দিয়ে শিক্ষাকে একমুখী করা হবে। শুনতে খুব ভালো লাগছে, তাই না? আসলে সত্যিকার অর্থে কি একমুখী বানানো হচ্ছে? সেটাও গভীরভাবে ভাবতে হবে। কারণ একমুখীর নামে আমরা এখন যা করব তা আগের চেয়ে অনেক বেশি ক্ষতিকর হবে।
এর ফলে শিক্ষার্থীরা আগের পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের প্রতিটার তিন ভাগের এক ভাগ করে নিয়ে বিজ্ঞান বানিয়ে একটা বিষয় পড়াবে। এর ফলে দুইটা বিষয় চাপিয়ে দেওয়ার খালি জায়গায় কারিগরি বিদ্যা ঢুকানো হবে।
শুধু নবম-দশম শ্রেণি না, ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে মাধ্যমিকের সব ক্লাসে কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হবে। বিজ্ঞানের চেয়ে কারিগরি শিক্ষা হঠাৎই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল কেন? বিষয়টি সরলভাবে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
ড. কামরুল হাসান মামুন ।। অধ্যাপক, পদার্থবিজ্ঞান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়