পুলিশের আত্মহত্যা : শুধুই কি সংখ্যা, মানসিক চাপ কেউ দেখছে?
চলমান করোনাকালীন সময়ে নাগরিক সেবাদানে পুলিশের অমানুষিক পরিশ্রম এবং অবদান আলোচনাতে এসেছে বারবার। কিন্তু মোটাদাগে এখনো দিনশেষে ‘পুলিশিং’ একটি ‘থ্যাংকসলেস জব’।
একজন পুলিশ কর্মকর্তার ভুলে নাগরিক সমাজ এবং মিডিয়া পাড়ায় যে পরিমাণ ঝড় ওঠে, সমানুপাতিকভাবে পুলিশের কাজ সেভাবে প্রশংসায় আসে না। পুলিশের দায়িত্বকে আমরা মূলত দায়িত্বই মনে করি।
বিজ্ঞাপন
প্রায়শই আমরা খবরের কাগজে দেখি পুলিশ বাহিনীর সদস্যরা আত্মহত্যা করছেন। ঠিক তখন আমরা হয়তো একটু নড়েচড়ে বসি। কারণ প্রাণ যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমরা অনুভব করতেও পারি না যে, আমাদের দেশের কত শত পুলিশ বাহিনীর সদস্য ভেতরে ভেতরে প্রতিদিন আত্মহত্যার অনুভূতির মধ্য দিয়ে যায়!
‘পুলিশিং ইজ অ্যা স্ট্রেসফুল জব’-এটা কেবল কথার কথা হিসেবে আমরা বলে খালাস! বাংলাদেশে পুলিশের চাকরি আসলে কতটা স্ট্রেসফুল বা চাপের তা নিয়ে আমাদের কোনো সিরিয়াস আলাপ-তর্ক কিংবা গবেষণা নেই।
আরও পড়ুন : পুলিশ যখন অপরাধী
ধরেই নেওয়া হয়, পুলিশের চাকরি যারা করবে তাদের মানসিকভাবে অনেক শক্ত হতে হবে, এটাই তো নিয়ম! কিন্তু পুলিশ উপ-সংস্কৃতির (subculture) স্বতন্ত্র নানামুখী চাপ, ঝুঁকি, উদ্বেগ, বিপদ, বিচ্ছিন্নতা যে সবচেয়ে শক্তিশালী মানসিক গঠনের মানুষকেও প্রভাবিত করতে পারে এবং করেও সেটা আমরা জাতি হিসেবে এখনো আমলে নিতে পারলাম কোথায়!
বাংলাদেশে পুলিশের চাকরি আসলে কতটা স্ট্রেসফুল বা চাপের তা নিয়ে আমাদের কোনো সিরিয়াস আলাপ-তর্ক কিংবা গবেষণা নেই।
সাধারণ মানুষ, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবীমহল, রাষ্ট্র সবাই আমরা একটি আধুনিক পুলিশ বাহিনী চাই। কিন্তু পুলিশের মনের যত্ন না নিয়ে একটি ‘আধুনিক পুলিশ বাহিনী’ নির্মাণ করা আদৌ সম্ভব কি না এই প্রশ্নটি আমি তুলে রাখতে চাই নিম্নোক্ত কারণে-
ক. জন ভিওলান্টি (John Violanti) একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ‘পুলিশ স্ট্রেস’ বিশেষজ্ঞ। নিউইয়র্ক স্টেট পুলিশে ২৩ বছর চাকরি করার পর এখন তিনি পুলিশের মানসিক চাপের বিভিন্ন দিক নিয়ে গবেষণা করেছেন।
১৯৯৬ সালে তার ‘পুলিশ সুইসাইড’ নামে বিখ্যাত বই প্রকাশিত হয়। ২০১২ সালে পুলিশের সমসাময়িক চাপ ও ঝুঁকি নিয়ে তিনি এবং তার দুজন সহকর্মী সাড়া জাগানো একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন। সেখানে তারা বলছেন যে, অন্য অনেক পেশার চাইতে পুলিশিং এতটা চাপ পূর্ণ পেশা হওয়ার কারণ হলো, পুলিশের কার্যক্রম পেশা হিসেবেই নানান অনাকাঙ্ক্ষিত সহিংস ঘটনা, ট্রমা বা মানসিক আঘাতের প্রকাশ, বিরক্তিকর সময়সীমা, অসঙ্গত শিফট বা পালাবদল এবং টেনশন বিষয়গুলোর সাথে অন্তর্নিহিতভাবে যুক্ত।
আরও পড়ুন : পুলিশের উপর জনগণের আস্থা বাড়ানো যায় কীভাবে?
পুলিশ কেন মানসিক ভাবে ভেঙে পড়ে আত্মহত্যা পর্যন্ত করে, জন ভিওলান্টি সে সম্পর্কে তার গবেষণায় ১০টি প্রধান কারণ বের করেছেন—
১। পেশাগতভাবে ভীষণ ব্যস্ত থাকায় ব্যক্তিগত সম্পর্কের সমস্যা ও বৈবাহিক জীবনে টানাপোড়েন,
২। আইনি ঝামেলা-অভ্যন্তরীণ তদন্ত,
৩। হতাশায় অ্যালকোহল / মাদক সেবন,
৪। পেশাগত বিষণ্নতা,
৫। আঘাতমূলক ঘটনার দীর্ঘস্থায়ী এক্সপোজার (Chronic exposure to traumatic events),
৬। দীর্ঘস্থায়ী স্ট্রেস,
৭। আগ্নেয়াস্ত্রের প্রাপ্যতা,
৮। মানসিক সহায়তার অভাব,
৯। মানসিক সাহায্য চাওয়ার ভয়,
১০। মানসিক স্বাস্থ্য পেশাদারদের প্রতি অবিশ্বাস।
খ. এই পেশায় ‘জব স্যাটিসফ্যাকশন’ বা ‘কাজে সন্তুষ্টি’ মানসিকভাবে উপযুক্ত থাকার জন্য অত্যন্ত জরুরি। গার্ডনার এবং পিয়ার্স (১৯৯৮) তাদের একটি গবেষণায় দেখিয়েছেন যে, যখন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কর্মচারীরা এমন মনোভাব পোষণ করে যে, কর্মক্ষেত্রে তাদের অবদান ‘মূল্যবান’ হিসেবে যথেষ্ট স্বীকৃত নয় এবং তারা প্রচণ্ডভাবে কূটনৈতিক চাপের মধ্যে থাকে তখন ফলস্বরূপ তাদের মধ্যে চাকরির প্রতি প্রেষণাবোধ (motivation) লোপ পায় এবং নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস কমতে থাকে।
আমরা পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি এবং সেটা অবশ্যই দরকারও আছে। কিন্তু সেটার সাথে সাথে এই পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে বসে আমাদের পুলিশের আর্থিক এবং অনার্থিক প্রেষণা নিয়ে কথা বলতে হবে।
বাংলাদেশে এই বিষয়েও কোনো গবেষণা নেই। সরকারি চাকরির শৃঙ্খলা রক্ষার নিমিত্তে মিডিয়ার সাথে মূলত উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তাদের যোগাযোগ থাকায় তুলনামূলকভাবে যারা নিম্নপদস্থ পুলিশ সদস্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গি বা তাদের মানসিক অবস্থা সঠিকভাবে মিডিয়ায় আসার সুযোগ কম। এমনকি এই বিষয়ে কোনো গবেষণা পর্যন্ত নেই পুলিশ বাহিনীতে। অধস্তন পুলিশ সদস্য যারা মাঠপর্যায়ে কাজ করে তাদের পেশা সংশ্লিষ্ট চাপ এবং প্রেষণা বিপরীতভাবে আনুপাতিক।
আরও পড়ুন : পঙ্গু সমাজের একজন মনোরঞ্জন হাজং
আমরা পুলিশের দুর্নীতি নিয়ে কথা বলতে ভালোবাসি এবং সেটা অবশ্যই দরকারও আছে। কিন্তু সেটার সাথে সাথে এই পুঁজিবাদী সমাজের মধ্যে বসে আমাদের পুলিশের আর্থিক এবং অনার্থিক প্রেষণা নিয়ে কথা বলতে হবে। বিশেষ করে, পুলিশের অধস্তন সদস্যদের ‘কর্মে সন্তুষ্টি’ এবং তাদের মানসিক অসন্তোষগুলো বের করে সেগুলো নিয়ে কাজ শুরু করা অত্যন্ত দরকার।
পুলিশের অধস্তন সদস্যদের পারফরম্যান্স মেজারমেন্ট বা কর্মক্ষমতা পরিমাপ করার এবং যোগ্যতা অনুযায়ী প্রমোশনের যে পদ্ধতি অবলম্বন করা হয় সেটা নিয়েও ভাবতে হবে।
গ. পুলিশ উপ-সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছেদের ভয় ঐতিহ্যগতভাবে, তাদের মানসিক সমস্যা যতটাই প্রকট হোক না কেন, পুলিশ কর্মকর্তারা বিরত থাকেন পেশাদারি মানসিক সাহায্য চাওয়া থেকে। এই অনীহার বিভিন্ন কারণ আছে।
কর্মকর্তারা চান না তাদের সহকর্মীদের সামনে তাকে মানসিকভাবে দুর্বল দেখাক বা তাকে কেউ দুর্বল মনে করুক। আর এভাবে ছোট ছোট মানসিক সমস্যাগুলো একদিন বড় হয়।
মানসিক যন্ত্রণা সহ্য করে করে যখন আর সম্ভব হয় না তখন নিজেরাই সমস্যার সমাধান হিসেবে ‘আত্মহত্যা’কে বেছে নেন অন্যের কাছে সাহায্য চাওয়ার চেয়ে। তাই সাংগঠনিকভাবেই পুলিশ বাহিনীতে প্রফেশনাল মেন্টাল হেলথ সাপোর্ট সেন্টার সহজ প্রাপ্য করা দরকার এবং মানসিক সাহায্য নেওয়ার বিষয়টাকে উৎসাহিত করা এবং স্বাভাবিক ‘জব রুটিন’ বা নিয়ম হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।
উম্মে ওয়ারা ।। সহকারী অধ্যাপক, অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়